অনিকেত সুকান্ত:
সব সমাজেই আত্মহত্যার ঘটনা অবিরল; তেমনি প্রায় সব সমাজেই আত্মহত্যাকে ঘিরে কিছু ধ্যান-ধারণা বা মতাদর্শ বিদ্যমান। এ মতাদর্শগুলো কোনো তাৎক্ষণিক কিংবা অবিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; দীর্ঘ সময়পরিক্রমায় ঐতিহাসিক গৎবাঁধা সুষমার আদলে এ মতাদর্শগুলো সফল বাহাসে পরিণত হয়েছে। মতাদর্শের ভিত্তি হচ্ছে জগৎ সম্পর্কে সাচ্চা বক্তব্য বা অসাচ্চা বক্তব্য, যা বিভিন্নভাবে বোঝা কিংবা বোঝানো সম্ভব। সামজিক জগৎ সম্বন্ধে আমাদের সব বর্ণনায় মতাদর্শের অনুপ্রবেশ ঘটে এবং আমাদের অধিকাংশ বক্তব্য যত ফ্যাকচুয়াল বা বাস্তবিকই হোক না কেন, সেটির রয়েছে এক বা একাধিক মতাদর্শিক ডাইমেনশন। স্পষ্ট করি, 'সব সমাজেই আত্মহত্যার ঘটনা দৃশ্যমান'_ এটি বলা মতাদর্শিক নয়, বরং এর সঙ্গে যখন ব্যক্তিগত বিশ্বাস জুড়ে দেয়া হয় যেমন 'এটি অত্যন্ত খারাপ', তখন এটি ভীষণভাবে মতাদর্শিক। এ লেখাটি ক্ষুদ্র পরিসরে এ অঞ্চলের প্রেক্ষাপটে আত্মহত্যার সামাজিক মতাদর্শিক আদলটি ব্যাখ্যা করতে নিবিষ্ট।
দক্ষিণ এশিয়ায়, বিশেষ করে বাংলাদশে কিংবা ব্রহ্মা-ের অন্য কোথাও আত্মহত্যাকে ঘিরে যে নির্মাণ বা অনুশীলন, তা গতানুগতিকতা দ্বারা পরিপুষ্ট। বিবেচ্য যে, ধর্মীয় কথন, বিধি-নিষেধ এবং অনুশাসনগুলো কিংবা ধর্মীয় মনস্তত্ত্ব সামাজিক অনুশীলনের কিংবা মোটা দাগে বললে সামাজিক মনস্তত্ত্বের সঙ্গে মাখামাখি অবস্থায় থাকে। ছাই দিয়ে ধরেও এ দুটিকে আলাদা করা যায় না। ধর্মের শীতল পাটিতে শুয়ে থাকা এ সমাজের মননে আত্মহত্যা তেমনই এক পাপ, যা আত্মহননকারী ব্যক্তিকে এবং অন্যান্য জুড়ে থাকা বিষয়গুলোকে বিনা বাক্যব্যয়ে নেতিবাচক হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেয়।
আত্মহত্যার বিষয়টিকে সমাজে চিরায়তভাবেই পরাজয়ের সমার্থক হিসেবে দেখা হয়। একজন মানুষ যখন সমাজের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে অপারগ হয়, তখন আত্মহত্যা সংঘটিত হয়। কিন্তু সমাজে একজন মানুষ অনেকগুলো সামাজিক উপকরণের সঙ্গে নৈকট্যপূর্ণ অবস্থায় বেঁচে থাকে এবং এ বেঁচে থাকা যতটা না নিজের জন্য, তার চেয়ে ঢের বেশি সামাজিক প্রয়োজনে। সমাজ একভাবে স্বাভাবিকীকরণ করে দেয় যে, মানুষ প্রাকৃতিক নিয়মে জন্মলাভ করবে, সামাজিক নিয়মকানুন ও অনুশাসন পালন করে জীবন অতিবাহিত করবে এবং মৃত্যুর সময় হলে অব্যতিক্রমী কার্যকারণের ফলে প্রাকৃতিক নিয়মে দেহত্যাগ করবে। ব্যক্তিমানুষের নিজের কল্যাণে নিজেকে দমন করার কোনো এখতিয়ার নেই। কিন্তু একজন মানুষ আত্মহত্যা করে তার অন্যতম কারণ হলো সে নিজেকে সমাজে চলমান ধ্যানধারণা, ধারা, বন্ধন, শৃঙ্খলাগুলোর সঙ্গে সুসংহত অবস্থায় খুঁজে পায় না কিংবা অবশেষে পেতে চায় না। সমাজ একজন ব্যক্তির প্রয়োজনকে থোরাই আমলে নেয়, বরং আত্মহত্যাকে ব্যক্তিক পরিপ্রেক্ষিত থেকে ব্যাখ্যা না করে এক ধরনের গৎবাঁধা (স্টেরিওটাইপ) বিশেষণে ব্যাখ্যা করতে চায়। এ ধরনের বিশেষায়ন কিংবা বিশ্লেষণ নারীদের ক্ষেত্রে আরও প্রকট।
নারীদের আত্মহত্যাকে প্রায়ই কিছু যৌনবাদী ভাষা বা ডিসকোর্সের ব্যাখ্যা করা হয়। যেমন 'মাইয়া মানুষ মাইয়া মানুষের মতো থাকব, বেশি বাড় বাড়লে এমনই হয়', 'সারা দিন ইটিস-পিটিস কইরা বেড়ায়, নিশ্চয়ই পেট-টেট বাঁধাইয়া ফেলছিল'। সামাজিক মানসে নারী সর্বদাই শরীরসর্বস্ব একটি বর্গ, এ শরীর অতিমাত্রায় সংবেদনশীল এবং পরিশেষে এ শরীর আবার কোনো না কোনো পুরুষেরই সম্পদ। একজন নারী যখন আত্মহত্যা করে, তা যে কারণেই হোক না কেন, সামাজিক বিবেচনায় তার আত্মহত্যাকে অমীমাংসিত কোনো ঘটনা কিংবা চক্ষুলজ্জা থেকে বাঁচার নিমিত্ত হিসেবে ধরে নেয়া হয়। আদতে এমনটি না-ও ঘটে থাকতে পারে; কিন্তু নির্দিষ্ট সমাজের সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় এবং সমাজ কাঠামোতে এটি একটি অবশ্যম্ভাবী নির্মাণ হিসেবে দাঁড়িয়ে যায় (মিডিয়া কীভাবে এ ধরনের অনুশীলনকে প্রতিভাত করে, তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা সম্ভব, কিন্তু এখন সে আলোচনায় আর যাচ্ছি না)। পুরুষরা কিছুটা এ ধরনের যৌনবাদী বাহাসমুক্ত। কারণ হতে পারে, ডিসকোর্সগুলো আধিপত্যশীল পুরুষ সমাজ ব্যবস্থার উৎপাদবিশেষ। তারচেয়ে বরং সমালোচনার তীর ঘুরে এসে উল্টো নারীর ওপরই পড়ে। পরিবারে একজন অবিবাহিত নারীর আত্মহত্যা অন্য অবিবাহিত বোনদের বৈবাহিক প্রকরণগুলোকে অতিমাত্রায় প্রভাবিত করে, যা পরিবারের অবিবাহিত অন্য পুরুষদের ক্ষেত্রে তেমনটি নয়; বরং পুরুষদের ক্ষেত্রে কিছুটা সহনীয় মায়াপ্রবণ বাহাস শুনতে পাওয়া যায়। যেমন 'কী হইলো পোলাডার, মনে হয় কোনো মাইয়া (ক্ষেত্রবিশেষে পেত্নী) ভর করছিল মাথায়', 'মাথাডাই মনে হয় গেছিল', 'এত আবেগ থাকলে হয়' ইত্যাদি। এ ধরনের লেবেল প্রদানের মাধ্যমে এক ধরনের বিমূর্ত চর্চাকে প্রতীয়মান করা হয়। আত্মহন্তক ব্যক্তির পরিবার বা জ্ঞাতিজনরা, যারা এ আরোপ প্রক্রিয়া থেকে বাইরে থাকে, তারাও বিষয়টির যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে নিস্পৃহ থাকে। কিন্তু আত্মহত্যা কখনোই কোনো তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নয় কিংবা একক কোনো কারণের ফলা নয়। যখন ব্যথা, ব্যথার সঙ্গে অভিযোজনের উপকরণগুলোকে অতিক্রম করে যায়, তখন আত্মহত্যা হয় ফল।
আত্মহত্যার মতো আত্মহত্যার কারণগুলোও ভীষণভাবে স্টেরিওটাইপড। প্রেক্ষিত বিবেচনা না করেই নারী-পুরুষের মধ্যে আত্মহত্যার ধারণায়নের ক্ষেত্রে বিভাজন তৈরি করা হয়। বলা যাবে না যে, শুধু গ্রামীণ এলাকায় এ ধরনের চর্চা চলে কিংবা শহর এলাকায়। এখন তো গ্রাম এবং শহরের মধ্যে ব্যবধান ক্রমে হাওয়া হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু নারী-পুরুষের মধ্যে তেমনটি নয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারী কর্তার আসনে থাকলেও নারী অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন, মুক্তি প্রভৃতি পশ্চিম উপজাত বিষয়গুলো ধোঁয়াশাই থেকে যায়, বিশেষ করে এ অঞ্চলে। যে কোনো বিষয়েই হোক না কেন, পশ্চিমকে ছুঁতে গিয়ে প্রাচ্য দিন দিন তার স্বকীয়তা হারাচ্ছে। বিষয়গুলো কোনোভাবেই বিচ্ছিন্ন নয়; ব্যবহার্য সুগন্ধি সাবান থেকে শুরু করে আত্মহত্যার মতো হিমশীতল একটি প্রসঙ্গের ক্ষেত্রেও পরমভাবে সত্যি।
সামাজিক জগতে আত্মহত্যা হলো একটি ফ্যাক্ট এবং এটি যত ফ্যাকচুয়ালই (ভধপঃঁধষ) হোক না কেন, সমাজে আত্মহত্যার ব্যাখ্যা, বর্ণনা, আলোচনা, কিংবা সমালোচনার ক্ষেত্রে রয়েছে মতাদর্শিক ডাইমেনশন। আমরা এসব সামাজিক মতাদর্শিক ডাইমেনশনকে শুধু মিথ্যা বা সত্য, পাপ বা পুণ্য কিংবা ভালো বা মন্দ বলে অভিহিত করতে পারি না; বরং এ ধরনের ডাইকোটোমিতে না গিয়ে আমরা আত্মহত্যার আলোচনায় সামগ্রিক (যড়ষরংঃরপ) বিষয়গুলোকে নজরান্দাজ করার মধ্য দিয়ে এ ধরনের আলোচনাকে বিকল্প পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি_ যা একই সঙ্গে যুগোপযোগী এবং আপাতদৃষ্টিতে মুক্তমনা।---অালোকিত বাংলাদেশ
খবর বিভাগঃ
ফিচার
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়