Friday, September 26

কেমন আছে সাগরতলের বাসিন্দারা?


জলের প্রাণের সঙ্গে ডাঙার প্রাণের সম্পর্ক অতি নিবিড়। আমাদের জীবনের ওপরও সমুদ্রের রয়েছে গভীর প্রভাব। আমাদের কৃষি, বন ও পরিবেশের ভাগ্য অনেকখানি নির্ভর করছে সমুদ্রের স্বাস্থ্যের ওপর। কিন্তু সাগরের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কি ঠিক রাখতে পারছি আমরা? সেন্টমার্টিনসসহ নানা সাগরদ্বীপের হালফিলটাইবা কী? বিস্তারিত জানাচ্ছেন প্রতিবেশ বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ আরজু 
সারা দিনে ডুবসাঁতার করে ঠিক কী পাওয়া গেল, তা টের পাওয়া যায় সন্ধ্যে বেলায়, যখন ক্যামেরার মেমোরি কার্ড থেকে স্টিল ও ভিডিও পিকচার ল্যাপটপে নামাই। সেন্টমার্টিনস দ্বীপে আমরা এ কাজটা করি 'রশিদের হোটেলে'র প্রাঙ্গণে চৌকি পেতে। এ নামেই হোটেলটিকে চেনে স্থানীয়রা। দ্বীপে আমাদের নিজেদের আস্তানায় বিদ্যুৎ নেই, ফলে রশিদের হোটেলে ক্যামেরা-কম্পিউটার-সেলফোন ইত্যাদির ব্যাটারি চার্জ দিতে দিতেই সারা দিন তোলা ইমেজের যাচাই-বাছাই চলে। তিন-চারটে ক্যামেরার কতকগুলো মেমোরি, রাত গভীর হয়ে যায়। স্থানীয়রা ভিড় করে দেখতে চায় ফুলের ছবি। সাগরতলে প্রবাল ও শৈবালকে সেন্টমার্টিনস দ্বীপ, টেকনাফ ও কঙ্বাজারের জলজীবীরা 'ফুল' নামে চেনে। রশিদের হোটেল প্রাঙ্গণে সন্ধ্যারাতে কাজ করতে করতে তাদের ফুলের গল্প শুনি। কত কত ফুল তারা কেটে আনত সেই ছোটবেলা থেকে, সেসব গল্প। রশিদ ভাই আমাদের ভালো পান। তার বক্তব্য, দ্বীপের চারপাশ থেকে এসব ফুল তারা এত সংখ্যায় তুলেছেন যে, বলে শেষ করা যাবে না। ওনার ভাষায়, এখন আমরা যখন এসবের ছবিটবি তুলে টিভি-পত্রিকায় দেখিয়ে এসবের সংরক্ষণের কথা বলি, ওনার ভালো লাগে। উনি বলেন, কেউ তো আগে বলেনি যে, এসব তোলা যাবে না। অথবা না তুলেও তো চলত না তখন। বড় নৌকা বা ইঞ্জিনচালিত নৌকায় যাদের অন্তত অগভীর সাগরেও মাছ ধরতে যাওয়ার সামর্থ্য ছিল না, তারা এসব প্রবাল তুলে টেকনাফ-কঙ্বাজারে বিক্রি করে রোজগার করত। অবশ্য এখন আর প্রবাল তুলে রোজগার করার অবস্থা নেই। একদিকে তাদের এ 'ফুলের বন' একদম উজাড় হয়ে গেছে দ্বীপের চারপাশ থেকে। সাগরে কাছে-দূরে কোথাও এমন গভীরতায় প্রবাল আর থাকছে না, যেখানে দম বন্ধ করে ডুব মেরে কেটে আনা চলে। অন্যদিকে যেটুকু আছে সৈকতঘেঁষে, সেখান থেকে তুলে বিক্রি করা কিছুটা কষ্টকর। কারণ দেড় দশক আগে দ্বীপটিকে পরিবেশগতভাবে সঙ্কটাপন্ন এলাকা বলে সরকার স্বীকার করে নেয়ার পর থেকে এখানে নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড কিছুটা কড়াকড়ি করে। প্রবাল কেটে তার নরম অংশ ছাড়িয়ে কঙ্কালটা এসিডে ডুবিয়ে সাদা করে পরে বিক্রি করতে হতো। এখন এ প্রক্রিয়া শেষ করা অসম্ভব প্রতিবেশী, কাজেই নৌবাহিনী বা কোস্টগার্ডের নজর এড়িয়ে। প্রবাল, শামুক, ঝিনুক ইত্যাদি এখন প্রকাশ্যে বিক্রি করা না গেলেও বিকল্প জীবিকাও হয়নি। পর্যটনের নামে যা হয়েছে, তাতেও উল্লেখ করার মতো ভরসা মেলেনি জীবিকায়, উল্টো স্থানীয় প্রাণসম্পদের যারপর আর নাই ধরনের ক্ষতি করেছে_ যার প্রভাব পড়ছে সার্বিক জাতীয় অর্থনীতিতে। ৭১০ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূল রেখার ভেতরে উত্তরে ও কোথাও পূর্বে ভেতরে ৪০ মাইল পর্যন্ত সরাসরি উপকূলীয় এলাকা বলা চলে। এর বাইরে বৃহত্তর বরিশাল, ফরিদপুর, চাঁদপুর, কুমিল্লা ও নোয়াখালীও মেঘনা-মোহনা এলাকার সক্রিয় বদ্বীপসুলভ বৈশিষ্ট্যে প্রভাবিত। এ বিরাট উপকূলীয় অঞ্চলের সমৃদ্ধি সরাসরি সামুদ্রিক সম্পদের প্রাচুর্য বা ধ্বংসের সঙ্গে সম্পৃক্ত। প্রাণসম্পদে ভরপুর এমনসব দ্বীপ, সনি্নহিত সাগর এবং উপকূল রেখাজুড়ে স্থানীয় অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধির বাড়বাড়ন্ত হওয়ার কথা। কারণ সমুদ্র যে প্রাকৃতিক ও পরিবেশগত সম্পদ দিতে পারে, তার তুলনা মিলবে না কোনো ভূবেষ্টিত দেশে। বিশ্বে প্রাণ ধারণের উপযোগী যে পরিমাণ জায়গা আছে, তার ৯৭ শতাংশই এ মহাসাগরে। শুধু বিপুল প্রাণের বসতিই নয়, বৈচিত্র্যেও অনন্য এ জলরাশি। পৃথিবীর এ মহাসাগর বিপুল প্রাণবৈচিত্র্যের আধার। গ্রীষ্মম-লীয় বনাঞ্চল, যেমন মহাবন আমাজনের প্রাণবৈচিত্র্যের সমাহারে দীর্ঘকাল ধরে অভিভূত হয় মানুষ। কিন্তু এমন প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর বনের চেয়ে অনেক বেশি বৈচিত্র্য প্রাণের বসতি এখনও সাগরতলেই। নানা ধরনের প্রাণ, প্রাণী ও উদ্ভিদের এত অপরূপ জগৎ, অথচ প্রায় পুরোটাই অচেনা। ওয়ার্ল্ড রেজিস্টার ফর মেরিন স্পেসিসের মতে, সাগরের প্রাণবৈচিত্র্যের তিন-চতুর্থাংশ সম্পর্কেও মানুষের তেমন জানাশোনা নেই। অন্যদিকে স্থলভাগে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর জীববৈচিত্র্য কেমন হবে, তা-ও নির্ভর করে এ বিপুল জলরাশির ওপর। পৃথিবীর এ মহাসমুদ্র প্রকৃত অর্থে অখ- এক জলরাশিই। তবু এর রয়েছে নানা স্থানীয় ডাকনাম। বাংলাদেশের যেমন বঙ্গোপসাগর। বিশ্বের বৃহত্তম উপসাগর এ বঙ্গোপসাগর। ২১ লাখ ৭২ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তন এর। বাংলাদেশের মানুষের জীবনমান কেমন হবে, অন্যান্য প্রাণী ও উদ্ভিদ কেমন থাকবে, তা অনেকাংশেই বঙ্গোপসাগরের ওপর নির্ভর করে। কারণ দেশে বৃষ্টির পরিমাণ ও ধরন, আবহাওয়া, অর্থনৈতিক কর্মকা-ের সাফল্য অনেকাংশেই সাগরনির্ভর। বৃষ্টিপাতের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কৃষি, বন ও পরিবেশের সমৃদ্ধি ও সুস্বাস্থ্য। এ সাগরের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক রাখতে পারলে, আধুনিক প্রযুক্তি সরবরাহ ও প্রশিক্ষিত করে জলজীবীদের তাদের পেশায় উৎকর্ষ সাধন করতে পারলে এখানে আর্থসামাজিক উন্নতি দ্রুত ঘটতে পারত। কিন্তু এসব প্রচেষ্টার অনুপস্থিতিতে ঘটেছে তার উল্টোটা_ উপকূলীয় অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে, উপকূলীয় এলাকা থেকে অবৈধভাবে অভিবাসী হওয়ার ধারা কার্যত ঠেকানো যাচ্ছে না, বাইরে যে পরিসংখ্যানই দেখানো হোক না কেন। উপকূলীয় বনাঞ্চলের থেকে সম্পদ আহরণে টেকসই ব্যবস্থাপনা চালু না থাকা, স্থানীয়দের নেতৃত্বে রেখে ব্যবস্থাপনা চালু করার বদলে নির্বিচার আহরণের ফলে একদিকে স্থানীয় অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে, অন্যদিকে সাগরে মাছের মতো অন্যান্য সম্পদের বসবাসস্থল হুমকিতে পড়েছে। বঙ্গোপসাগরে বড় ট্রলারে মাছ ধরার শুরুর পর থেকে মৎস্য সম্পদের তুলনায় ট্রলার বেড়েছে, আবার কমেছেও_ যেমনটি আমরা দেখেছি ছোটবেলায়, আমার জন্ম দ্বীপজেলা ভোলায়। ভোলা জেলার 'সংস্কৃতিমনা' লোকজন নিজেদের দ্বীপকে নানা উপলক্ষে 'সাগরকন্যা' নামে ডাকে। আমাদের প্রাইমারি স্কুল, কলেজ কিংবা জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে নানা অনুষ্ঠানে তা-ই শুনেছি। বলা হতো এভাবে, 'তেঁতুলিয়া-মেঘনার মোহনাবিধৌত দ্বীপজেলা সাগরকন্যা ভোলা' ইত্যাদি। তবে জননী সমুদ্রের সঙ্গে দ্বীপবাসীর খুব মমতার সম্পর্ক দেখেছি বলে মনে পড়ে না, কিছুটা সংস্কার, কিছুটা ভয় ও শঙ্কার সম্পর্কই দেখা গেছে। হাইস্কুলে উঠলে সমুদ্র মানে মেঘনা-মোহনা দর্শনের সুযোগ মিলত। শীত মৌসুমে স্কুল থেকে 'বনভোজনে' যাওয়া হতো জেলার যথাসম্ভব দক্ষিণে সমুদ্রের কাছাকাছি। অনেক মা-বাবাই শিশুদের এমন ভ্রমণের অনুমতি দিতেন না। তেঁতুলিয়া নদীর কাছেই আমাদের বাড়ি ছিল। উঠানের ৪০ গজ পেরোলেই টইটুম্বর খাল। খালপাড়ের রাস্তা ধরে মিনিট দশেক হাঁটলে তেঁতুলিয়া। সারা বছর খালে বাঁধা থাকত মাছ ধরার ইয়া বড় সমুদ্রগামী ট্রলার। কেউ দুই খ্যাপের মাঝখানে বিরতিতে আছে, কেউবা সমুদ্রযাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছে। জেলে, সুকানি, ইঞ্জিন মিস্ত্রি, রাঁধুনি, মজুর_ সব মিলে ১৫ থেকে ১৬ জনের মাসখানেকের বা তারও বেশি সময়ের রসদপাতি নিয়ে যাত্রা। জেলেদের মুখে শুনতাম, আরও দক্ষিণে নানা ঘাটে নিয়মিত বিরতিতে ফিরত তারা সমুদ্র থেকে। সেখানেই মাছের বিক্রিবাট্টা। জেলেরা বিশ্রাম নেয়ার মতো যথেষ্ট ক্লান্ত হলে আবার ফিরতেন।তাদের পরিবার-পরিজন বরাবরই উৎকণ্ঠায় থাকত। তাদের স্মৃতিতে তো ছিল, কত নিকটজন সাগরে ঝড়ঝঞ্ঝায় হারিয়েছে। আবহাওয়ার খবর পেতে সামান্য ট্রানজিস্টরও অনেকের ছিল না। এর পর দিন যত গড়াল, চোখের সামনে থেকে সেই গঙ্গাপুর খাল ট্রলারশূন্য হয়ে যেতে থাকল। মহাজনরা বলেন, ব্যবসা ভালো না। জেলেরা বলেন, আগের মতো মাছ আর পাওয়া যায় না। জেলার ওই উত্তর প্রান্ত থেকে ট্রলার চালিয়ে সাগরে গিয়ে মাছ ধরে সময়-শ্রম-বিনিয়োগের তুলনায় লাভের হিসাব আর ঠিক থাকছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশে বাড়ি ছাড়ার আগে দেখে এসেছি সমুদ্রগামী মাছ ধরা ট্রলার ওই লোকালয়ে আর একটিও নেই। সাগরকন্যা ভোলায় জন্ম নিয়েও সাগরের সঙ্গে সম্পর্কের একটিমাত্র উপায় ছিল আমাদের সেই ট্রলার আর জেলে-মাঝিদের। সামুদ্রিক মাছও ছিল। তবে নদী বা বড় জোর নদী-মোহনার চেয়ে আরও দক্ষিণে ধরা ইলিশ ভোলার লোকজন খায় না। এমনকি মেঘনার ইলিশের চেয়ে তেঁতুলিয়ার ইলিশের সমাদর বেশি। কারণ তেঁতুলিয়ার জলে লবণ কম। আর সামুদ্রিক অন্যান্য মাছের প্রতিও অবহেলা ছিল, তখন দেখেছি। গরিবরা সামুদ্রিক লোনা স্বাদের মাছ খায়, অবস্থাপন্ন পরিবারে যা বর্জনীয় ছিল। তো উপকূলীয় আর্থসামাজিক অবস্থার মধ্যে সাগরের প্রত্যক্ষ সম্পর্কের এ নূ্যনতম অবস্থার অভিজ্ঞতা নিয়েই উপকূল ছেড়েছিলাম। পরে সুন্দরবন থেকে শুরু করে টেকনাফ পর্যন্ত এলাকাগুলোয় যত গেছি, উপকূলীয় অর্থনীতির মন্দাবস্থা ও নেতিবাচক রূপান্তরই চোখে পড়েছে। সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের তুলনামূলক পরিমাণও আমাদের কমেছে। ২০১১-১২ সালে মোট সামুদ্রিক মৎস্য উৎপাদন ছিল মাত্র ৫ লাখ ৭৮ হাজার টন। একই সময়ে অভ্যন্তরীণ চাষ করা মাছের উৎপাদন ছিল ১৭ লাখ ২৬ হাজার টন। সমুদ্র উপকূলের দেশে, নদীমাতৃক দেশে এ পরিসংখ্যান লজ্জার। গভীর সাগরে না হোক, অগভীর সাগরের দ্বীপগুলো ঘিরে প্রাণসম্পদের ব্যবস্থাপনায় মনোযোগী হলেও চিত্র ভিন্ন হতে পারত। ছোট-বড় ৭৫টি দ্বীপ রয়েছে আমাদের। এর মধ্যে সেন্টমার্টিনস দ্বীপ তার আপন বৈশিষ্ট্যে অনন্য। এ দ্বীপটি ঘিরে সমুদ্রে প্রবাল বসতি রয়েছে, প্রবালভিত্তিক এ জলজ বসতিটির আয়তনও অনেক বড়। সামুদ্রিক পরিবেশ সংরক্ষণবাদী উদ্যোগ 'সেভ আওয়ার সি'র তরফে সাগরে স্কুবা ডাইভিং ও জলের তলদেশের ফটোগ্রাফি ও ভিডিওগ্রাফি-প্রধান অনুসন্ধানে এযাবৎ দ্বীপের ৩ দিকে ৩০ কিলোমিটারের মধ্যে প্রচুর প্রবাল দেখেছি আমরা। ওখানে কমপক্ষে ৬৫টি প্রজাতির প্রবাল ও ৪৬টি প্রজাতির শৈবাল শনাক্ত করা গেছে। সামুদ্রিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এবং মৎস্য সম্পদের বৃদ্ধির পেছনে প্রবালভিত্তিক বসতিগুলোর ভূমিকা তুলনাহীন। কিন্তু গত দুই মৌসুমে দ্বীপটি ঘিরে দক্ষিণ-পশ্চিম ও উত্তরে প্রায় ৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত সাগরতলে অভিযান চালিয়ে দেখা গেছে জলের তলদেশে প্রাণ ও প্রকৃতির বিপন্ন অবস্থা। এভাবে জলজ বাস্তুসংস্থানগুলো হুমকিতে থাকার সঙ্গে উপকূলীয় অর্থনীতির মন্দাবস্থার সম্পর্ক রয়েছে। এর পেছনে কারণ হিসেবে আমরা ধারণা করি, উপকূলীয় প্রাণসম্পদ ও প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর স্থানীয়দের নিয়ন্ত্রণ না থাকা। এ বিরাট-বিস্তৃত এলাকার জনসংখ্যাকেই যদি ওখানে পরিবেশ সুরক্ষার কথা বলে দূরে রাখা হয়, তবে অস্থানীয় ও অনভিজ্ঞদের পক্ষে কি সম্ভব! এদের অর্থনৈতিক অবস্থা যদি শোচনীয় হয়, তবে তা শেষ পর্যন্ত জাতীয় অর্থনীতিকেই ফোকলা করে। যেখানে এদের সমৃদ্ধ স্থানীয় অর্থনীতি থাকার কথা, সেখানে দেখা যায় রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি, সহায়তা ও উন্নয়ন সাহায্য নির্ভর হতে হয় তাদের। এই যেমন সেন্টমার্টিনসকে পরিবেশগতভাবে সঙ্কটাপন্ন এলাকা বলে ঘোষণা করার পরে কী হলো? স্থানীয় দরিদ্র জনগোষ্ঠী, যারা নিজেরা দুই বেলা খাওয়ার জন্য প্রবাল তুলে আনত, তাদের জীবিকা বন্ধ হলো। কিন্তু এখনও ঠিকই কঙ্বাজারে পর্যটকদের জন্য সাজানো দোকানে প্রবাল-কঙ্কালের পসরা পাওয়া যায়। পরিবেশবিধ্বংসী ব্যবসাটা ঠিকই চলছে প্রভাবশালীদের মাধ্যমে, জনচক্ষুর আড়ালে। যদি স্থানীয়দেরই ওই প্রবালবসতি রক্ষার দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব দিয়ে ব্যবস্থা সাজানো হতো, তবে তারা প্রবাল সুরক্ষা করার পাশাপাশি ওখানে সামুদ্রিক শৈবাল আহরণ, দরকার হলে আরও চাষ করে আর্থসামাজিক উন্নতি করতে পারত। এরপর 'ইকো-ট্যুরিজমের নাম করে সরকারি প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের আর ১০টা পর্যটন স্থানের মতোই হোটেল-মোটেল-রেস্তোরাঁ করে ভরে ফেলা হলো; দ্বীপমুখী পর্যটন জাহাজ চালু করা হলো_ যার কোনোটাতেই স্থানীয়দের কোনো অংশগ্রহণ ছিল না। দালালদের মাধ্যমে কোনো রকমে জমি বিক্রি করে শহরে অভিবাসী হতে লাগল স্থানীয়রা। বাধ্য হয়েও বেচতে হয়েছে অনেক ক্ষেত্রে। যেখানে আগে বিরল সামুদ্রিক কচ্ছপের ডিম পাড়ার জায়গা ছিল, সেখানেই পাথর তুলে ঘেরা দিয়ে পর্যটকের চেয়ার বসাল হোটেল মালিকরা। যেখানে দুটো মাছ ধরে জীবিকা চালাত স্থানীয়রা, সেখানে বড় জাহাজগুলোর প্রপেলারে উঠে আসা পলিতে প্রবাল-বসতি নির্বংশ, মাছও উধাও। স্থানীয়রা পরিণত হলো হোটেল-মোটেলের মুটে-মজুরে। এরই মধ্যে যে বিরল দু-একজন স্থানীয় মানুষ এ পর্যটন ব্যবসায় জায়গা তৈরি করে নিতে পেরেছিলেন, তাদের একজন রশিদ ভাইয়ের বিবরণ দিয়েই লেখা শুরু করেছিলাম। রশিদ একজন ব্যতিক্রমমাত্র, উদাহরণ নন। এ ব্যতিক্রম উদ্যোক্তা হয়তো এককালের প্রবাল-কাঠুরে থেকে এখন হোটেল ব্যবসায়ী হিসেবে জীবিকা গড়ে নিতে পেরেছেন। এককালে প্রবাল কেটেছেন বলে এখন আফসোস করলেও এখনও প্রবালবসতি রক্ষায় তেমন কিছু করার নেই তার। তাকেও আর ১০জন পরিবেশবিধ্বংসী পর্যটন ব্যবসায়ীর মতোই ব্যবসা চালাতে হচ্ছে। কারণ যেভাবে এমন একটা দ্বীপের স্থানীয় প্রাণসম্পদ, জনগোষ্ঠী ও সাংষ্কৃতিক উপাদান ব্যবহার করে এগুলো টিকিয়ে রেখে পর্যটকদের সেবা ও পণ্য সরবরাহ করা যায়, সেভাবে এখানে কোনো পরিকাঠামো তৈরি করা হয়নি। বাংলাদেশে চাষের মাছের তুলনায় সামুদ্রিক বা অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ের মাছের কম আহরণ যে লজ্জার, সে কথা বলছিলাম শুরুতে একবার। আন্তর্জাতিক জলসীমায় মাছ ধরার সুযোগ বাদ দিলও নিজস্ব অর্থনৈতিক সমুদ্রসীমাই দেশের আয়তনের দেড় গুণ ছিল সর্বশেষ পরিসংখ্যানে (ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সালিশির রায়ের আগে), ১ লাখ ৬৬ হাজার বর্গকিলোমিটার। অথচ দেশে সামুদ্রিক মাছ উৎপাদনের চেয়ে ভেতরে চাষের মাছের পরিমাণ তিন গুণেরও বেশি। বিশ্বে চাষ করা মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ পঞ্চম। অন্যদিকে দেখুন, গত বছর দেশে কৃষিতে ৪০ লাখ ৪৯ হাজার টন রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হয়েছে। পলল ভূমির মধ্যে শিরা-উপশিরার মতো বয়ে যাওয়া নদনদীর মাঝপথে জীবনবিনাশী বাঁধ চালু থাকতে দিয়েছি আমরা। নদী স্বাভাবিক থাকলে এখানে কৃষিতে ভূগর্ভস্থ পানি দরকার হওয়ার কথা নয়। পলল ভূমিতে পুষ্টি স্বাভাবিক থাকলে রাসায়নিক বিষও লাগার কথা নয়। সঠিকভাবে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলভাগ ও সামুদ্রিক উৎস থেকে মৎস্য আহরণ করলে 'আধুনিক' মৎস্য খামার করে পানীয় জলের উৎস, কৃষিজমি ও বনাঞ্চল নষ্ট এবং স্থানীয় জাতের মাছ নির্বংশ করার দরকার হয় না। কিন্তু নদীর স্বাস্থ্যরক্ষা না করে বিপরীতে নির্বিচার গভীর নলকূপ বসিয়ে আর্সেনিকের বিষ উঠিয়ে এনেছি উপরে; জ্বালানি তেল ব্যবহার করে সেচকাজ পর্যন্ত চালাতে হচ্ছে বাংলাদেশের কৃষিতে। কথিত 'আধুনিক' কৃষি ও মৎস্য চাষের নাম করে রাসায়নিক সার ও বিষে সয়লাব করে দিয়েছি জলজ পরিবেশ। অভ্যন্তরীণ গ্রোতের পানি পানের অযোগ্য করে তুলেছি_ যে বিষ নদীপথ হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সাগরেও। এ প্রক্রিয়ার প্রভাব সর্ববিনাশী। পানীয়জলের সঙ্কট, জলজ পরিবেশের দূষণের ফলে স্বাস্থ্যহানি, খাদ্যশস্য ও মাছে বিষ, ম্যানগ্রোভসহ বনাঞ্চল উজাড়, নৌপরিবহনে অচলাবস্থা_ এসব ক্ষতির অর্থনৈতিক মূল্যায়ন করা হলে তার আকার কত বিশাল হবে, অনুমান করা যায়! এ সঙ্কটের সাক্ষী হয়ে থাকছে বঙ্গোপসাগর। জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে, অভ্যন্তরীণ জলদূষণ থেকে এবং রাসায়নিক সারের বিষ থেকে চুইয়ে নামা অবশিষ্টাংশ সাগরকে বাসের অযোগ্য করে তুলছে, যার সাক্ষী প্রচুর শৈবাল। শৈবালের আধিক্যের কারণে উপকূলীয় মহাদেশীয় ঢাল এলাকায় সাগরতলে অঙ্েিজন ঘাটতি হচ্ছে। বড় বড় এলাকা নানা প্রজাতির বাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে। অভ্যন্তরে জল, কৃষি ও মৎস্য দূষণ বন্ধ করে যদি পরিবেশবান্ধব ও টেকসই পরিকল্পনা নেয়া হয়, তবে এ চক্রের সর্ববিনাশী ক্ষতিকর প্রভাব বন্ধই শুধু নয়, জলবায়ু পরিবর্তন রোধে নিজের ধারাবাহিক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে বঙ্গোপসাগর। মোহাম্মদ আরজু, arju@saveoursea.social

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়