Thursday, May 16

ধামইরহাটে পর্যটন শিল্পের নতুন সম্ভাবনা আলতাদিঘি

ধামইরহাট (নওগাঁ) : নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলার একটি দিঘিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে সুবিশাল বনভূমি। রকমারি বৃক্ষরাজিতে যেন সবুজের বিস্তৃত ক্যানভাস। দিঘি দেখে যতটা না অবাক হবেন, তার চেয়ে বেশি চমৎকৃত হবেন দিঘির জন্মকালের ইতিহাস শুনে। আমাদের রূপকথা ও লোকসাহিত্যের এ যেন রূপালি আখ্যান। রূপকথার সে গল্পের হয়তো কোন সত্যতা খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু দিঘি ও দিঘি সংলগ্ন সবুজ উদ্যান দেখে অনেকেই তা অস্বীকার করতেও পারবেন না। যেমনটি পারেননি ধামইরহাটের রমজান আলী। পেশায় শিক্ষক। দিঘি ও উদ্যান নিয়ে স্থানীয় লোকমুখে যে গল্প ছড়িয়ে আছে, তা তিনি কিছুতেই অস্বীকার করতে পারেন না। পুরনো আমলের গুজব কিংবা সেকেলে কুসংস্কার হিসাবে উড়িয়েও দেন না। প্রাচীন রূপকথার ঐতিহ্য বুকে ধারণ করে অবস্থিত এই উদ্যানটি জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে বিশেষ ভূমিকা রাখবে বলে জানিয়েছেন পরিবেশবিদরা। এ জন্য প্রয়োজন উদ্যানের যথাযথ সংস্কার, উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন। নওগাঁ জেলার ধামইরহাটে অবস্থিত আলতাদিঘি জাতীয় উদ্যান নামক এই উদ্যানটি বৃক্ষসম্পদ ও বন্য প্রাণী সংরক্ষণ।  পর্যটন সুবিধার উন্নয়নে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় ২০১১ সালে জাতীয় উদ্যান হিসাবে ঘোষণা করেছে। চারিদিকে সবুজে ঘেরা শালবন এবং বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদে পরিপূর্ণ ২৬৪.১২ হেক্টর জমির বনভ’মি নিয়ে গড়ে উঠেছে আলতাদিঘি জাতীয় উদ্যান। পুরো উদ্যঅনজুড়ে ছড়িয়ে আছে নানা ধরনের গাছ। ঔষধি, ফলদ ও বনজ-এসব বৃক্ষের ঔষধিগুনাগুনের পাশাপাশি রয়েছে আর্থিক মূল্য।
উদ্যানের মাঝখানে রয়েছে ৪২.৮১একর আয়োতনের এক বিশাল দিঘি, যা আলতাদিঘি নামে পরিচিত। আলতাদিঘির দৈর্ঘ্য ১.২০ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ০.২০ কিলোমিটার। এই দিঘির কারণেই উদ্যানটির নাম হয়েছে  আলতাদিঘি জাতীয় উদ্যান। কথিত আছে আনুমানিক ১৪০০ সালে প্রায় ৭০০ বছর আগে এ অঞ্চলে রাজা বিশ্বনাথ জগদল রাজত্ব করতেন। আবহমান কাল থেকেই রুক্ষ এই বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির অভাব ছিল এবং রাজা বিশ্বনাথের রাজত্বকালে এই পানির অভাব প্রকট রূপ ধারণ করে। সুপেয় পানির অভাবে তখন মানুষের প্রাণ যায়যায় অবস্থা। মাঠ ঘাট শুকিয়ে চৌচির। আবাদি জমিতে ফসর ফলানোও অসম্ভব হয়ে যায় পানির অভাবে। একদিন রানি স্বপ্নে দেখলেন, পানি সমস্যা সমাধানে এলাকায় একটি দিঘি খনন করতে হবে। সে অনুযায়ী রানি রাজাকে বললেনতিনি পায়ে হেঁটে যাবেন, যতক্ষণ পর্যন্ত না পা ফেটে রক্ত বের হবে ততক্ষণ তিনি হাঁটতে থাকবেন এবং যেখানে গিয়ে পা ফেটে রক্ত বের হবে ততদুর পর্যন্ত একটি দিঘি খনন করে দিতে হবে। পাইক পেয়াদা, লোক লস্করসহ হাঁটা শুরু করলেন। অনেক দুর হাঁটার পর রানি যখন থামছিলেন না, তখন পাইক পেয়াদারা ভাবলেন এত রড় দিঘি খনন করা রাজার পক্ষে সম্ভব হবে না, সে কারণে রানির পায়ে আলতা ঢেলে দিয়ে চিৎকার করে বললেন রানিমা আপনার পা ফেটে রক্ত বের হচ্ছে। একথা শুনে রানি সেখানেই বসে পড়লেন। রাজা বিশ্বনাথ ওই স্থান পর্যন্ত একটি দিঘি খনন করে দিলেন। এরপর অলৌকিকভাবে মুহূর্তেই বিশুদ্ধ পানিতে ভরে ওঠে দিঘি। রানির পায়ে আলতা ঢেলে দেওয়ার প্রেক্ষিতে দিঘিটির নামকরণ করা হয় আলতাদিঘি। রাজশাহী সামাজিক বন বিভাগের অধীনে নওগাঁ জেলার ধামইরহাটে আলতাদিঘি জাতীয় উদ্যান অবস্থিত। রাজশাহী, নওগাঁ, জয়পুরহাট ও বগুড়া চার জেলার সঙ্গেই উদ্যানটির সড়ক পথে যোগাযোগ রয়েছে। ফলে প্রকৃতিপ্রেমী মানুষের একটি পছন্দের জায়গা এই উদ্যানটি। আলতাদিঘি জাতীয় উদ্যানের ২৬৪.১২ হেক্টর আয়তনের বনভূমির মধ্যে ১৩১.৫৭ হেক্টর সংরক্ষিত বন, ৩৫.৪৯ হেক্টর রক্ষিত বন এবং ৯৭.০৬ হেক্টর অর্জিত বন। জীববৈচিত্র্য রক্ষা, পরিবেশের উন্নয়ন এবং পর্যটকদের আকর্ষিত করার লক্ষ্যে শিগগিরই আলতাদিঘি জাতীয় উদ্যানের উন্নয়নের কাজ হাতে নেওয়া হবে বলে বন বিভাগ সুত্রে জানা গেছে। ‘স্ট্রেদেনিং রিজিওনাল কোঅপারেশন ফর ওয়াইল্ড লাইফ প্রটেকশন’ প্রকল্পের অধীনে বিশ্বব্যাংক এ জন্য অর্থিক সহায়তা দেবে।
সামাজিক বন বিভাগ, রাজশাহী বিভাগীয় বন কর্মকর্তা অজিত কুমার রুদ্র জানিয়েছেন, এ ব্যাপারে তিন কোটি ৫১ লাখ ৭৬ হাজার টাকার একটি উন্নয়ন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে চুড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। উন্নয়ন পরিকল্পনা অনুযায়ী একটি বন্য প্রাণী উদ্ধার ও বন্য প্রাণী রক্ষার্থে একটি পশু চিকিৎসা কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। বন্য প্রাণী ও উদ্যান তদারকির জন্য নির্মিত হবে চারটি অবজারভেশন টাওয়ার। পর্যটকদের সুবিধার্থে ১০টি সাইনবোর্ড, একটি গাইড ম্যাপ, চারটি ছাতা শেড, ১০টি কাঠের তৈরি বসার বেঞ্চ নির্মাণ, একটি পাড়ি পার্কিং এলাকা নির্মাণ এবং ১০টি আরসিসি বসার বেঞ্চ নির্মাণ করা হবে। এ ছাড়া দুটি সিসি ওয়াকিং ট্রেইল নির্মাণ, আটটি এসএফএনটিসি উন্নয়ন, একটি ওয়াশ রুমনির্মাণ, দুটি গোলঘর নির্মাণ এবং ১০ হেক্টর জমিতে পশু-পাখির খাওয়ার উপয়োগী বাগান তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। উদ্যানের পরিধি বাড়াতে পাঁচ হাজার দূর্লভ প্রজাতির চারা রোপণ, পুকুর-জলাধার পুনঃখনন ও উন্নয়ন, ২.৫ কিলোমিটার এইচ বিবি রাস্তা নির্মাণ এবং বন্য প্রাণী সংরক্ষণে সচেতনতা বৃদ্ধিসংক্রান্ত প্রশিক্ষণ প্রদানের কর্মসূচীও উন্নয়ন পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। প্রকল্প পরিচালক এবং সামাজিক বন সার্কেল বগুড়ার বন সংরক্ষক ফারুক হোসাইন জানিয়েছেণ, আলতাদিঘি জাতীয় উদ্যানের উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে শাল বনের উন্নয়ন হবে, জীববৈচিত্র্য বাড়বে, প্রাকৃতিক পরিবেশের উন্নয়ন ঘটার সঙ্গে সঙ্গে বন্য প্রাণী সংরক্ষণ সম্ভব হবে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে আলতাদিঘি জাতীয় উদ্যান একটি আদর্শ বিনোদন কেন্দ্রে পরিণত হবে। আলতাদিঘি জাতীয় উদ্যানের উন্নয়ন কর্মসূচী দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী। উন্নয়ন কর্মসূচী বাস্তবায়িত হলে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, বৃক্ষসম্পদ ও বন্য প্রাণী সংরক্ষণ এবং পর্যটন সুবিধার উন্নয়নের পাশাপাশি স্থানীয় জনগণের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার উন্নতি ঘটবে। (
আব্দুল্লাহ হেল বাকী,ডিনিউজ)

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়