Friday, May 31

কেসিসি মেয়র নির্বাচনে চার ইস্যু

খুলনা: খুলনা সিটি করপোরেশনে (কেসিসি) কে মেয়র নির্বাচিত হবেন তা চারটি ইস্যুর ওপর নির্ভর করছে। শ্রমিক, তরুণ প্রজন্ম, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীর ভোট ব্যাংকই প্রার্থীদের জয়-পরাজয়ের প্যারামিটার। প্রায় দুই লাখ নির্ধারিত ভোট কে কতটা টানতে পারেন এখন তাই দেখার অপেক্ষায় খুলনাবাসী। স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে কাজ করা একাধিক নাগরিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই চারটি ফ্যাক্টরই কেসিসি নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেসিসি নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী তিনজন হলেও মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থী তালুকদার আব্দুল খালেক ও বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী মনিরুজ্জামান মনির মধ্যে। জাতীয় পার্টি সমর্থিত অপর মেয়র প্রার্থী কফিকুল ইসলাম মধু সম্মানজনক ভোট আদায়ের চেষ্টা করছেন।
নাগরিক বিশ্লেষকদের ধারণা, এবার নির্বাচনে ক্রমিকদের ভোট সবচাইতে বড় ফ্যাক্টর। নগরীর খালিশপুর ও রূপসা শিল্প এলাকায় ৫০ হাজারেরও বেশি ভোট আছে এ পেশাজীবী শ্রেণীর। বিএনপি আমলে বন্ধ করা পিপলস জুট মিল (খালিশপুর নামকরণ করে) এবং দৌলতপুর জুট মিল চালু করায় এ দুটি মিলের ভোটাররা আওয়ামী লীগের প্রতি খুশি। তবে পাশাপাশি রাষ্ট্রায়াত্ব অন্য মিলগুলোর মতো সুযোগ-সুবিধা না পাওয়ায় তাদের মনে চাপা ক্ষোভ আছে। এসব মিলের কমিকদের দাবি যে প্রার্থী তাদের বৈষম্য দূর করার প্রতিশ্র“তি দেবেন তারা তার পক্ষে কাজ করবেন।
এছাড়া ঘোষণা দিয়ে চালু করতে না পারা খালিশপুরের নিউজপ্রিন্ট মিল ও রূপসার দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরির ক্রমিকরা রয়েছে ক্ষুব্ধ। সেই সঙ্গে চালু প্রতিষ্ঠান খুলনা হার্ডবোর্ড মিল বন্ধ হয়ে গেছে। সেখানেও কমিক অসন্তোষ আছে। এসব শ্রমিকের সেন্টিমেন্ট যে প্রার্থী কাছে টানতে পারবে তার দিকেই ঝুঁকবে তারা।
শ্রমিকদের ভোট পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী সদ্যবিদায়ী মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক। তিনি বলেন, বিএনপির বন্ধ করা মিল আমরা চালু করেছি। আমি আশাবাদী সেই কৃতজ্ঞতাবোধের জায়গা থেকে ভোটাররা আমাকে বিমুখ করবে না। সরকার শিগগির সব আইনগত জটিলতা কাটিয়ে দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরি চালু করবে। এ জন্য আমি দৃঢ় আশাবাদী শ্রমিক শ্রেণীর ভোট তালা প্রতীকে পড়বে।
অনুরূপ আশাবাদী সাবেক ভারপ্রাপ্ত মেয়র মনিরুজ্জামান মনি। তিনি বলেন, সরকার প্রতিশ্র“তি দিয়েও চালু করতে পারেনি নিউজপ্রিন্ট মিল ও দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরি। নতুন করে বন্ধ হয়েছে খুলনা হার্ডবোর্ড মিল। যে দুটি মিল চালু হয়েছে সেখানে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা কমিকরা পাচ্ছে না। জিনিস-পত্রের দাম আকাশচুম্বি হওয়ায় অভাব-অনাটনে আছে তারা। তাদের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে তারা পরিবর্তন চায়। আমি বিশ্বাস করি তাদের ভোট আনারস প্রতীকে পড়বে।
তরুণদের ভোট পেতে খালেক-মনির যত কৌশল: তরুণ প্রজন্মের ভোট খুলনা সিটি করপোরেশন (কেসিসি) নির্বাচনে বড় ফ্যাক্টর। মেয়র প্রার্থীর জয়-পরাজয় নির্ধারণে নতুন ভোটাররাই ব্যবধান গড়ে দেবে। জীবনে প্রথমবারের মতো ভোট দেয়ার জন্য উন্মুখ প্রায় অর্ধ লাখ ভোটারকে কাছে টানতে নানা কৌশল প্রয়োগ করছে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী মেয়র প্রার্থী আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থী তালুকদার আব্দুল খালেক ও বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী মনিরুজ্জামান মনি। তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জাতীয় পার্টি সমর্থিত অপর মেয়র প্রার্থী কফিকুল ইসলাম মধুও নিজেকে তরুণ হিসেবে উত্থাপন করছেন। সোজা কথা বলে বিরাগভাজন হওয়া এড়াতে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নাগরিক বিশ্লেষকদের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনায় উঠে আসে নতুন প্রজন্মের বিষয়টি।
তারা জানান, কেসিসির ৩১টি ওয়ার্ডে এবার মোট ভোটার চার লাখ ৪০ হাজার ৬৪৭ জন। এর মধ্যে দুই লাখ ২৪ হাজর ৫৩৪ জন পুরুষ এবং দুই লাখ ১৬ হাজার ১৩৩ জন মহিলা। গতবারের তুলনায় এবার ভোটার বেড়েছে ৪১ হাজার ২৬৯ জন। এই বাড়তি ভোটার হলো তরুণ প্রজন্মের। যাদের অধিকাংশই আধুনিক, রুচিশীল ও তথ্য প্রযুক্তির নির্ভর জীবনে অভ্যস্ত। এই শ্রেণী ক্ষুব্ধ তাদের জন্য নগরীতে বিনোদন কেন্দ্র, খেলাধুলা বা দম ফেলানোর মতো জায়গা না থাকায়। সেই সঙ্গে শিক্ষা কেন্দ্রে সন্ত্রাস বন্ধ ও মাদকে ভাসা নগরীবাসীকে মুক্তি দেয়ার প্রতিশ্র“তি চান তারা। আরো চান বেকারত্ব দূর করার উদ্যোগ প্রতিদ্বন্দ্বী মূল দুই প্রার্থীর মধ্যে যে তরুণদের এই উপলব্ধি ধারণ করে তা বাস্তবায়নের কথা শোনাতে পারবে তাদের অধিকাংশই তার প্রতীকে সিল মারবে।
নতুন এ ভোটরদের কাছে টানতে নানা কৌশল নিয়েছে তিন মেয়র প্রার্থী আওয়ামী লীগ সমর্থিত তালুকদার আব্দুল খালেক ও বিএনপি সমর্থিত মনিরুজ্জামান মনি ও জাতীয় পার্টি সমর্থিত কফিকুল ইসলাম মধু। তারা তুরুণদের ভোট পেতে সরাসরি তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ, অভিভাবকদের অনুরোধ ও ছাত্র-যুব সংগঠনকে কাজে লাগাচ্ছেন।
মঙ্গলবার নগরবাসীর মুখোমুখি অনুষ্ঠানে খালেক তালুকদার বলেন, “তরুণদের খেলাধুলা ও বিনোদনের জন্য আমি কাজ করছি। নগরীকে আইটিবান্ধব হিসেবে গড়ে তুলছি। সেই সঙ্গে তাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য যা যা করণীয় তা করছি। তরুণদের ভোট পাওয়ার ব্যাপারে আমি আশাবাদী। 
মনিরুজ্জামান মনি বলেন, আমি ভারপ্রাপ্ত মেয়র থাকাকালীন সময় কেসিসির ওয়েব সাইট চালু করি। নগর ভবনকে ডিজিটালাইজ করি। নতুন ভোটররা তথ্য প্রযুক্তি নির্ভর। তাদের কর্মসংস্থান, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ দিতে চাই। খুলনাকে মাদকমুক্ত করে তাদের মনন বিকাশে কাজ করবো।
শফিকুল ইসলাম মধু বলেন, তিনজন মেয়র প্রার্থীর মধ্যে আমিই তরুণ। আমি বিশ্বাস করি তরুণরা আমার প্রতি আস্থা রাখবে।
জাপা প্রার্থী ভোট কাটবে খালেকের: স্থানীয় সরকার নির্বাচন অরাজনৈতিক হলেও রাজনৈতিক উত্তাপের কমতি নেই। ভোটারা প্রার্থীদের রাজনৈতিক পরিচয়েই চেনেন। শুধুমাত্র দলীয় প্রতীকের বাইরে আলাদা মার্কায় ভোট দিতে হয়, এই যা পার্থক্য। খুলনা সিটি করপোরেশন (কেসিসি) নির্বাচনে ১৪ দলের মেয়র প্রার্থীর সঙ্গে নেই জাতীয় পার্টি। কারণ তারা আলাদা প্রার্থী দিয়েছে। তাও আবার কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম-মহাসচিব ও জেলা সভাপতি কফিকুল ইসলাম মধু। তাকে বসাতে না পেরে আওয়ামী লীগ প্রার্থী কৌশলে পিছিয়ে পড়েছে বলে মনে করেন নাগরিক বিশ্লেষকরা। তাদের ধারণা, মধু ভোট কাটবে আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থী তালুকদার আব্দুল খালেকের।
খুলনার নাগরিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এক সময় জাতীয় পার্টির হয়ে কেসিসি নির্বাচনে ৪৫ হাজার ভোট পেয়েছিলেন মরহুম এসএমএ রব। এখন জাতীয় পার্টির সেই অবস্থা নেই। রবের মতো ইমেজ মধুর না থাকলেও সম্মানজনক ভোট কাটবেন তিনি। পার্টির একাধিক কর্মী ধারণা দিয়েছেন ৩০ হাজার ভোট ব্যাংক তাদের আছে। কিন্তু এর মধ্যে কত তিনি পাবেন তা নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না। এখন মূল বিষয় হলো মধু কার ভোট কাটবেন বা তিনি যাদের ভোট পাবেন প্রার্থী না হলে ওই ভোট কে পেতেন? এর সঠিক ধারণা না পাওয়া গেলেও পার্টির নেতা-কর্মীরা মনে করেন মধু যদি খালেকের সঙ্গে নির্বাচনী কাজ করতেন তাহলে তার পক্ষেই অধিকাংশ ভোট পড়তো।
কিন্তু তিনি প্রার্থী হওয়ায় জাতীয় পার্টির একটি মুরব্বি অংশ গোপনে মনি পক্ষে কাজ করছে বলে শোনা যাচ্ছে। ওই মুরব্বি অংশটি মনে করেন মধু ভোট কাটবে খালেকের। এ অবস্থা কতটা কাটিয়ে সামনে এগুতে পারবেন খালেক তালুকদার এখন তাই দেখার অপেক্ষা নগরবাসী।
তবে তালুকদার আব্দুর খালেক মনে করেন নির্বাচনে প্রার্থী যে কেউ হতে পারেন। এটা সবার গণতান্ত্রিক অধিকার। অরাজনৈতিক নির্বাচন হওয়ায় মধু প্রার্থী হয়েছেন। মধু প্রার্থী হওয়ায় তার নিজের কোনো ক্ষতি হবে না বলে তিনি মনে করেন।
শফিকুল ইসলাম মধু বলেন, “নিজের ও দলের গ্রহণযোগ্যতা যাচাইয়ের সুযোগ পেয়েছি। ভোটের মাধ্যমে প্রমাণ হবে জাতীয় পার্টির কক্তি।
জামায়াত মনির পক্ষে আছে: খুলনা সিটি করপোরেশন (কেসিসি) নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর ভোট ব্যাংক গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। দলটি কোনো মেয়র প্রার্থী দেয়নি। তবে ১৮ দলের প্রধান বিএনপির সমর্থিত প্রার্থী মনিরুজ্জামান মনির পক্ষে তাদের প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। জামায়াত থেকে বলা হয়েছে মামলা ও সরকারের হয়রানি এড়িয়ে তারা কৌশলে মনির জন্য কাজ করছেন।
খুলনার নাগরিক বিশ্লেষকদের ধারণা জামায়াতের ভোট ব্যাংক এ নির্বাচনে বড় ফ্যাক্টর। দলটির বর্তমান কারাবন্দি নেতা অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার এক সময় মেয়র পদে নির্বাচন করে ২৮ হাজার ভোট পেয়েছিলেন। দলটির নেতা-কর্মীরা মনে করেন এখন নগরীতে তাদের ভোট কয়েক গুণ বেড়েছে। ১৮ দলে অন্যতম করিক এই দলটি এখন রাজনৈতিকভাবে কোনঠাসা। বিগত দিনে তাদের বিএনপির সঙ্গে মিলেমিশে আন্দোলন করতে দেখা গেছে। এখন মামলা ও রাজনৈতিক হয়রানির ভয়ে তারা কৌশল অবলম্বন করেছেন।
মনিরুজ্জামান মনির নির্বাচনি ইশতেহার ঘোষণার সময় জাময়াতের কেউ উপস্থিত না থাকার সাংবাদিকদের প্রশ্নের সম্মুখিন হন মনি। তখন ওই কৌশলের কথা জানানো হয়। একটি মহল থেকে বলা হয় দলটির কারাবন্দি নেতা গোলাম পরওয়ারের সিগনালের অপেক্ষায় নেতা-কর্মীরা। তবে এ ধরণের প্রচার সঠিক নয় বলে দলের দায়িত্বশীল পর্যায়ের নেতারা জানিয়েছেন।
মনিরুজ্জামান মনি বলেন, স্থানীয়ভাবে জামায়াত ও বিএনপির মধ্যে বোঝা-পড়া ভালো। তারা আনারস প্রতীকের হয়ে কাজ করছে। সব ধরনের সহযোগিতা তাদের কাছ থেকে পাচ্ছি।
খুলনা মহানগর জামায়াতে ইসলামের সহকারী সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট শাহ আলম জানান, জামায়াতে ইসলামী ১৮ দলের সঙ্গে আছে। নির্বাচনে জোটের প্রার্থীর হয়ে কাজ করছে দল। আমাদের প্রার্থী মনিরুজ্জামান মনি বিজয়ী হবে বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।(ডিনিউজ)

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়