বন্ধ হয়ে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠানগুলোকে চালু করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এজন্য সম্প্রতি ট্রাস্টের দেড়শ� কোটি টাকার ঋণ মওকুফ করা হয়েছে। পাশাপাশি প্রায় ৩শ� কোটি টাকা খরচে নিজস্ব ভূমিতে গড়ে তোলা হচ্ছে দুটি বাণিজ্যিক ভবনসহ ৪টি প্রকল্প। তবে আগের মতো অদক্ষ ব্যবস্থাপনার আদলে ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনা করলে তা আবারো লোকসানের মুখে পড়বে বলেই সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা। ফলে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবার, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, বীরশ্রেষ্ঠ পরিবারসহ দেশের প্রায় ৮ হাজার পরিবারকে দেয়া আর্থিক সুবিধা ব্যাহত হতে পারে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দরিদ্র মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের কল্যাণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২২টি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট গড়ে তোলেন। পরবর্তীতে এরশাদ সরকারের শাসনামালে ট্রাস্টে আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠান যুক্ত হয়ে প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩২। কিন্তু বর্তমানে ট্রাস্টের ৩টি প্রতিষ্ঠান বাদে বাকি ২৯টি প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশই বন্ধ ও ইজারায় রয়েছে। যদিও ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠানকে লাভজনক হিসেবে গড়ে তুলতে সরকারের নীতিগত সহায়তা ছিল। কিন্তু অব্যবস্থাপনার কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো লাভের মুখ না দেখে বরং লোকসানের বোঝা বাড়িয়ে গেছে। বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের চালু ৩টি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ঢাকার পূর্ণিমা ফিলিং অ্যান্ড সার্ভিস স্টেশন, চট্টগ্রামের ইস্টার্ণ কেমিক্যাল লিমিটেড ও ঢাকার মিমি চকোলেট লিমিটেড। এ ৩টি প্রতিষ্ঠান থেকে মাসিক গড় আয় ৩৫ লাখ টাকা।
সূত্র জানায়, লোকসানের কারণে ১৯৯০ সালে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে অবস্থিত সিরকো সোপ, ১৯৯৩ সালে গাজীপুরের ইউনাইটেড টোব্যাকো কোম্পানি, ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ গ্লাস ইন্ডাস্ট্রি (হাইসন্স), ১৯৯৫ সালে মেটাল প্যাকেজেস লিমিটেড ও পোস্তগোলার পারুমা (ইস্টার্ণ) লিমিটেড, ১৯৯৯ সালে চট্টগ্রামের নাসিরাবাদেও বাক্সলী পেইন্টস, ২০০৫ সালে কালুরঘাটের এমজেসিসি এবং ঢাকার মিরপুরের ট্রাস্ট আধুনিক হাসপাতাল বন্ধ করে দেয়া হয়। তাছাড়া ১৯৮৮ সালে চু-চিন-চৌ চায়নিজ রেস্তরাঁ, ১৯৯২ সালে বক্স রবার ইন্ডাস্ট্রিজ, রাজধানী সুপার মার্কেটের হরদেও গ্লাস ওয়ার্কস, ২০০৩ সালে ঢাকার আনিস ফিল্ম কর্পোরেশন, ফিল্ম ইকুইপমেন্ট, মডেল ইলেকট্রিক্যাল ও দুর্বার এ্যাড লোকসানের ভারে বন্ধ হয়ে যায়। সর্বশেষ ২০০৮ সালে বন্ধ হয়ে যায় ট্রাস্টের সবচেয়ে লাভজন কোমল পানীয় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান তাবানী বেভারেজ। তাছাড়া পুঁজি প্রত্যাহার করা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রামের মদিনা ট্যানারি, হামিদিয়া অয়েল, হামিদিয়া মেটাল, ঢাকার বেঙ্গল ট্যানারি, ন্যাশনাল ট্যানারি, ওমর সন্স ও যান্ত্রিক পাবলিকেশন। একইভাবে চট্টগ্রামের চট্টেশ্বরী রোডের দেলোয়ার পিকচার্স লিমিটেড লিজ দেয়া হয় ১৯৯৪ সালে। আর অব্যবহৃত পড়ে রয়েছে তেজগাঁও শিল্প এলাকার ২৫৭ নম্বর প্লট, গাজীপুরে ২টি প্লট, চট্টগ্রাম আগ্রাবাদেও ৩৬ ও ৩৭ নম্বর প্লট, নারায়ণগঞ্জের ডালপট্টি এমজেসিসি ও রাঙ্গুনিয়ার ১৫ একর জমিসহ বেশ কিছু স্থাপনা।
সূত্র আরো জানায়, বর্তমানে রাজধানী ও এর বাইরে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টেও বিপুল পরিমাণ জমিই বেদখল হয়ে আছে। অনেক ক্ষেত্রে ট্রাস্টেও জমিতে শিল্প-কারখানা গড়ে তুলেছে দখলদাররা। অথচ এসব জমি থেকে সরকার যেমন রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে, তেমনি ট্রাস্টও কোনো আয় পাচ্ছে না। তারপরও বর্তমানে অব্যবহৃত জমি ছাড়া একাধিক মার্কেট ট্রাস্টের অধীন চালু রয়েছে। তবে এক্ষেত্রে দোকান বরাদ্দ থেকে শুরু করে ভাড়া নির্ধারণ ও আদায়ে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। তাছাড়া ট্রাস্টেও বিপক্ষে বেশকিছু মামলাও রয়েছে। এর কয়েকটিতে হেওে গেছে ট্রাস্ট। মূলত তহবিল না থাকার কারণেই হেরে যাওয়া মামলাগুলো ট্রাস্ট যথাযথভাবে পরিচালনা করতে পারেনি।
এদিকে দীর্ঘদিন লোকসান টাকার পরও বন্ধ হয়নি মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টেও প্রতিষ্ঠানগুলো। কারণ প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করার আগে দায়দেনাও পরিশোধযোগ্য ছিল। মূলত অদক্ষ ব্যবস্থাপনা, সিদ্ধান্তহীনতা ও অযৌক্তিক বিভিন্ন বিষয় ট্রাস্টেও কাঁধে চাপিয়ে দেয়ার কারণে ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠানগুলোর এ করুণ হাল হয়েছে। এক্ষেত্রে ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠানগুলোতে বাঁচাতে হলে উপযুক্ত নীতিমালা প্রণয়নের বিকল্প নেই বলেই সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। তাদের মতে, মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টভুক্ত প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় নিয়োগ দিতে হবে পেশাদারী মনোভাবাপন্ন দক্ষ ব্যক্তিদের। এ মুহূর্তে ট্রাস্টের ক্ষেত্রে আর্থিক সহায়তার চেয়ে নীতিগত সহায়তাই বেশি জরুরি। কারণ ট্রাস্টের অধীন সব জমি থেকে যথাযথভাবে ভাড়া আদায় হলে এর বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং ইজারা দেয়া সব প্রতিষ্ঠানের দায়দেনা পরিশোধ সম্ভব।
অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টেও সব দেনা পরিশোধ করা হয়েছে। পাশাপাশি ট্রাস্টকে আরো লাভজনক করতে প্রায় ৩শ� কোটি টাকা খরচে ৪টি প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে তা থেকে বছরে দেড় থেকে পৌনে ২ কোটি টাকা আয় হবে। এর মাধ্যমে ২০১৪ সালের মধ্যেই ট্রাস্টকে লাভজনক পর্যায়ে নেয়া সম্ভব। ইতিমধ্যে নারায়ণগঞ্জে বেদখল হয়ে যাওয়া ট্রাস্টের প্রায় ২৫ একর জমি উদ্ধার করা হয়েছে। তাছাড়া ট্রাস্টের অধীন বর্তমান বাজারদরে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি রয়েছে।
মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠানগুলোকে লাভজনক করা প্রসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রী ক্যাপ্টেন এবি তাজুল ইসলাম (অব.) জাতীয় সংসদে জানান, মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টকে লাভজনক করার উপায় খুঁজতে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট একটি সুপারিশমালা প্রণয়ন করছে। সে সুপারিশ অনুযায়ীই ব্যবস্থা নেয়া হবে। ফেয়ার নিউজ
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়