মাহবুবুর রশিদ::
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে অসংখ্য ছোট-বড় নদী বিধৌত অপূর্ব শোভায় শোভিত প্রাচীন জনপদটির নাম কানাইঘাট।
সিলেট বিভাগীয় শহর থেকে প্রায় ৫১.২ কিলোমিটার দূরে উত্তর-পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত।
সিলেট শহর থেকে কানাইঘাটে আসতে হলে সিলেট-তামাবিল রোড অথবা, জকিগঞ্জ রোডে কানাইঘাট উপজেলা সদরে আসা যায়। কানাইঘাট বাজার ঘেঁষে প্রবাহিত সুরমা নদীর দু'পারেই গাড়ির স্টেশন আছে। সীমান্তকে ঘিরে রেখেছে খাসিয়া জৈয়ন্তিয়া পাহাড়। এর পাদদেশে অবস্থিত অসংখ্য টিলা, মণিপুরী টিলা, মিকিরপাড়া, লুহাজুড়িসহ অসংখ্য টিলার অবস্থান এ উপজেলায়। আবার এসব টিলার মধ্য দিয়ে অসংখ্য নদী বা ছড়া পাহাড় থেকে নেমে এসেছে। এর মধ্যে লোভা, নুনগাং, কালিজুড়ি, আপাং, সুরই, সিংগাইর, নাপিতখাল অন্যতম, এগুলো দিয়ে খাসিয়া-জৈয়ন্তিয়া পাহাড় থেকে অতীতে অসংখ্য বানর, শূকর, হাতি, বাঘ ইত্যাদি প্রাণী এখানকার লোকালয়ে নেমে আসত। এখনো শরৎ-হেমন্তকালে বাঘ নামে। প্রতি বছর ২/১টি বাঘ আটক করা হয়। স্থানীয় ভাষায় এ বাঘ আটক করাকে বলা হয় 'বাঘ খেওড়'।
নিচে বাঘ খেওড়ের কয়েকটি মজার ঘটনা তুলে ধরা হলো।
বাঘ আসে কোথা থেকে:
কানাইঘাটের পাহাড়গুলোতে প্রতিবছর যে বাঘগুলো আসে তা পার্শ্ববর্তী ভারতের উঁচু উঁচু পাহাড় থেকে এসব লোকালয়ে নেমে আসে। সাধারণত খাবারের সন্ধানে, দলছুট হয়ে বাঘগুলো এসব লোকালয়ে নেমে আসে। স্থানীয় পাহাড়ি এলাকার লোকদের বক্তব্য প্রায় রাতে এসব বাঘের গর্জনও শোনা যায়। গত বছরের শেষের দিকে এখানে বিরল প্রজাতির দুটি কালো বাঘ নামলে ১টি বাঘকে আটক করতে সক্ষম হয় এলাকাবাসী, যে বাঘটি প্রশাসনের সহযোগিতায় চিটাগাং সাফারি পার্কে নেওয়ার পথে মারা যায়।
যেভাবে বাঘকে আটক করা হয়:
মূলাগুল, বড়বন্দ, সুরইঘাট, কালিনগর, নিহালপুর, লক্ষ্মীপ্রসাদ ইত্যাদি পাহাড়ি এলাকার গ্রামগুলোতে বাঘ নামলে লোকজন সুকৌশলে বাঘের অবস্থানের বন, টিলা, ঘিরে জাল দিয়ে বাঘকে আটক করে। সীমান্তবর্তী এসব গ্রামে বাঘ নামলে প্রথমে গরু, ছাগল, মহিষ ও ভেড়ার ওপর আক্রমণ করে এতে এলাকার লোকজন নিশ্চিত হন, পাহাড় থেকে লোকালয়ে বাঘ নেমে এসেছে। তখন শুরু হয় বাঘ আটকের প্রস্তুতি। লোকালয়ে বাঘের উপস্থিতি নিশ্চিত হওয়ার পর পাহাড়ি এলাকার মসজিদগুলোতে মাইকিং করে এলাকাবাসীকে সতর্ক করে সব মহল্লা থেকে পাট দিয়ে তৈরি বিশেষ আকৃতির অনেকগুলো জাল সংগ্রহ করা হয়। তারপর বাঘের অবস্থানরত পাহাড়ি টিলার তিনদিক জাল দিয়ে ঘেরাও করে একদিক খোলা রাখা হয়। এবার সব এলাকার লোকজন ঢাক-ঢোল পিটিয়ে, লাঠিসোঁটা ও নানা অস্ত্র নিয়ে বাঘকে জালের ভেতর ঢুকিয়ে ধীরে ধীরে খেওড়ের খোলা মুখটি ছোট করতে থাকে আর এ সময়ে জনতা নানা ধরনের হৈ-হুল্লোড় করে থাকে। এক সময় খেওড়ের পরিধি টিলার পাদদেশে ছোট হয়ে আসে বৃত্তাকার রূপে। চারদিকে পাটের জাল দিয়ে ঘেরাও করা বৃত্তাকার এ স্থানটিতে জমে উঠে বাঘ খেওড়ের মেলা। দূর-দূরান্ত থেকে ছোট, বড়, আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা আসতে থাকে একনজর বাঘটি দেখার জন্য।
বাঘ আটকের পরের ঘটনা:
এক সময় বাঘ আটকের পর বাঘ খেওড় কমিটির নির্ধারিত নিয়ম-নীতির আওতায় মেলা শেষ হওয়ার পর বাঘ মারার জন্য মঞ্চ তৈরি করা হতো এবং নির্ধারিত ব্যক্তিরা মঞ্চে উঠে পরপর কয়েকটি গুলি করে বাঘকে হত্যা করতেন। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশ সরকারের বন্য আইনে বন্যপশু হত্যা করা বেআইনি বিধায় আটক বাঘকে সাধারণত এখন আর মারা হয় না। আটকের পর প্রশাসনকে খবর দেওয়া হয় এবং আটক বাঘকে কোন পার্কে হস্তান্তর করা হয়।
যে ভাবে মেলা বসে বাঘ দেখার জন্য:
কানাইঘাটে বাঘ আটক হয়েছে এ খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে হাজার-হাজার লোক বিভিন্ন জায়গা থেকে বাঘ দেখতে এসে ভিড় জমায়। পাহাড়ি গ্রামের লোকজন আনন্দ করে মেলা বসায়। কোনো কোনো সময় ৭/৮ দিন এ মেলা চলে। স্থানীয় লোকজন এ আনন্দ মেলাকে 'বাঘ খেওড়ের মেলা' বলে। মেলায় বিভিন্ন ধরনের দোকান বসে, এতে পাহাড়ি এলাকার নানা জাতের ফলফলারি ছাড়াও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস পাওয়া যায়।
বাঘ খেওড় কমিটি:
বাঘকে আটক করার জন্য রয়েছে বিভিন্ন গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিকে নিয়ে গঠিত 'বাঘ খেওড় কমিটি'। বাঘ আটক করা থেকে শুরু করে বাঘ মারা পর্যন্ত বা বাঘকে ধরে সংশ্লিষ্ট সরকারি বনবিভাগের হাতে অথবা স্থানীয় প্রশাসনের হাতে তুলে দেওয়া পর্যন্ত সব সিদ্ধান্ত এই বাঘ খেওড় কমিটিই নিয়ে থাকে। যথাসম্ভব বনবিভাগের হাতে তুলে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। প্রতি ১ বছর পরপর এ কমিটি পরিবর্তন হয়। বাঘ খেওড়ের আরেকটি মজার ব্যাপার হলো খেওড়ের পর কোনো গ্রামের অংশ দিয়ে জাল ছিঁড়ে যদি বাঘ বেরিয়ে যায় তাহলে খেওড় কমিটির নিয়ম অনুযায়ী ওই এলাকার লোকজনকে মোটা অঙ্কের জরিমানা করা হয়।
লেখক: মাহবুবুর রশিদ,সভাপতি: লোভাছড়া ট্যুরিস্ট ক্লাব। মোবা:-০১৭২৭-৬৬৭৭২০।
কানাইঘাট নিউজ ডটকম/২৬ সেপ্টেম্বর ২০১১ ইং
খবর বিভাগঃ
প্রতিদিনের কানাইঘাট
ফিচার
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়