বিচার বিভাগ সংস্কার নিয়ে ১৫টি প্রস্তাব পেশ করেছে আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টি। দলটি বলছে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হলো বিচার বিভাগ। দেশ ও জাতির স্বার্থে তাই এই প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা, পেশাদারিত্ব ও মর্যাদা রক্ষা অতীব জরুরি। এ লক্ষ্যেই ১৫ দফা প্রস্তাবনা পেশ।
মঙ্গলবার রাজধানীর পল্টনে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ‘বিচার বিভাগের সংস্কার ও ন্যায় বিচার নিশ্চিতকরণে করণীয়’ বিষয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন এবি পার্টির নেতারা।
সংবাদ সম্মেলনে ১৫ দফা প্রস্তাবনা পেশ করেন এবি পার্টির যুগ্ম সদস্য সচিব ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ। এ সময় উপস্থিত ছিলেন- দলটির যুগ্ম সদস্য সচিব ব্যারিস্টার যোবায়ের আহমেদ ভূঁইয়া, কেন্দ্রীয় দফতর সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল মামুন রানা, প্রচার সম্পাদক আনোয়ার সাদাত টুটুল, সহকারী সদস্য সচিব ব্যারিস্টার সানী আব্দুল হক প্রমুখ।
ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বলেন, নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণ ও নাক গলানো থেকে এই রাষ্ট্রীয় স্তম্ভকে রক্ষা করবার আহ্বান জানাচ্ছি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে। গত মাসে আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমানের নেতৃত্বে বিচার বিভাগ সংস্কারের জন্য গঠিত কমিটিকে স্বাগত জানাই। আশা করছি অতি দ্রুত বাকি সদস্যদের মনোনীত করে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠিত হবে এবং তারা দেশের রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ ও ছাত্র-জনতার মতামত ও গণঅভ্যুত্থানের মননকে ধারণ করে প্রয়োজনীয় প্রস্তাবনা জাতির সামনে পেশ করবেন। সম্প্রতি অধঃস্তন আদালতের বিচারকদের সম্মেলনে দেওয়া আইন উপদেষ্টা, প্রধান বিচারপতি এবং অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে এবি পার্টি নিম্নোক্ত প্রস্তাব ও দাবি জানাচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে।
১. অবিলম্বে সুপ্রিম কোর্টের অধীনে আইন ও বিচার বিষয়ক প্রশাসনিক সচিবালয় গঠন করতে হবে, যার নিয়োগ, বদলি, পদন্নতির পুরো এখতিয়ার নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণ মুক্ত হবে।
২. অ্যাটনি জেনারেলের অফিস, পাবলিক প্রসিকিউশনের অফিস, উচ্চ আদালতের বিচারপতি নিয়োগসহ সব প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ, জবাবদিহিতামূলক ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে।
৩. ফৌজদারী অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে তদন্ত ব্যতীত পুলিশের কোনো ভূমিকা থাকতে পারবে না। দীর্ঘসূত্রীতাকে এড়িয়ে যথা সময়ে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের ব্যবস্থা করতে হবে। তাই, একই সচিবালয়ের অধীনে স্বাধীন প্রসিকিউশন টিম গঠন করতে হবে।
৪. বিচারিক যোগ্যতা, মেধা, অভিজ্ঞতা, বিবেকবোধ, সততা ও নিষ্ঠা হতে হবে বিচারক ও বিচারপতি হবার একমাত্র যোগ্যতা। রাজনৈতিক বিবেচনায় কোনো নিয়োগ হতে পারবে না।
৫. যেসব বিচারক ও বিচারপতি অর্থ, রাজনৈতিক পৃষ্টপোষকতা ও অবৈধ সুবিধা লাভের জন্য জুলুম করেছেন, ঘুষের বিনিময়ে রায় দিয়েছেন, নির্বাহী বিভাগের গোলামি করে বিচারের নামে অবিচার করেছেন তাদেরকে তদন্ত সাপেক্ষে চাকরিচ্যুত এবং/অথবা অন্য কোনো শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। সেক্ষেত্রে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল অথবা অন্য কোনো গ্রহনযোগ্য কমিটি গঠিত হতে পারে।
৬. আইন পেশায় ন্যূনতম পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা ব্যতীত নিম্ন আদালতের বিচারক হতে পারবে না। মামলা জট কমাতে জনসংখ্যার অনুপাতে বিচারকদের সংখ্যা ও বিচারপ্রার্থীদের সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে।
৭. বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ ও বিভিন্ন ল’ কলেজের পাঠ্য কারিকুলাম ও পঠন পদ্ধতিকে ঢেলে সাজাতে হবে।
৮. বার কাউন্সিলকে আইনজীবীদের স্বার্থ ও পেশার মর্যাদার জন্য পুনর্গঠন জরুরি। সেক্ষেত্রে ১৯৭২ সালের বার কাউন্সিল নীতিমালা সব পক্ষের সঙ্গে পরামর্শের ভিত্তিতে পুনঃলিখন জরুরি।
৯. যারা আইন পেশায় নিয়োজিত হতে চান তাদের বার কাউন্সিলের অধীনে এক বছর মেয়াদী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। আর্থিক অসঙ্গতির কারণে কোনো মেধাবী ছাত্রকে কোর্স থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। এখানে মূল্যায়নের প্রেক্ষিতে আইনজীবী হিসেবে নিবন্ধিত হবেন, আর কোনো পরীক্ষার মুখোমুখি হবেন না।
১০. জেলা ও উচ্চ আদালতের বার অ্যাসোসিয়েশনের বাধ্যতামূলক সদস্য হওয়ার বিধান বাতিল করতে হবে। এটা ঐচ্ছিক থাকবে। শুধুমাত্র বার কাউন্সিলের সদস্য থাকাটা সব আইনজীবীর জন্য বাধ্যতামূলক থাকবে।
১১. আদালত প্রাঙ্গণে দলীয় রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। মিছিল, মিটিং, শ্লোগান, ব্যানার, পোস্টারিং করে আদালতের ভাবমূর্তিকে হেয় করার সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। সেক্ষেত্রে প্রতিটি বারকে বিচারিক আদালতের সীমানা থেকে আলাদা করার ব্যবস্থা করতে হবে।
১২. দেশের আবহাওয়া ও জনমানুষের সংস্কৃতিকে ধারণ করে এমন আরামদায়ক কিন্তু পেশাদার পোশাকের প্রচলন করতে হবে।
১৩. সংবিধান সংশোধন করে আপিল বিভাগকে সুপ্রিম কোর্টের মর্যাদা দিতে হবে। হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগ দুটোই সুপ্রিম কোর্ট হতে পারে না।
১৪. ৪০ লক্ষাধিক মামলার জট কাটাতে একটা কমিটি করে বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে হবে। প্রত্যেক স্তরে বিচারিক প্রশাসন গঠন, আপিল করবার সীমা বেধে দেওয়া, পরাজিত পক্ষকে খরচের দায়িত্ব নিতে বাধ্য করা, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যবস্থাকে বিচারিক সচিবালয়ের অধীনে ইউনিয়ন/উপজেলা পর্যন্ত সম্প্রসারণ জরুরি বলে মনে করে এবি পার্টি। বিচার বিভাগীয় সেবাকে বিকেন্দ্রীকরণের অংশ হিসেবে প্রতিটি বিভাগ এবং গুরুত্বপূর্ণ জেলা শহরে হাইকোর্টের বেঞ্চ গঠন করতে হবে।
১৫. লক্ষ লক্ষ মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা নিস্পত্তির জন্য স্থায়ী ‘ফৌজদারী মামলা পুনর্মূল্যায়ন কমিশন’ (Criminal Cases Review Commission) গঠন করতে হবে। যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। আর যারা এসব বেআইনি কাজে জড়িত ছিল তাদের তদন্ত সাপেক্ষে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়