Sunday, July 7

মানুষের জীবনে নফসের প্রভাব

মুহাম্মদ আবদুল ওয়াহ্হাব  ::
নফস কী?
আভিধানিক অর্থে নফস হলোÑ মানুষের মন, আত্মা, প্রবৃত্তি, প্রাণী। নফস বলতে মানুষ, ব্যক্তি, স্বয়ং, নিজ, খোদ এগুলোকে বোঝায়।
নফস তিন প্রকার : ১. নফসে আম্মারা, ২. নফসে লাওয়ামা, ৩. নফসে মুতমাইন্না। আম্মারা হলো কুপ্রবৃত্তি, যা মানুষকে জৈবিক প্রবৃত্তিতে আকৃষ্ট করে। লাওয়ামা হলো অনুশোচনাকারী আত্মা, যা অন্যায় কাজ করার পর মানুষকে অনুশোচনার উদ্রেক করে। মুতমাইন্না হলো প্রশান্ত মন, যা সব কালিমা থেকে মুক্ত এবং যাবতীয় মহৎ ভাবনায় পরিতৃপ্ত।
ব্যাখ্যা এই যে, প্রত্যেক মানব মন আপন সত্তার দিক থেকে মন্দ কাজের আদেশদাতা। কিন্তু মানুষ যখন আল্লাহ ও পরকালের ভয়ে মনের আদেশ পালনে বিরত থাকে, তখন তা লাওয়ামা হয়ে যায় অর্থাৎ মন্দ কাজের জন্য তিরস্কারকারী ও মন্দ কাজ থেকে তওবাকারী। যেমনÑ সাধু-সজ্জনের মন এবং যখন কোনো মানুষ মনের বিরুদ্ধে সাধনা করতে করতে মনকে এমন স্তরে পৌঁছে দেয় যে, তার মধ্যে মন্দ কাজের কোনো স্পৃহাই অবশিষ্ট থাকে না, তখন তা মুতমাইন্না হয়ে যায়। (সূরা ইউসুফ : ৫৩; তাফসিরে মারেফুল কোরআন)।
নফস শক্তি পায় কোথা থেকে?
মানুষের খাবার তার নফসকে শক্তি জোগায়। আল্লাহ তায়ালা নফসকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কে?’ নফস বলল, ‘আমি আমি, আর তুমি তুমি’। অর্থাৎ নফস বেপরোয়া হয়ে আল্লাহর প্রশ্নের জবাব দিল। আল্লাহ তায়ালা কিছুদিনের জন্য নফসকে তার খাবার বন্দ করে দিলেন। ফলে নফস কাবু হয়ে গেল এবং আল্লাহর কাছে নুয়ে পড়ল।
পবিত্র রমজানে যারা রোজা রাখেন তারা জানেন নফস কাবুতে থাকে। মানুষ যত খাবারের আলোচনা করবে, যত প্রশংসা করবে, ততই খাবারের প্রতি আগ্রহ বেড়ে যাবে। যেমন ধরুন, খাবার একটু খারাপ হলে বদনাম করবে, ভালো হলে প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এটার মধ্যে এই ভিটামিন, ওই ভিটামিন। এটা খেলে কোলেস্টেরল বেড়ে যায়, ওইটা খেলে কমে যায়; দুজন একত্রে বসলেই শুরু হয়ে যায় মুখরোচক আলোচনা। দুই মহিলার মধ্যে টেলিফোনে আলাপ হচ্ছেÑ
প্রথম মহিলা : ‘আজ কী রান্না করলি?’
দ্বিতীয় মহিলা : এই যে ‘মুগডাল দিয়ে মাছের মাথা।’
প্রথমজন : ‘কী মাছ, রুই না কাতলা, না বড় তেলাপিয়া?’
দ্বিতীয়জন : ‘না ভাই, তেলাপিয়া মানে চাষের তেলাপিয়া, তা আমি খাই না। খাইয়ে খাইয়ে একেবারে ফুটবলের মতো করে ফেলে, খেতে একদম ভাতের মতো লাগে।’ এসব আলাপ কখনও শেষ হয় না। হঠাৎ মনে পড়ল, আরে এখন তো টেলিভিশনে রান্নার প্রোগ্রাম আছে! ‘আপা এখন রাখি, আমার একটা জরুরি রান্না দেখতে হবে।’
জোহরের আজান হয়ে গেছে সেদিকে খেয়ালই নেই। খাবার টেবিলে আবার একই গপ্প। দেখো, কী মজাই না হয়েছে! আমি তো আজ অমুকের নতুন রেসিপি দেখে রান্না করেছি, বল না কেমন লাগছে? শুধু তো খেয়েই যাচ্ছ, কিছু বল! বেচারা স্বামী বলছেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ।’
শুধু আলহামদুলিল্লাহ, আর কিছু বলবে না? স্বামী বলছেন, ‘শোন, যারা রান্না করে তাদের অনেক পরিশ্রম করে রান্না করতে হয়। এর জন্য মন্তব্যের প্রয়োজন নেই; কারণ দুটোকে ভালো বলব, আর একটিতে লবণ কম হলে বদনাম করব, কী রান্না করেছ, লবণ দাওনি? তার চেয়ে এটাই কি ভালো নয়; যদি বলি আলহামদুলিল্লাহ।’
ভুলে গেলে চলবে না, মুসলমানের জিন্দেগি অমুসলমানদের চেয়ে অবশ্যই ভিন্ন। বিজাতীয় লোকেরা খায় আর দুনিয়ার গল্প করে, সুনাম, বদনাম কত কিছুতে টেবিল মাত করে রাখে। আর মুসলমান খাওয়ার আগে, মাঝে এবং শেষে দোয়া পড়ে আল্লাহর জিকির করে। তাতে আল্লাহ তায়ালা খুশি হন, রুজিতে বরকত দেন এবং ওই খাবার মানুষের শরীরে উপকার করে।
আজ মানুষ বাড়ির চেয়ে বাইরে খেতেই বেশি পছন্দ করে। কারণ বাড়িতে তো হরেক রকমের খাবারের আয়োজন করা হয় না।
দিন দিন যখন ভোজনবিলাসীদের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে, তখন হোটেল-রেস্টুরেন্ট, ফাস্টফুড, টেক-অ্যাওয়ের দোকানগুলোও টেক্কা দিয়ে উঠে আসছে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে, ডানে-বাঁয়ে, সামনে-পেছনে যেখানেই তাকাই নতুন নামে, নতুন সাজে শুধুই খাবারের দোকান; একটার সঙ্গে আরেকটা যেন পাল্লা চলছে। বয়-বেয়ারারদের নানা রঙের পোশাক, একেক দোকানের একেক বাহারের পোশাক, দেখলেই বোঝা যাবে কে কোন দোকানে কাজ করে। সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন রেসিপি হচ্ছে, খাবারের ছবি দিয়ে মনোরম মলাটের বই বের হচ্ছে।
কয়েক বছর আগে ভারত থেকে মুরুব্বিদের একটি জামাত দ্বীনের সফরে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে গিয়েছিল। তাদের কথা শোনার জন্য মহিলারা এক বিরাট বাড়িতে জমা হন। মুরুব্বিদের আসার আগেই ‘হাউস ফুল’, তিলধারণের জায়গা নেই, উনারা বসবেন কোথায়, কোত্থেকে কথা বলবেন? ঠিক হলো উনারা কিচেন থেকে ‘লাউডস্পিকার দিয়ে কথা বলবেন। ঢুকতেই তাদের চোখে পড়ল সেলফে রাখা দুটো মোটা মোটা বইÑ ১. ঊহপুপষড়ঢ়বফরধ ড়ভ ঈড়ড়শরহম, ২. ঊহপুপষড়ঢ়বফরধ ড়ভ উরবঃরহম রান্নার বিশ্বকোষ এবং পথ্যবিধির বিশ্বকোষ। উনাদের চক্ষু তো চড়ক গাছ! দুই মুঠো খাবার জন্য ইয়া বড় কিতাব! মাশাআল্লাহ।
এখানেই শেষ নয়, মন-চাহি খেতে খেতে শরীর ফুটবলের মতো হওয়ার পর যখন নিজের চেহারা নিজের কাছেই খারাপ লাগে, তখন আবার মনের বিরুদ্ধের খাবারগুলো খেয়ে খেয়ে দেহকে আবার সাইজে আনার জন্য আরেক বিশ্বকোষ! শোনা যায়, আমেরিকা ও ব্রিটেনের বাজারে এই দুটো বইয়ের কাটতি সবচেয়ে বেশি। দোকানে ঢুকলেই দেখবেন বড় বড় সেলফ এ বইগুলো দিয়েই ভরা।
নফসের তাড়নায় নতুন নতুন খাবার, চর্ব, চুষ্য, লেহ্য, পিয় নানা পদের খাবার খেয়ে খেয়ে তারা দুটো সমস্যা নিয়ে ডাক্তারের কাছে ছোটে : একটি রহঃবৎহধষ, আরেকটি বীঃবৎহধষ. হার্টের সমস্যা, প্রেসারের সমস্যা, আরও কত কী! দ্বিতীয়টি হলো মেদ বেড়ে যাওয়ায় মায়ের বকুনি, বন্ধু-বান্ধবদের হাসাহাসি। তারা আবার ছোটে ব্যায়ামাগারে। এই সুযোগে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে ‘ক্লিনিক’ আর ‘জিম’। নফসের গোলাম হওয়ার কারণে কালি ও কলমের মতো জোড়ায় জোড়ায় আবির্ভূত হচ্ছে নতুন বই ‘কুকিং’ ও ‘ডায়েটিং’, আর নতুন ‘ক্লিনিক’ ও ‘জিম’Ñ একটা অপরটার জন্য অত্যাবশ্যক! 
উপায় কী?
আল্লাহ তায়ালা মানুষকে দুই ধরনের জীবনযাপনের পথ দিয়েছেন। মন-চাহি জিন্দেগি আর রব-চাহি জিন্দেগি। যখন সে নফসকে নিয়ন্ত্রণ না করে নফসের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়, তখন সে মন-চাহি জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়। এরই পরিণতি আজ বিশ্বের ৯০ ভাগ মানুষ ভোগ করছে। চোখ থাকতে অন্ধ কেন? নফসে আম্মারা থেকে বাঁচার পরিবর্তে আমরা প্রতিনিয়ত তাকে শক্তি জোগাচ্ছি। একবার ভেবে দেখুন, আল্লাহ তায়ালা অসংখ্য সৃষ্টির মধ্যে মানুষকে ‘আশরাফ’ সম্মানিত, সবচেয়ে প্রিয় করে পয়দা করেছেন। আর এই এক মানুষের জন্যই বাকি অসংখ্য সৃষ্টিকে অস্তিত্বে এনেছেন, যারা আল্লাহ তায়ালার আদেশের প্রতি সেকেন্ডে আমাদের সেবায় নিয়জিত রয়েছে। বিবেকবান মানুষ একবার ভাবুন, আমরা কার চাহাত পূর্ণ করব, আল্লাহর (আল্লাহ-চাহি) না কি আমার নিজের (মন-চাহি)। আজ না হলেও কাল অবশ্যই উত্তর খুঁজে পাব!

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়