Thursday, June 27

জার্মানিতে খড়ের ঘর তৈরির হিড়িক পড়েছে কেন?

ফিচার ডেস্ক  ::

‘খড় কুটার এক বাসা বাঁধলাম, বাবুই পাখির মত’ জনপ্রিয় এই গানটি নিশ্চয়ই শুনে থাকবেন। বর্তমান বিশ্বে যেখানে আকাশচুম্বী অত্যাধুনিক ডিজাইনের দালানকোঠা নির্মাণ করা হচ্ছে সেখানে নিতান্তই খড় কুটার তৈরি ঘর! কল্পনায় এরকম বাড়ি তৈরি করা যায় তাই বলে বাস্তবে এমন ঘরে বসবাস করা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ! এক সময় গ্রামবাংলায় এমন খড় কুটার ঘর দেখা যেত তবে বর্তমানে সে স্থান দখল করেছে টিনের বা দালান ঘর। ভাবতে পারেন জার্মানির মতো অত্যাধুনিক একটি দেশের মানুষ খর কুটা দিয়ে তৈরি  ঘরে বসবাস শুরু করেছে। অবাক হচ্ছেন? মাটি, কাদা, খড়, কাদামাটির মতো উপকরণ কাজে লাগিয়ে আধুনিক বাড়িঘর তৈরি হচ্ছে জার্মানিতে। প্রকৃতির কাছাকাছি থাকতেই এই বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

খড় ও মাটির বাড়ি
হাজার হাজার বছর ধরে নির্মাণের উপকরণ হিসেবে খড় ও মাটি ব্যবহার করা হচ্ছে। দুই উপকরণই সহজলভ্য। জার্মানির ভাইমার শহরে কাছেরই একটি মাঠ থেকে খড় আনা হয়েছে। প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূর থেকে মাটি এসেছে। বাড়ির দেয়াল খড়ের আঁটি দিয়ে তৈরি। ভেতরে ৪ সেন্টিমিটার পুরু মাটিভিত্তিক প্লাস্টার রয়েছে। কাদামাটির মিস্ত্রী লুৎস ম্যুলার ডয়েচে ভেলেকে বলেন, কাদামাটি খুবই পাকাপোক্ত। অন্যদিকে সিমেন্ট খুবই আগ্রাসী এবং ত্বকের জন্য ক্ষতিকর। উপকরণ হিসেবে মাটি শুধু বাড়ি ও তার বাসিন্দা নয়, নির্মাণ শ্রমিকদের জন্যও অনেক মনোরম।
মাটির দেয়াল ও খড়ের ছাদ বিশিষ্ট দোতলা বাড়ি
মাটির দেয়াল ও খড়ের ছাদ বিশিষ্ট দোতলা বাড়ি
স্থপতি হিসেবে ফ্লোরিয়ান হপে এমন কিছু বাড়ি নির্মাণ করেছেন, যেখানে উত্তাপ নিরোধক ব্যবস্থা হিসেবে খড় ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু এটাই প্রথম বাড়ি, যেখানে কাঠামোর ভিত্তি হিসেবে কাদামাটির আঁটি কাজে লাগানো হয়েছে। আইডিয়া হিসেবে বিষয়টি সহজ হলেও নির্মাণের সময় অত্যন্ত যত্নসহকারে প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয়ের উপর নজর রাখতে হয়। স্থপতি হিসেবে ফ্লোরিয়ান হপে বলেন, ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে আমরা খরের আঁটিগুলোর মাঝের অংশ ভরে ফেলেছি, যাতে কোনো অংশ ফাঁপা না থাকে।
আবহাওয়া সামলানোর ব্যবস্থা
বৃষ্টি ও বরফের মোকাবিলা করতে না পারায় বাইরের অংশের জন্য নরম মাটির প্লাস্টার মোটেই উপযুক্ত নয়। তাই হপে-র নতুন বাড়িটির বাইরে কাদামাটির প্লাস্টার ব্যবহার করা হয়েছে। আসলে পাশাপাশি দু’টি বাড়ির সমন্বয়ে ভবনটি তৈরি করা হয়েছে। তার মধ্যে একটিতে হপে সপরিবারে বসবাস করবেন। বাইরের দেয়াল প্রায় ১ মিটার, ২০ সেন্টিমিটার পুরু। ফ্লোরিয়ান হপে বলেন, বাড়ি নির্মাণের বিধিনিয়ম অনুযায়ী ইনসুলেশনের জন্য অর্ধেক খড় ব্যবহার করলেই চলতো। কিন্তু দ্বিগুণ পরিমাণ দ্বিগুণ ভালো ফল দিচ্ছে।
খড়ের আঁটি ইনসুলেশন হিসেবে এতটাই কার্যকর, যে দোতলা বাড়িটি উষ্ণ রাখতে ছোট একটি স্টোভই যথেষ্ট। খড়ের বাড়ির বাসিন্দা আলেক্সান্ড্রা শেংকার-প্রিমুস বলেন, বাইরের তাপমাত্রা মাত্র ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দোতলার তাপমাত্রা অত্যন্ত মনোরম৷ রোদ উঠলেই আমরা পর্দা খুলে দেই, তখন উপরতলা বেশ গরম হয়ে যায়। অর্থাৎ গ্রীষ্মকালে আমাদের আরো ছায়া সৃষ্টি করতে হবে। কিন্তু এখন শীতের সময় রোদ উঠলে খুব ভালো হয়। দেখা যাক, মেঘলা আকাশ হলে কী হয়? এটা অনেকটা পরীক্ষার মতো। 
আরেকটি মাটির দোতলা বাড়ি ও ঘরের ভেতরের দৃশ্য
আরেকটি মাটির দোতলা বাড়ি ও ঘরের ভেতরের দৃশ্য
ভাইমার শহরে হপে-র বাড়ির অংশে এখনো প্লাস্টার লাগানোর কাজ চলছে। বাকি অংশটির কাজ শেষ হয়ে গেছে। মালিক গৃহপ্রবেশ করতে প্রস্তুত। প্রায় দুই বছর আগে বিশাল পরিমাণ খড়ের আঁটি দিয়ে কাজ শুরুর দিনগুলোর কথা দুই পরিবারেরই মনে আছে। তারা সবাই পুনর্বব্যবহারযোগ্য ও পরিবেশবান্ধব উপকরণ দিয়ে তৈরি বসতবাড়ি তৈরি করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। ফ্লোরিয়ান হপে-র স্ত্রী সারা বলেন, পরের প্রজন্ম যদি বাড়িটি ভেঙে ফেলতে চায়, তাদের কাছে কাঠ, ছাদের টালি, খড় ও ভিত্তির কংক্রিট সবই থাকবে। সেটাই সম্ভবত একমাত্র সমস্যা। পরিবেশের ক্ষতি না করেই বাকি সব ফেলে দেয়া সম্ভব।
‘দক্ষিণ এশিয়া আদর্শ'
ভ্যার্ডেন শহরে পাঁচ তলার একটি ভবনও খড়ের আঁটি দিয়ে তৈরি। তবে কাঠের তৈরি কাঠামো ও থাম বাড়িটির ভার বহন করে। সেখানে জার্মানির টেকসই নির্মাণ কেন্দ্রের উত্তরাঞ্চল শাখার দফতর। ডিটমার হেকেন ইকোলজিকাল নির্মাণ সংক্রান্ত পাঠক্রমের অধ্যাপক। তিনি বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে খড় ব্যবহারের অনেক সুযোগ রয়েছে৷ তার মতে, যেমন ভারত বিশ্বের অন্যতম সেরা ধান ও অন্যান্য শস্যের উৎপাদনকারী দেশ। তাই সেখানে বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। বিশাল পরিমাণ খড় অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকে। তার অনেক অংশ পোড়ানো হয়, ফলে পরিবেশের সমস্যা হয়। ধোঁয়া ও কার্বন নির্গমন হয়। সেগুলো ঠিকমতো ব্যবহার করলে কার্বন নির্গমন হবে না। তবে এমন নির্মাণ কাঠামো সম্পর্কে ভালো করে জানতে হবে। কিছু নির্দেশাবলী থাকলে যে কেউ তা রপ্ত করতে পারে। সেটাই সবচেয়ে বড় সুবিধা।

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়