Thursday, May 16

মাত্র ২৭ দিনে কোরআন মুখস্থ করেছিলেন কানাইঘাটের মাওলানা আব্দুর রহীম


হাফিজ মাওলানা আব্দুর রহীম
সেলিম আউয়াল: মাত্র সাতাশ দিনে পুরো কোরআন শরীফ মুখস্থ করে ফেললেন তিনি। তখন তার বয়স চৌদ্দ বছর, মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে আলিম পরীক্ষা দিয়ে সমগ্র বোর্ডে প্রথম স্থান অধিকার করেছেন। মেধাবী এই মানুষ হচ্ছেন বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন গাছবাড়ি জামিউল উলুম মাদ্রাসার প্রাক্তন প্রিন্সিপাল হাফিজ মাওলানা আব্দুর রহিম।

মাত্র সাতাশ দিনে পবিত্র কোরআন হিফজ করার প্রসঙ্গ তুললে মাওলানা আব্দুর রহিম বললেন এটি আল্লাহর মেহেরবানী। কুদরত উল্লাহ জামে মসজিদের দোতলায় বসে কথা হচ্ছিলো পবিত্র রমজানের যোহরের নামাজের পর। পাশে বসা তার ছাত্র বিশিষ্ট পুস্তক ব্যবসায়ী মাওলানা খলিলুর রহমান, হাফেজ মাওলানা মিফতাহুল ইসলাম, মাসিক ভিন্নধারা সম্পাদক জাহেদুর রহমান চৌধুরী, ক্বারী আব্দুল বাসিত মিলন। 

ব্যক্তিগত জীবনে নিরহংকারী বিনয়ী মাওলানা আব্দুর রহিম আমাদের অনুরোধে তার কোরআন হিফজের বিস্তারিত তুলে ধরলেন--সে বছরটিতে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে আলিম পরিক্ষায় সেদিনের পূর্ব পাকিস্থানের মধ্যে তিনি প্রথম হয়েছেন। রমজানের ছুটির জন্যে বাড়িতে চলে যান। বাড়িতে বসে জানতে পারেন তাদের দু‘বছরের সিনিয়র মাওলানা আবু সাঈদ একটি রমজান মাসে কোরআন হিফজ করে ফেলেছেন। মাত্র এক মাসে কোরআন হিফজ করার বিষয়টি তাকে বিস্মিত করে। তিনি বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন তার বন্ধু ও সহপাঠি পাশের গ্রামের মাওলানা আলা উদ্দিনের সাথে। এতো কম সময়ে কোরআন হিফজ করার বিষয়টি তাদেরকে বিস্মিত করে। সামনে রমজান আসছে তাদেরও ইচ্ছে জাগে যদি এভাবে কোরআন হিফজ করা যেতো। দু বন্ধু কাউকে কিছু না বলেই নিজেদের বাড়িতে চলে যান। রমজান এসে যায় মাওলানা আব্দুর রহিম নিজের বাড়িতে বসে কোরআন মুখস্থ করতে শুরু করেন। বাড়িতে বাবা মাওলানা আব্দুল ওয়াহাব একজন জবরদস্ত আলেম। পুরো এলাকা জুড়ে নাম ডাক। বাবাকে তার স্বপ্নের কথা বলেননি। কিন্তু মুখস্ত করার কাজ চালিয়ে যেতে লাগলেন। প্রতিদিন একপারা কোরআন শরীফ মুখস্ত করে পাশের বাড়ির একজন হাফিজ সাহেবের কাছে পরীক্ষা দিতেন। কিন্তু সবই চলতে কাউকে কিছুই না জানিয়ে। মাত্র সাতাশ দিন পর বাবা মাওলানা আব্দুল ওয়াহাবসহ এলাকাবাসী বিস্ময়ের সাথে জানালেন আব্দুর রহিম পবিত্র কোরআন হিফজ সম্পন্ন করেছেন। এদিকে তার বন্ধু মাওলানা আলাউদ্দিনও তার মতো কাউকে না জানিয়ে তিনিও হিফজ সম্পন্ন করেছেন। দু‘বন্ধু দু‘বন্ধুকে চমকে দিয়ে জানালেন মাত্র সাতাশ দিনে কোরআন হিফজ করার কথা। মাওলানা আলাউদ্দিন পরবর্তীতে যুক্তরাজ্য প্রবাসী হয়ে যান এবং সেখানেই ইন্তেকাল করেন। এখন তার কবর যুক্তরাজ্যে।

হাফিজ মাওলানা আব্দুর রহিম ১৯৫২সালের পহেলা মার্চ সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার সরদারী পাড়া গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতা বিশিষ্ট আলেম মাওলানা আব্দুল ওয়াহাব এবং মাতা কুলসুমা বেগম। গ্রামের মক্তবেই তার পড়ালেখা শুরু হয়। এর পর উমরগঞ্জ প্রাইমারী স্কুলে প্রাইমারী শিক্ষা শেষ করেন। পরবর্তীতে উমরগঞ্জ ইমদাদুল উলুম মাদ্রাসায় মক্তবে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হন। এ মাদ্রাসায় পাঁচ বছর পড়াশোনা সেরে তিনি গাছবাড়ি জামিউল উলুম মাদ্রাসায় ভর্তি হন। এই মাদ্রাসা থেকে সেই সময়ের পূর্ব পাকিস্তান মাদ্রাসা এডুকেশন বোর্ডে ঢাকা-এর অধীনে ১৯৬২সালে দাখিল পরীক্ষায় অংশ নিয়ে প্রথম বিভাগে পাশ করেন। ১৯৬৬সালে আলিম পরীক্ষায় অংশ নিয়ে মাদ্রাসা বোর্ড প্রথম স্থান অর্জন করেন এবং একই বছর মাত্র সাতাইশ দিনে পবিত্র কোরআন হিফজ করেন। ১৯৬৮সালে ফাজিল পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে তৃতীয় স্থান লাভ করেন। ১৯৭০ সালে একই মাদ্রাসায় থেকে মাদ্রাসা বোর্ডের অধীনে কামিল (হাদিস) পরীক্ষায় অংশ নিয়ে প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন। ১৯৭০ সালে কামিল পরীক্ষার পর পরই এতিহ্যবাহী ঝিঙ্গাবাড়ি ফাজিল মাদ্রাসায় সেই সময়ের সুপার মাওলানা হাফিজ আব্দুল আজিজ তাঁর দ্বিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাওলানা আব্দুর রহিমকে নিয়োগ দেন। দেড় বছর অত্যন্ত সুনামের সাথে দায়িত্ব পালনের পর শ্রদ্ধেয় পিতার বার্ধক্য জনিত অসুস্থার কারনে চাকুরী হতে অব্যাহতি নিয়ে বাড়ি চলে আসেন। ২৩জুন ১৯৭৩ সালে পিতার ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত তিনি বাড়িতে ছিলেন। এ সময় স্থানীয় বড়দেশ মাদ্রাসার মুহতামীম ও এলাকাবাসীর অনুরোধে উক্ত মাদ্রাসায় হিফযুল কোরআনসহ বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা দান করে ছাত্র শিক্ষকদের প্রশংসা অর্জন করেন। ১৯৭৩ সালে ২৩ জুলাই তিনি গাছবাড়ি জামিউল উলুম কামিল মাদ্রসার সিনিয়র মাওলানা পদে যোগদান করেন। ১৯৮১ থেকে তিরমিযী শরীফ এবং ১৯৮৩থেকে বুখারী শরিফের খেদমতে তাকে নিয়োজিত করা হয়। ১৯৮৬সালে মহাদ্দিস এবং ১৯৮৭সালে তাকে সর্ব সম্মতিক্রমে উপাধ্যক্ষ পদের জন্য নির্বাচিত করা হয়। উপাধ্যক্ষ্ পাশাপাশি সভাপতির দায়িত্বও পালন করে আসছেন। দায়িত্বে দক্ষতার স্বীকৃতী হিসেবে ১৯৯৪ সালে তাকে সিলেট জেলার শ্রেষ্ঠ মাদরাসা শিক্ষক নির্বাচন করা হয়। দীর্ঘ ১২ বছর পর্যন্ত অত্যন্ত সুনামের সাথে উপাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালনের পর ১৯৯৯ সালের পহেলা জানুয়ারি থেকে এলাকাবাসি শিক্ষক-কর্মচারীবৃন্দের সর্বসম্মতিক্রমে বিধি মোতাবেক তাকে অধ্যক্ষর গুরু দায়িত্ব অর্পন করা হয়। ১৩ বছর ২ মাস অত্যন্ত সুনামের সাথে দায়িত্ব পালনের পর ২০১২সালের ২৯ফেব্রয়ারি তাঁর বয়স ৬০ বছর পূর্তিতে তিনি দায়িত্ব থেকে অবসর গ্রহণ করেন। মাদরাসা পরিচালনা কমিটি ও এলাকাবাসী তাকে কোনভাবেই স্থায়ী বিদায় না দিয়ে পুণরায় অতিরিক্ত মোহাদ্দিস হিসাবে নিয়োগ দানের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি এ সিন্ধান্তকে সম্মানের সাথে গ্রহণ করে ২০১২ সালের ২৪মার্চ থেকে অতিরিক্ত মুহাদ্দিস হিসেবে কিছুদিন দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৮ সালে বাবা মা একমাত্র ছেলের বিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কানাইঘাট উপজেলা ঝিঙ্গাবাড়ীর প্রখ্যাত আলেম, পীরে কামিল শেখ হযরত মাওলানা নিছার আলীর তৃতীয় কন্যা আবিদা বেগমের সাথে ১৯৬৮ সালের জানুযায়ি মাসে মাওলানা আব্দুর রহীমের বিয়ে সম্পন্ন হয়। মাওলানা আব্দুর রহীম ৬ সন্তানের জনক। তিন ছেলের এবং ৩ মেয়ের প্রত্যেকেই মাদরাসা শিক্ষিত এবং বিবাহিত। ছোট মেয়ে কুরআনে হাফিজ ও দাওয়ায়ে হাদীস পাস। বর্তমানে মাওলানা আব্দুর রহীম আমেরিকা আছেন। 

লেখক: সাবেক বার্তা সম্পাদক,দৈনিক সিলেটের ডাক

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়