Wednesday, June 20

যুগ যুগ জিও তুমি

এহসানুল হক জসীম: ‘ইমেরিটাস’ (Emeritus) শব্দটি অবসর গ্রহণের পরও একই কর্মক্ষেত্রে দায়িত্বপালন তথা দায়িত্ব অব্যাহত রাখাকে বোঝায়। পরিভাষাটি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। যেমন, প্রফেসর ইমেরিটাস অমুক। খুবই সম্মানজনক পদ বা দায়িত্ব। যে কেউ ইচ্ছা করলেই প্রফেসর ইমেরিটাস হতে পারেনা। একজন অধ্যাপকের অধিক যোগ্যতা এবং অনেক বেশি গ্রহণযোগ্যতা থাকলে পরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সাধারণত: কাউকে কাউকে প্রফেসর ইমেরিটাস করে থাকে। অবসর গ্রহণের পরও দায়িত্ব পালনের সুযোগ পাওয়া- যেন তেন কথা নয়। স্কুল-কলেজেও স্বল্পকালীন বা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অবসর গ্রহণের পরও দায়িত্ব পালনের সুযোগ আছে যদি কমিটি বা কর্তৃপক্ষ মনে করে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এ সুযোগ যতটা না কম থাকে, তার চাইতেও কম থাকে সাধারণত: স্কুল-কলেজ পর্যায়ে। এই পর্যায়ে অবসর গ্রহণের পর শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাওয়ার জন্য কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে অনুরোধ আসা ক’জনেরই বা কপালে জুটে। বিশেষ করে প্রধান শিক্ষকের ক্ষেত্রে। যেখানে এই পদে অবসরের সময় পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে যাওয়া অনেক কঠিন, অনেকে এই পদের জন্য থাকে লালায়িত, রানিং প্রধান শিক্ষকের অবসর গ্রহণের পর পদটিতে অধিষ্ঠিত হওয়ার জন্য অনেকে থাকে চাতক পাখির ন্যায় অপেক্ষমান; সেখানে একটানা ৩৫ বছর প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করে অবসর গ্রহণের পরও এই পদে আরো পাঁচ বছর দায়িত্ব পালন- চাট্টিখানি কথা? একজন প্রতিষ্ঠান প্রধানের কতটুকু যোগ্যতা, গ্রহণযোগ্যতা এবং জনপ্রিয়তা থাকলে পরে এমনটি সম্ভব- সহজেই অনুমেয়। এমন প্রধান শিক্ষক এই সমাজে বিরল। 

এমনি এক বিরল ব্যক্তিত্ব মোঃ আব্দুর রহীম। একাধারে ৪৩ বছর ছিল যার প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা। ক’জনেরই বা ৪৩ বছরের চাকুরী জীবন থাকে। সাধারণত ৬০ বছর বয়স যেখানে অবসর গ্রহণের সময়সীমা, সেখানে একজন মানুষ ৩৫/৪০ বছর না হয় শিক্ষকতাই করলো। না হয় ২০/২৫ বছর প্রধান শিক্ষকের পদে আসীন থাকলো। কিন্তু চার দশকের বেশি সময় প্রধান শিক্ষক! অবাক হওয়ার বিষয়ই বটে। হ্যাঁ; এমন বিরল মানুষটি আজ ঘাসের নিচে। আজ তিনি স্মরণের আবরণে। ‘মোঃ আব্দুর রহীম’- নামটিই চাপা পড়ে গিয়েছিল। লোকে মাষ্টার আব্দুর রহীম না বলে বলতো দরবস্তের ‘হেডস্যার’। হেডস্যার বা প্রধান শিক্ষক অন্য কেউও তো থাকতে পারে। কিন্তু দরবস্ত বা বৃহত্তর জৈন্তিয়ায় ‘হেডস্যার’ বলতে ওই একজনকেই বুঝাতো। জৈন্তাপুর উপজেলার দরবস্তের গন্ডি পেরিয়ে বৃহত্তর জৈন্তায় ‘হেডস্যার’ হিসেবেই তিনি সমধিক পরিচিত হয়ে ওঠেন। তাঁর হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রীর বাইরেও সর্বজনের কাছে তথা আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার কাছে তিনি এই এক নামেই পরিচিত ছিলেন। প্রধান শিক্ষক ছিলেন দরবস্তে অবস্থিত সেন্ট্রেল জৈন্তা উচ্চ বিদ্যালয়ের এবং কানাইঘাটের সর্ববৃহৎ হাই স্কুল গাছবাড়ী মডার্ণ একাডেমীর। এই মডার্ণ একাডেমী তাঁর হাতেই বিকশিত হতে শুরু করে এবং সেন্ট্রেল জৈন্তা উচ্চ বিদ্যালয় সিলেটের বিখ্যাত হাই স্কুলে পরিণত হয় তাঁরই পরশে। সেন্ট্রেল জৈন্তার ছিলেন দীর্ঘ সময়ের তথা ৪০ বছরের প্রধান শিক্ষক। সব মিলিয়ে ৪৩ বছরের প্রধান শিক্ষক। আর চাকুরী জীবন ৪৫ বছরের। হেডস্যার আব্দুর রহীম ১৯৪৫ সালে জৈন্তাপুরের দরবস্ত ইউনিয়নের ছাতারখাই গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মোঃ হাবিবুল্লাহ কানাইঘাট উপজেলার ঝিংগাবাড়ী ইউনিয়নের দর্জিমাটি গ্রামের জুবেদ আলীর সন্তান ছিলেন। ১৯৪৫ সালের আগেই মোঃ হাবিবুল্লাহ ছাতারখাই গ্রামের বসতি স্থাপন করেন। অবশ্য হেডস্যার আব্দুর রহীম পেশাগত কারণে দরবস্ত বাজারের পাশেই বারইকান্দি গ্রামে থিতু হন। ছাতারখাই সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাঁর শিক্ষাজীবনের হাতেখড়ি। পরে কানাইঘাটের আগফৌদ নারাইনপুর পুরাতন সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। সেন্ট্রেল জৈন্তা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৬১ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। মদন মোহন কলেজ থেকে ১৯৬৩ সালে আই.কম এবং পরবর্তীতে একই কলেজ থেকে বি.কম পাশ করেন। ১৯৬৬ সালে গাছবাড়ী মডার্ণ একাডেমীতে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। দুই বছরের মাথায় মাত্র ২৩ বছর বয়সে ১৯৬৮ সালে এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষকের পদ অলংকৃত করেন। এরপর হাল ধরেন সেন্ট্রেল জৈন্তা উচ্চ বিদ্যালয়ের। ১৯৭১ সাল থেকে একটানা এ প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে ৪০ বছর দায়িত্ব পালন করে ফাইনালী অবসর জীবনে চলে যান ২০১০ সালে। অবশ্য, এর আগে ২০০৫ সালে অবসর গ্রহণের বয়স হলেও ম্যানেজিং কমিটি তথা দরবস্তবাসীর অনুরোধে আরো পাঁচ বছর প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। কত যোগ্য, সফল এবং জনপ্রিয় হেডস্যার ছিলেন- প্রমাণ এখানেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস প্রফেসরের মতো সুযোগ থাকলে হয়তো ২০১৮ সালের ৮ জুন পর্যন্ত অর্থাৎ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এই পদে অধিষ্ঠিত থাকতেন। কিন্তু বিধানের কারণে ২০১০ সালের পর কমিটি তাঁকে আর এই পদে রাখতে পারেনি। হেডস্যার আব্দুর রহীমের সময়ে সেন্ট্রেল জৈন্তা উচ্চ বিদ্যালয় এতোটা সুখ্যাতি অর্জন করে যে, কানাইঘাট উপজেলা সদর, চতুল, গাছবাড়ী, গোয়াইনঘাটসহ বৃহত্তর জৈন্তার আরো বিভিন্ন এলাকায় হাই স্কুল থাকা সত্ত্বেও এসব এলাকার বহু ছাত্র এই প্রতিষ্ঠানে পড়তে আসতো। তাঁর হাত দিয়ে বহু মানুষ বিকশিত হয়েছে, আলোকিত মানুষে পরিণত হয়েছে। তাঁরই দীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে মফ:স্বলের এই প্রতিষ্ঠান থেকেই অনেকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিসিএস ক্যাডার, শিক্ষক, জনপ্রতিনিধি হয়েছেন। যা সাধারণত: শহরের ভালো মানের প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রেই দেখা যায়। কিন্তু মোঃ আব্দুর রহীমের সুদক্ষ পরিচালনায় সেন্ট্রেল জৈন্তা হাই স্কুল সেরা প্রতিষ্ঠানে রূপ নেয়। জৈন্তাবাসীর প্রিয় এই হেডস্যারের মৃত্যুর কিছুক্ষণ পর তাঁরই এক কৃতি ছাত্র জৈন্তাপুর উপজেলা চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন ফেসবুকে হেডস্যারকে উদ্দেশ্যে করে যে আফসোস আর হৃদয়ের আর্তনাদ তুলে ধরেন, সেখানে এই কৃতিমান মানুষের কৃতিত্ব অনেকটা ফুটে ওঠে। জয়নাল আবেদীন ৯ জুনের প্রথম প্রহরে ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেন--

 “তুমি (মোঃ আব্দুর রহীম) এ শতাব্দীর কিংবদন্তী, গুরুকুলের মহাগুরু, তুমি বৃহত্তর সিলেটের শিক্ষাগুরু, তুমি জৈন্তিয়ার প্রদীপ শিখা, তুমি জ্ঞান সমূদ্রের অন্ধকারের বাতিঘর।..তোমার মমতাময়ী শাসন, সুদক্ষ পান্ডিন্ত্যপূর্ণ কালজয়ী নেতৃত্ব সেন্ট্রাল জৈন্তা উচ্চ বিদ্যালয় জৈন্তিয়াবাসীর অক্সফোর্র্ড এ রুপান্তরিত হয়েছিল। বৃহত্তর জৈন্তিয়ার শিক্ষার্থীরা তৃষ্ণা মেটাতে দরবস্ত এলাকার ঘরে ঘরে বসত তৈরী করেছিল, স্যার- শুধু তোমার প্রদীপ শিখা থেকে একটু আলো নিতে, তোমার জ্ঞান সমূদ্রের অতলান্ত তলদেশ থেকে মণি-মুক্তা আহরণ করতে। তোমার ভক্তকূল মৌমাছির মত জ্ঞানের ছাক তৈরী করেছিল সীমান্তের এই জনপদে।..স্যার, তোমার তুলনা তুমি নিজে। জৈন্তিয়াবাসীর এ ক্ষতি অপূরণীয়। তুমি-শূন্য এ জৈন্তা মরু হাহাকার..।

 আসলেই হেডস্যারের অনুপস্থিতিতে জৈন্তিয়াবাসী অনেকটা অভিভাবক শূন্য। নিজ ছাত্র-ছাত্রীর বাইরেও তিনি ছিলেন জৈন্তিয়াবাসীর আপনজন, গুরুজন। যেন আপামর জনতারই শিক্ষাগুরু। প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালনকালীন সর্বদাই ছিলেন কর্মতৎপর। ছিলেন খুবই সময়ানুবর্তি। যথাসময়েই কর্মক্ষেত্রে উপস্থিত থাকতেন। অসাধারণ টিচিং ছিল হেডস্যারের। তাঁর টিচিং যে রপ্ত করতে না পারতো; বলা চলে ঐ ছাত্র কারোরই টিচিং রপ্ত করতে পারতো না। প্রতিটি শিক্ষককেও যথাসময়ে প্রতিষ্ঠানে ও ক্লাসে উপস্থিত রাখা এবং তাদের দিয়ে সর্বোত্তম টিচিং আদায় করার ক্ষেত্রে হেডস্যার আব্দুর রহীম ছিলেন অনন্য। চিন্তা-চেতনায় সর্বদাই কাজ করতো প্রতিষ্ঠানের উন্নতি, শিক্ষার উন্নতি এবং শিক্ষা বিস্তারের মাধ্যমে সামগ্রিকভাবে বৃহত্তর জৈন্তার উন্নতি। গতানুগতিক ভালো ফলাফল অর্জন করে হালকা জনপ্রিয়তা অর্জনে বিশ্বাসী ছিলেন না। ভাবনায় ছিল প্রতিষ্ঠানকে শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করা। করেছিলেনও। নিজ ছাত্র-ছাত্রীকে গুনীজন ও প্রতিষ্ঠিত মানুষ এবং সুনাগরিক হিসেবে তৈরী করার তপস্যা ছিলো। তাঁর বহু শিক্ষার্থী আজ দেশ-বিদেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে প্রতিষ্ঠিত মানুষ হিসেবে। তিনি তৈরী করেছেন জৈন্তিয়া এলাকায় একঝাঁক কৃতিমান মানুষ। বৃহত্তর জৈন্তা বিশেষ করে জৈন্তাপুর উপজেলার যারা আজ বিভিন্ন সেক্টরে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, বলা চলে তাদের প্রায় সবাই এই হেডস্যারের ছাত্র কিংবা তাঁর ছাত্রের ছাত্র। তিনি কেবলই একজন শিক্ষাগুরু, যোগ্য ও সফল হেডমাস্টারই ছিলেন না; একজন সফল পিতা, সমাজসেবী ও হৃদয়বান ব্যক্তিও ছিলেন। তাঁর বড় ছেলে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আশিক আনোয়ার বাহার বর্তমান সময়ের একজন বিখ্যাত সার্জারী বিশেষজ্ঞ ও পরোপকারী চিকিৎসক। আরেক ছেলে ডা. আশিক আনোয়ার তানহার ভেটেরিনারীর উপর উচ্চশিক্ষা নিয়ে অষ্ট্রেলিয়ায় থাকেন স্বপরিবারে। দ্ইু মেয়েকেও সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে সুপাত্রস্ত্র করেছেন। সুযোগ্য ও বিদূষী সহধর্মিনী লায়লা রহিমকেও কাছে পেয়েছেন পরিবার ও সমাজ গড়ার কাজে।

হেডস্যার ছিলেন আমাদের প্রিয় বড় মামা। আমাদের নানার বংশের বড় ছেলে। সে কারণে বড় মামা তথা হেডস্যার মামাকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। দেখেছি তাঁকে উদার মনের মানুষ হিসেবে। ছিলেন একজন দিলদরিয়া মানুষ। কর্মজীবনের ব্যস্ত এই মানুষের দিনের কাজ শুরু হতো কুরআন তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে। অত্যন্ত পরহেজগার মানুষ ছিলেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামায়াতে আদায় করতেন। মা, খালা এবং হেডস্যারের বড় ভাগনা জৈন্তাপুর প্রেসকাবের সাবেক সভাপতি ফয়েজ আহমদসহ অন্যদের কাছ থেকে শুনেছি, তিনি সেই ছোটকাল থেকেই খুবই পরহেজগার ও উদার মনের মানুষ ছিলেন। মানুষের প্রতি বড়ই মমতাময়ী ছিলেন। আপন ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকদের ভালবাসতেন হৃদয় উজাড় করে। প্রতিষ্ঠানের একজন প্রশাসকের পাশাপাশি এই ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকদের কল্যাণে সব সময়ই থাকতেন নিবেদিত। একটি ঘটনা শেয়ার করি, সম্ভবত ২০০৫ বা ২০০৬ সাল (সন তারিখের ব্যাপারে একটু স্মৃতিভ্রম হতে পারে)। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্স্ট ইয়ারে। একদিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নীলক্ষেত গেলাম। নীলক্ষেত মোড়েই হঠাৎ সাক্ষাত মেলে হেডস্যার মামার। সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মামা, আপনি এখানে যে?’। ছিল দুপুরের খাবারের সময়। ‘ঢাকা কেন আসলেন’- প্রথমেই এমন প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আমার খোঁজ-খবর নিলেন আগে। একটি রেস্টুরেন্টে নিয়ে দুপুরের খাবার খাওয়াতে চাইলেন। উনার এবং আমার লাঞ্চ আরো আগেই হয়ে যাওয়ায় হালকা নাস্তার পর্বে গেলাম। তখন বললেন ঢাকা আসার কারণ। কিছুদিন আগে সেন্ট্রেল জৈন্তা উচ্চ বিদ্যালয়ের নগেন্দ্র নম শূদ্র নামের একজন শিক্ষক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। এই শিক্ষকের পরিবার যাতে ফান্ডের অর্থ সহজে এবং দ্রুত সময়ে পায় সেজন্য তাঁর ঢাকায় ছুটে আসা নিজ পকেটের টাকা খরচ করে। নীলক্ষেতের পাশে নায়েম
(National Academy for Educational Management- NAEM) ছিল। সেখানে কাজ শেষ করে আসার পথে দেখা। বললেন, ‘নগেন্দ্র এর অকাল মৃত্যু তার পরিবারের জন্য অর্থ কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজে একটু কষ্ট করে ঢাকা আসলাম যাতে ওর স্ত্রী-সন্তানাদি ফান্ডের টাকাটা দ্রুত পেয়ে যায়। তাতে ওদের কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব হবে।’ এমনি দরদি মনের মানুষ ছিলেন তিনি। তাঁরই অধিনস্থ সহকর্মীর মৃত্যুর পর ওই শিক্ষকের পরিবারের অর্থ কষ্টে তাঁর মন কেঁদে ওঠে। এমন দরদি আর বড় মনের হেডমাস্টার ক’জনই বা হয়। তিনি নিজ আয় থেকে মসজিদ-মাদ্রাসায় নিয়মিত দান করতেন। গরীব ও নি:স্ব মানুষকে সাধ্য অনুযায়ী দান-খয়রাত করে গেছেন নিয়মিত। ছিলেন একজন হৃদয়বান মানুষ। একজন শিক্ষাবিদ, শিক্ষাগুরু এর পাশাপাশি তিনি যে একজন শিক্ষানুরাগী ও সমাজসেবী ছিলেন তার আরেক জ্বলন্ত উদাহরণ- চাকুরী জীবন থেকে অবসর গ্রহণের কিছুদিন পর হেডস্যার আব্দুর রহীম জৈন্তাপুরের তৈয়ব আলী কারিগরী ডিগ্রী কলেজের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই পদে থাকাকালীন মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর নেতৃত্বে কলেজটি উন্নতির সোপানে আরোহন করছিল। কলেজের ছাত্র-শিক্ষক আর কমিটির লোকেরা তাঁর জন্যে বিলাপ করছে। ১৭ পরগণার একজন সালিশ ব্যক্তিত্ব হিসেবেও তাঁর সুনাম ছিল। অনেক জটিল এবং অমিমাংসিত বিষয় তাঁর হস্তক্ষেপে সমাধান পেতো। বিরোধে জড়িয়ে দুই পক্ষই যখন স্ব স্ব অবস্থানে অ্যাডামেন্ট
(adamant) থাকতো এবং তাদেরকে আলোচনার টেবিলে কিংবা সমাধানে নিয়ে আসা কষ্টসাধ্য হতো; তখন অনেকে হেডস্যারের দ্বারস্থ হতো। তাঁর সর্বজন গ্রহণযোগ্যতা, সালিশে নিরপেক্ষতা, আদল-ইনসাফ এবং নি:স্বার্থ অবস্থান বরফ গলাতে সাহায্য করতো। গত শতাব্দীর জৈন্তার এই শ্রেষ্ঠ শিক্ষাগুরু বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে ভোগছিলেন। হার্টের সমস্যা, কিডনী সমস্যা ইত্যাদি তাঁকে কাবু করেছিল। ২০১৭ সালের শেষ দিকে শারীরিক অবস্থা গুরুতর হলে অনেক দিন হাসপাতালের বেডে ছিলেন। হেডস্যার মামার শারীরিক অবস্থার আবারো অবনতি ঘটে। ২০১৮ সালের জুনের শুরুতেই ভর্তি করা হয় জালালাবাদ রাগিব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে। অবস্থার আরো অবনতি ঘটলে নেওয়া হয় লাইফ-সাপোর্টে। কিন্তু না। মা’বুদের ডাকে সাড়া দিয়ে সবাইকে শোক সাগরে ভাসিয়ে জৈন্তাবাসীর এই প্রিয় মানুষটি চলে যান না ফেরার দেশে ২০১৮ সালের ৮ জুন শুক্রবার দিবাগত রাত ১১:৪৫ টায়। দিনটি ২২ রমজান শেষে ছিল ২৩ রমজানের রাত। পরের দিন অর্থাৎ ৯ জুন শনিবার সেন্ট্রেল জৈন্তা উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে বেলা ২:০০ টায় নামাজে জানাযার পর বারইকান্দি গ্রামে চিরনিদ্রায় শায়িত হন এই কৃতিপুরুষ। সেদিন তীব্র দাবদাহে মানুষ এতটাই হাসফাস করছিল যে, রোজা রেখে গৃহ থেকে বাহির হয়ে কোথাও যাওয়ার মতো অবস্থা ছিলো না। প্রচন্ড সেই গরম উপেক্ষা করে জানাযায় হাজার হাজার মানুষ অংশগ্রহণ করে। দরবস্ত তথা জৈন্তার ইতিহাসে এটা ছিল অন্যতম এক বৃহৎ নামাজে জানাযা। চোখের জলে জৈন্তিয়াবাসী শেষ বিদায় জানায় তাদের প্রিয় হেডস্যারকে। মরণশীল জীব হিসেবে মানুষ মৃত্যু নিয়েই জন্মে। হেডস্যার মামাও চলে যাবেন- স্বাভাবিক। তাঁর মতো মানুষ যদি আরো কিছুটা দিন বেঁচে থাকতেন। আহা! যদি শতায়ু পেতেন। স্বগোতোক্তি করি, মামা- ‘কিছুক্ষণ আরো না হয় রহিতে কাছে’। যাহোক, রাব্বুল আলামীনের ইচ্ছার উপর কারোরই হাত নেই। প্রভূর কাছে দোয়া মাঙি, ‘আয় খোদা দয়াময়, তাঁর তরে যেন গো বেহেস্ত নসিব হয়।’ মামা, তোমার বিদেহী আত্মার উদ্দেশ্যে বলি, ‘স্মরণের আবরণে মরণেরে যত্নে রাখি ঢাকি। মরণসাগরপারে তুমি অমর প্রিয় মামা, তোমায় স্মরি।’ যুগ যুগ জিও তুমি জৈন্তিয়ার হে শ্রেষ্ঠ সন্তান সর্বজন শ্রদ্ধেয় হেডস্যার মোঃ আব্দুর রহীম। 

লেখক: এহসানুল হক জসীম
গণমাধ্যমকর্মী ও পিএইচডি গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

 কানাইঘাট নিউজ ডটকম/এজ/মার/২০জুন ২০১৮ ইং

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়