কানাইঘাট নিউজ ডেস্ক:
প্রতিবেশীরাও এক দিন বলেছিল, ‘দেখব লেখাপড়া শিখে কী করতে পারিস।’ এক জীবনযুদ্ধের আখ্যান লিখছেন রোশেনারা খান খড়্গপুর স্টেশনে প্রায় খালি হয়ে যাওয়া মহিলা কামরার এককোণে বই খুলে বসে থাকা মেয়েটিকে দেখে আবিষ্ট হয়ে পড়ি (বাসে-ট্রেনে এই বয়সী ছেলেমেয়েদের সাধারণত কানে হেডফোন গুঁজে চোখ বন্ধ করে বসে থাকতে দেখা যায়)। ছিপছিপে শ্যামলা মেয়েটির চেহারায়, পোশাকে অন্যরকম ছাপ থাকলেও মুখখানি সপ্রতিভতায় উজ্জ্বল। অভ্যাস বশে প্রশ্ন করে জানতে পারি, ওর নাম মাসকুরা খাতুন। ‘সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজ’-এর প্রথম বর্ষের ছাত্রী। বাড়ি পশ্চিম মেদিনীপুরের চন্দ্রকোনাতে।
এর মাস দুই পরে মেদিনীপুর শহর সংলগ্ন ‘আল আমীন মিশন’-এ হঠাৎই মাসকুরার সঙ্গে দেখা হয়। পরিচয় হয় ওর বাবা শেখ রজব আলির সঙ্গে। কথায় কথায় জানতে পারি, এক হতদরিদ্র দিনমজুর বাবা আর তাঁর ডাক্তারি পড়ুয়া মেয়ের কঠোর জীবনযুদ্ধের করুণ কাহিনি। রজব আলির ছয় ভাই দুই বোনের মধ্যে চারভাই-ই দিনমজুর। সম্পত্তি বলতে একখানি মেটেঘর। নিরক্ষর রজব আলির দিনমজুরি করা ছাড়া কোনও গতি ছিল না। তাই মনে মনে ঠিক করেছিলেন নিজের সন্তানদের আর যাই হোক দিনমজুরি করতে দেবেন না, লেখাপড়া শেখাবেন। রজব আলির তিনটি সন্তানই মেয়ে। উনি দুই মেয়েতে খুশি থাকলেও স্ত্রী মুরসিদার পুত্রসন্তানের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে চেয়ে তৃতীয় মেয়ের আগমন। অভাবের সংসারে আরও এক জন সদস্য বাড়ার কারণে, অভাবও বাড়ে পাল্লা দিয়ে। স্ত্রী মুরসিদা কাজের অবসরে বিড়ি বেঁধে সংসারে টাকাপয়সার কিছুটা সুরাহা করার চেষ্টা করলেও রজব আলির কাজ বন্ধ থাকলে সবার খাওয়াও বন্ধ থাকে। রজব আলির মা তাঁর সন্তানদের একবেলা ভাত আর একবেলা ফ্যান খাইয়ে কোনও রকমে বড় করেছিলেন। তাঁরও প্রায় সেই রকমই অবস্থা। মেয়েরা এই অবস্থার সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিয়েই বড় হতে থাকে।
মাসকুরা চন্দ্রকোনা ইসলামিয়া হাই মাদ্রাসায় পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েই শিক্ষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং প্রত্যেক বছর ক্লাসে প্রথম হয়ে উপরে উঠতে থাকে। মাদ্রাসার শিক্ষক বিভাসচন্দ্র ঘড়াই ‘হিরে’ চিনতে ভুল করেননি, প্রয়োজন ছিল শুধু সঠিক ‘আকার’ দেওয়ার। তিনি সেই কাজটি করেছিলেন মাসকুরাকে স্কুলের বাইরে বিনা পারিশ্রমিকে পড়া বুঝিয়ে দিয়ে। পারিশ্রমিক দিতে না পারার লজ্জা থেকে বাঁচতে এবং কৃতজ্ঞতাবশত রজব আলি বিভাসবাবুর বাড়িতে মাঝেমধ্যে ফাইফরমাশ খেটে দিতেন।
এই পরিস্থিতিতে বেড়ে ওঠা মাসকুরার ভবিষ্যৎ ভাবনা রুঢ় বাস্তব ও গতানুগতিক অবস্থার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকাই স্বাভাবিক ছিল। সেখানে স্বপ্ন দেখার কোনও অবকাশ ছিল না। পাড়া-প্রতিবেশীদের মন্তব্য শুনতে শুনতে মাসকুরাও ভেবে নিয়েছিল, মাদ্রাসায় পড়ে ক্লাসে প্রথম হয়ে কী আর হবে? মাধ্যমিক পাশ করতে পারলে বাড়ি বাড়ি বাচ্চা পড়িয়ে হয়তো সামান্য কিছু রোজগার করতে পারবে, তারপর এক দিন কোনও এক দিনমজুরের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যাবে। তার বড়বাবার (জ্যাঠামশাই) মেয়েরাও তো অনেক পড়েছিল, কিন্তু চাকরি হয়নি। বিয়ে হয়ে গেছে। কিন্তু মেয়েকে নিয়ে রজব আলির ভাবনা অন্যরকম ছিল। তিনি মনে মনে চাইতেন মাসকুরা এমন কিছু পড়ুক যাতে তার ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত হয়। কিন্তু সেটা কী ? তার জন্য কী করতে হবে? কী ভাবে সম্ভব? তা তাঁর জানা ছিল না।
২০১৩ সালে মাসকুরা মাদ্রাসা বোর্ড থেকে ৭৬% নম্বর পেয়ে পাশ করলে ওর ভবেশ স্যার ফর্ম ফিল আপ করা, অ্যাডমিশন টেস্ট দিতে নিয়ে যাওয়া, কাউন্সেলিং-এ নিয়ে যাওয়া ইত্যাদি সমস্ত কিছু করে মেদিনীপুরের আল আমীন মিশনে ভর্তির ব্যবস্থা করে দেন। মাসকুরা খাওয়া-পরার কষ্ট পেয়ে থাকলেও কোনও দিন কাঁদেনি, কেঁদেছিল যখন শিক্ষকেরা বলেছিলেন, ও বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে পারবে না। তবে শেষ পর্যন্ত মাসকুরা বিজ্ঞান নিয়ে পড়েই ২০১৫-তে মাদ্রাসা বোর্ড থেকে ৮৪.৪% নম্বর পেয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে। এই মিশনেরই কোচিং সেন্টারে জয়েন্ট এন্ট্রান্সের জন্য কোচিং নিয়ে মাসকুরা ২০১৬-তে মেডিক্যালে ৮৩০ র্যাঙ্ক করে ‘সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজ’-এ ভর্তি হয়। তবে অসুস্থতার কারণে ভাল র্যাঙ্ক না হওয়ার একটা আফশোস ওর মনে রয়ে গেছে। আসলে ও বাইরের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন একটা আবদ্ধ পরিবেশে বড় হয়েছে, মিশনে এসেই ও জানতে পারে ডাক্তার হতে গেলে বিশেষ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। ও এখানে একাদশ শ্রেণি থেকে সম্পূর্ণ বিনা খরচে পড়েছে এবং কোচিংও নিয়েছে। তাই সুযোগ পেলেই এখনে সবার সঙ্গে দেখা করতে আসে।
‘হিজাব’ নিয়ে প্রশ্ন করাতে মাসকুরা জানায়, এখানে ভর্তির আগে ও মাথা ঢাকত না। কিন্তু মিশনের ‘পোশাক বিধি’ মেনে হিজাব ব্যবহার করা শুরু করে। প্রথম দিকে কলেজে হিজাব ও একেবারে সাধারণ পোশাকের কারণে জিন্স, টপ, টি শার্ট পরা ছাত্রছাত্রীরা ওকে কিছুটা অবজ্ঞার চোখে দেখত। কিন্তু ক্লাসের পঠনপাঠনে সাড়া দিয়ে শিক্ষকদের নজর কেড়ে নিতে পারায়, ওরাও এখন স্বাভাবিক ভাবে মেলামেশা করে এবং বিশেষ নজরে দেখে। তবে বাসে, ট্রেনে কেউ কেউ যখন জিজ্ঞেস করে শোনেন ও মেডিক্যাল পড়ছে, তখন কেউ বাহবা দেন, কেউ অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নেন। ওর প্রতিবেশীরাও এক দিন বলেছিল, ‘দেখব লেখাপড়া শিখে কী করতে পারিস।’ মাসকুরা সে দিনের মতো আজও এ সব কথা গায়ে মাখে না। মাসকুরা স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ হতে চায়। লক্ষ্যে পৌঁছতে ওকে এখনও অনেকখানি পথ হাঁটতে হবে, তার জন্য পাথেয় চায়। সেই পাথেয় জোগাড়ের চেষ্টাতেই বাবা ও মেয়ে মেদিনীপুর এসে মিশনে দেখা করতে এসেছেন।
বিশ্ব নারীদিবস উপলক্ষ্যে মাসকুরা খাতুনের মতো অসম্ভবকে সম্ভব করার লক্ষ্যে এগিয়ে চলা সমস্ত মেয়ের জন্য রইল অনেক অনেক শুভকামনা। ওদের পথচলা হোক অনায়াস।-আনন্দবাজার
খবর বিভাগঃ
বিশেষ খবর
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়