
সারা বিশ্বের মানুষের জন্য গুয়ান্তানামো যেন একটি আতঙ্কের নাম। ২০০২ সালের ১১ জানুয়ারি কিউবার দক্ষিণ-পূর্বে ক্যারিবীয় সাগরের গুয়ান্তানামো উপসাগরে কিউবার মাটিতে মার্কিন নৌবাহিনীর একটি ঘাঁটিতে এই কারাগারটি স্থাপন করে যুক্তরাষ্ট্র। এখানে যাদের বন্দী রাখা হয়েছে তাদের অধিকাংশের বিরুদ্ধেই কোনো অভিযোগ আনা হয়নি বা আদালতে বিচারের সম্মুখীনও করা হয় নি। অসংখ্য মানুষকে কোনো প্রকার অভিযোগ ছাড়াই আটকে রাখা হয়েছে কুখ্যাত এই বন্দীশালাটিতে।
কারাগারটির এমনই একজন বন্দী মৌরিতানিয়ার বাসিন্দা মোহাম্মদ অলুদ সালেহি। ২০০১ সালে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য ডেকেছিল যুক্তরাষ্ট্র। এরপর আর বাড়ি ফিরে যাওয়া হয়নি সালেহির। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মার্কিন গোয়েন্দারা তাকে নিয়ে যায় জর্ডানে। তারপর আফগানিস্তান। সর্বশেষ ২০০২ সালে তার স্থান হয় গুয়ান্তানামো বে। কোনো প্রকার অভিযোগ ছাড়াই এখন পর্যন্ত সেখানে মুক্তির অপেক্ষায় দিন কাটাচ্ছেন সালেহি।

সালেহি গুয়ান্তানামোতে তাকে নির্যাতনের ঘটনা লিখে রেখেছিলেন তার ডায়েরিতে। সেই ডায়ারিটি প্রকাশিত হতে যাচ্ছে বই আকারে। বইটির নাম ‘গুয়ান্তানামোর ডায়েরি’। বইটির ভূমিকা তুলে ধরেছে আল জাজিরা।
শুরুতেই সালেহি লিখেছেন, মানুষ স্বভাবতই অন্য মানুষকে নির্যতন করা অপছন্দ করে। আমেরিকানরাও তার ব্যতিক্রম নয়। অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনেক সৈনিক কাজটি করে। আর যখন তাদের নির্যাতন বন্ধ করতে বলা হয়, তারা খুশি হয়। মানুষ সাধারণত যখন বিকারগ্রস্থ এবং বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে তখনই অপরকে নির্যাতন করে। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসী হামলার পর মার্কিনিরাও বিকারগ্রস্থ এবং বিভ্রান্ত হয়ে গেছে।
৯/১১’র ওই হামলার কথা উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, ওই ঘটনার পর ১৮ সেপ্টেম্বর মার্কিন কংগ্রেসে একটি যৌথ অনুমোদনের প্রেক্ষিতে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বুশ যেকোনো জাতি, সংগঠন অথবা ব্যক্তির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়ার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা পায়। আর এর পরেই যুক্তরাষ্ট্র সরকার কোনো ধরনের আইনগত ভিত্তি ছাড়াই সন্ত্রাসী সন্দেহে গোপনে অপহরণ, গ্রেফতার, নির্যাতন এমনকি হত্যার অভিযান পর্যন্ত শুরু করে।
নিজের কথা উল্লেখ করে এই বন্দী তার বইয়ে লিখেছেন, ‘যদিও আমি কখনোই এ ধরনের অপরাধ করিনি, তবু আমিও ওই অভিযানের এক ভুক্তভোগী। ২০০১ সালের ১৯ নভেম্বর মার্কিনিরা আমাকে আমার দেশে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকে। আমি সেখানে যাই। এরপরই তারা মৌরিতানিয়া সরকারের সাথে একটি চুক্তি করে আমাকে আমার দেশ থেকে জর্ডানে নিয়ে যায়। আট মাস আমাকে ভয়ংকর একটি পরিবেশে বন্দী করে রাখা হয় এবং জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তারপর আমাকে নেয়া হয় ইরাকের বাগরাম বিমান ঘাঁটিতে। সেখান থেকে দুই সপ্তাহ পরে গুয়ান্তানামো বে কারাগারে। আজ পর্যন্ত আমি এখনেই আছি।’
বিভিন্ন অভিযানের কথা উল্লেখ করে তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘এতেই কি ২০০১ সালের সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় তদন্তে মার্কিন গণতন্ত্র পাশ করে গেছে? এটি বিচারের দায়িত্ব আমি পাঠকদের দিলাম। আমি যখন এই লেখাটি লিখছি, তখন যুক্তরাষ্ট্র আর এর বাসিন্দারা কিউবার বন্দীদের নিয়ে উভয়সংকটে আছে।’
শুরুতে মার্কিন সরকার এ ধরনের অভিযান নিয়ে খুব খুশি ছিল। তারা ভেবেছিল, এর মধ্য দিয়ে তারা পৃথিবীর সব খারাপ মানুষকে ধরে ফেলতে পারবে। অনেক চড়াই-উৎরাইয়ের পর এখন বোঝা গেছে, এর মাধ্যমে শুধু কিছু সাধারণ মানুষকেই ধরা হয়েছে। এখন মার্কিন সরকার সমস্যায় জর্জরিত হয়ে গেছে। তবু এই অভিযানের ব্যাপারে তারা সত্যটা প্রকাশ করতে চাচ্ছে না।
সবাই ভুল করে। আমার মনে হয়, গুয়ান্তানামো সম্পর্কে মার্কিনিদের সবকিছু বলতে তাদের সরকার দায়বদ্ধ। এখানে বন্দী হয়ে আসার আগ পর্যন্ত আমিই ১০ লাখ ডলারের ওপরে কর প্রদান করেছি। দিন দিন এর পরিমাণ বাড়ছে। মার্কিনিরাও এভাবে কর প্রদান করছে। তাই তাদের সত্য জানার অধিকার আছে।

এখানে আমার অনেক ভাইয়েরই মন ভেঙে পড়ছে। বিশেষ করে কম বয়সী বন্দীদের। যখন আমি এই লেখাটি লিখছি তখন অনেকেই অনশন চালিয়ে যাচ্ছেন। আর এ ব্যাপারে তারা প্রকিজ্ঞাবদ্ধ- যাই ঘটুক না কেন। আমি অসহায়ের মতো তাদের দিকে তাকিয়ে থাকি। এই প্রথম আমরা সম্মিলিতভাবে অনশন করছি। ২০০২ সালে একবার আমি ব্যক্তিগতভাবে অনশন করেছিলাম। তবে তাতে কোনো কাজ হয়নি। মার্কিন সরকার এখানকার সমস্যা না বুঝলেও, এখনকার সৈন্যরা বোঝে। তারা জানে, একমাত্র সমাধান সত্য প্রকাশ করা এবং বন্দীদের মুক্তি দেয়া।
মার্কিন জনগণের প্রতি প্রশ্ন রেখে সালেহি লিখেছেন, আমার জানার খুব ইচ্ছা, আমেরিকার জনগণও কি তাই মনে করে। আমার বিশ্বাস, বেশিরভাগ মার্কিনিই ন্যায়বিচার চায়। তারা নির্দোষ জনগণকে বন্দী রেখে পয়সা খরচ করার পক্ষপাতি নয়। সংখ্যায় সামান্য কিছু চরমপন্থী হয়তো কারাগারটি খোলা রাখার পক্ষে মত দিবে। তবে তাদের এই মতে ভিত্তি অজ্ঞতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
বইটির পাণ্ডুলিপিটি নিজের আইনজীবীর হাতে দেয়ার সময় সালেহি তাকে বলেন, বইটিতে যেসব জনগণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তাদের প্রতি তার কোনো বিদ্বেষ নেই। সবাইকে তিনি সঠিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বইটি পড়ার জন্য অনুরোধ জানান।
খবর বিভাগঃ
ফিচার
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়