Wednesday, December 16

ইসলামে স্বদেশপ্রেম


মুশাহিদ দেওয়ান: মানুষের জীবনের প্রিয় সবকিছুর সমাবেশ ঘটে আপন মাতৃভূমিতে। মাতৃভূমিতে তার আবেগ-উচ্ছ্বাস থাকে সজীব, প্রাণবন্ত। জন্মভূমি স্বদেশের মাটিতে মানুষ খুঁজে পায় নিরাপত্তা ও অকৃত্রিম নির্মল ভালোবাসা। প্রশান্তচিত্তে অতিবাহিত হয় জীবনের প্রতিটি ধাপ। শৈশব-কৈশোর পেরিয়ে যৌবন-প্রৌঢ়ত্ব সবই একে একে নিঃশেষিত হয় প্রিয় জন্মভূমিতে। তাই জন্মভূমিকে কেন্দ্র করেই সামনে পথচলা। প্রতিটি মানুষের কাছে জন্মভূমির এক টুকরো মাটি প্রাণের চেয়েও প্রিয়। স্বদেশপ্রেম নববি আদর্শ : ইসলামী দৃষ্টিকোণে মাতৃভূমির মর্যাদা ব্যাপক। দেশপ্রেম প্রকৃত মোমিনের পরিচায়ক। আমাদের প্রিয় নবী (সা.) মাতৃভূমিকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। স্বদেশপ্রেম তার হৃদয়ে ছিল পূর্ণ মাত্রায়। মক্কার কাফেররা যখন নির্যাতন-নিপীড়নের মাত্রা বাড়িয়ে দিল তখন প্রিয় নবী (সা.) মদিনায় হিজরত করতে বাধ্য হয়েছিলেন। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, প্রিয় নবী (সা.) মাতৃভূমি মক্কাকে সম্বোধন করে বলেন, 'তুমি কতই না পবিত্র শহর! আর আমার কাছে বড়ই প্রিয়। যদি আমার সম্প্রদায় আমাকে বের করে না দিত তাহলে আমি অন্য কোথাও বাস করতাম না।' (তিরমিজি : ৩৮৬১)। প্রিয় নবী (সা.) এর হৃদয়ের মর্মব্যথা ও অভিব্যক্তি দ্বারা আমরা স্বদেশপ্রেমের অনুপম আদর্শ খুঁজে পাই। স্বদেশপ্রেম নববি আদর্শ বলে স্বীকৃত। তাই দেশের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা প্রদর্শন ঈমানি দায়িত্ব। হজরত বেলাল (রা.) হিজরত করে মদিনায় যাওয়ার পরও মাতৃভূমিকে ভুলতে পারেননি। মাতৃভূমির স্মরণে তার হৃদয়ে অস্থিরতা সৃষ্টি হতো। মাতৃভূমির সোনালি চিত্র ভেসে উঠলে দেশাত্মবোধক কবিতা আবৃত্তি করতেন। তিনি গেয়ে উঠতেন, 'হায়! আমার জীবনে কখনও এমন রাত কি ফিরে আসবে যে, আমি লতাপাতা পল্লবিত বৃক্ষ ও পানিসমৃদ্ধ উপত্যকায় রাত কাটাব।' (বোখারি : ১৭৫৬)। ধর্মীয় আদর্শে রাঙায়িত মোমিনের হৃদয়েও স্বদেশপ্রীতি রয়েছে। মাতৃভূমিকে ভালোবাসা ঈমানের অঙ্গ। দেশকে ভালোবাসা উপহার দিয়ে তাকে প্রাণবন্ত করে তোলা সচেতন ঈমানদারের কর্তব্য। কোনো ঈমানদার কখনও দেশদ্রোহী কাজে লিপ্ত হতে পারেন না। একজন মোমিনের মেধা-মননে থাকে দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির চিন্তাভাবনা। যারা স্বার্থান্বেষী তারাই দেশবিরোধী কর্মকা-ে লিপ্ত হয়ে ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। ইসলামে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের গুরুত্ব : স্বাধীনতা মানবজীবনে আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ নেয়ামত। ইসলাম স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সবিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। সুস্থ, সুন্দর ও স্বাভাবিক জীবনের পূর্বশর্ত হচ্ছে স্বাধীনতা। স্বাধীনতা ছাড়া মানুষের ব্যক্তিসত্তা ও জাতিসত্তার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটতে পারে না। অধিকন্তু পরাধীনতা প্রভুর ইবাদতের পথে অন্তরায়। তাই আল্লাহর রাসুল (সা.) একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে নির্বিঘ্নে ইবাদত-বন্দেগি ও শরিয়ত প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে মদিনায় হিজরত করেছিলেন। পৃথিবীতে বিরাজমান অত্যাচার, অস্থিরতা দূর করে ন্যায় ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠার জন্য অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার পর মদিনায় একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। মক্কা বিজয়ের মধ্য দিয়ে সেই রাষ্ট্রের পরিধি বিস্তৃত হয়। মদিনায় জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবার ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করে প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.) স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রথম প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। মানুষ প্রকৃতিগতভাবে স্বাধীন। তাই তাকে পরাধীনতার জিঞ্জিরে আবদ্ধ করে রাখা যায় না। ইসলাম সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কোনো অবরোধ, পরাধীনতার স্বীকৃতি দেয় না। তাই ইসলামে স্বাধীনতার গুরুত্ব ও তাৎপর্য ব্যাপক। বাংলাদেশের রক্তক্ষয়ী ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষাকল্পে। মহান আল্লাহর করুণা ও দয়ার সুসি্নগ্ধ স্পর্শেই আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়েছিল মাত্র ৯ মাসে শক্তিশালী হানাদার বাহিনীকে সম্পূর্ণ পরাজিত ও পর্যুদস্ত করে বিজয় অর্জন করা। স্বাদেশিকতা, স্বাধীনতা অর্জন ও স্বাধিকার আন্দোলন ইত্যাদি বিষয়ে কোরআন-হাদিসে ইতিবাচক দিকনির্দেশনা এসেছে। দেশপ্রেম যেহেতু ঈমানের অঙ্গ, তাই স্বদেশপ্রেম আমাদের মাঝে পূর্ণমাত্রায় থাকতে হবে। আর প্রকৃত দেশপ্রেমিক তখনই হব, যখন আমরা এর যথার্থ মর্যাদা দেব। দেশমাতৃকা রক্ষায় নিজের জীবন বিলিয়ে দেব। প্রিয় নবী (সা.) মদিনায় হিজরত করার পর মদিনাকে নিজের দেশ হিসেবে গণ্য করতেন। তাই তিনি এর স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষাকল্পে সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এমনকি যুদ্ধ করেছেন মদিনা রাষ্ট্র সুরক্ষার জন্য। তিনি স্বাধীনতা অর্জন ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় জীবনদানকে শাহাদাতের মর্যাদা দিয়েছেন। বাঙালি জাতির মাতৃভূমি প্রিয় 'বাংলাদেশ'। সবুজ-শ্যামল এ চিরসুন্দর ভূমিতেই সমাহিত আছেন তার পূর্বপুরুষরা। এই ভূমিতেই বাঙালির হাসি-কান্না, আনন্দ-আহ্লাদ প্রকাশিত। এখানের পাতা-পল্লব, বৃক্ষরাজি, নদ-নদী, আলো-বাতাস তার কাছে খুবই পরিচিত। তাই বাঙালি জাতি মাতৃভূমিকে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসে। এই দেশ নিয়েই তার যত জল্পনা-কল্পনার তরঙ্গায়ন। বাঙালি জাতি দেশাত্মবোধক চেতনায় সর্বদা উদ্দীপিত, অনুপ্রাণিত। একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও বিজয় অর্জন এর প্রামাণ্য দলিল। এই মাসেই বিজয়ের সূর্য উদিত হয়। এই সূর্যের পেছনে আছে একটি ইতিহাস, একটি সংগ্রাম। নবোদিত এই সূর্যের কিরণে মিশে আছে অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা, জীবনদান, রক্তাক্ত বিমর্ষ প্রতিকৃতি। রক্তের মেঘমালা ভেদ করে এ সূর্য উদিত হয়েছে। তাই এ সূর্যের কদর বাঙালির প্রাণে ও এই সবুজে মিশে আছে।

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়