Sunday, June 28

সুদ হারাম হওয়ার নেপথ্যে


এ কিউ এম ছফিউল্লাহ আরিফ: হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) আরও বর্ণনা করেছেন, হজরত বিলাল (রা.) একবার রাসুল (সা.) এর কাছে কিছু উন্নতমানের খেজুর নিয়ে এলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কোথা থেকে এ খেজুর আনলে?’ বিলাল (রা.) উত্তরে বললেন, ‘আমাদের খেজুর খারাপ ছিল। তাই আমি দ্বিগুণ পরিমাণ খারাপ খেজুরের পরিবর্তে ভালো খেজুর বদলে নিয়েছি।’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘আহ! এটা তো সুদের মতোই। কখনও এরূপ করো না। ভালো খেজুর পেতে চাইলে প্রথমে তোমার খেজুর বাজারে (মুদ্রা কিংবা অন্য দ্রব্যের বিনিময়ে) বিক্রি করবে। তারপর তার (মুদ্রা কিংবা অন্য দ্রব্যের) বিনিময়ে ভালো খেজুর কিনে নেবে।’ কোনো কোনো ফকিহর মতে, শুধু হাদিসে উল্লিখিত ছয়টি পণ্যের ব্যাপারেই ‘রিবা ফদল’-এর সীমা নির্ধারিত। কিন্তু অধিকাংশ শরিয়া বিশেষজ্ঞের মতে, হাদিসে উল্লিখিত ক’টি পণ্য উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। হাতে হাতে অন্য যে কোনো পণ্য বদলের ক্ষেত্রে এ নীতি প্রযোজ্য হবে। এখানে মূলনীতি হলো দ্রব্যের পরিমাণ ও প্রকৃতি বা ধরন ভিন্ন না হওয়া। উল্লেখ্য, ‘রিবা ফদলে’র বিষয়টি হাদিসের মাধ্যমে নিষিদ্ধ হয়েছে। শরিয়া বিশেষজ্ঞদের সর্বসম্মত ফতোয়া হলো, ইসলামে সব ধরনের সুদ নিষিদ্ধ। শরিয়ার পর্যালোচনা ও গভীর অনুশীলনের পর তারা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। শরিয়া বিশেষজ্ঞদের সব আন্তর্জাতিক সংস্থা এ ব্যাপারে অভিন্ন রায় বা ফতোয়া দিয়েছেন। সাধারণভাবে তারা সুদের সংজ্ঞায় বলেছেন, মূল ঋণের ওপর পূর্বনির্ধারিত লাভই ‘সুদ’। মুদ্রার নিজস্ব উৎপাদন ক্ষমতা নেই; বরং মুদ্রা হলো বিনিময়ের মাধ্যম। ১ লাখ টাকা তালাবদ্ধ বাক্সে ১ বছর ফেলে রাখলে এক টাকাও বৃদ্ধি পাবে না। কিন্তু এক বস্তা চাল ২ হাজার টাকায় কিনে রাখলে ১ মাস পর তার দাম ২ হাজার টাকা থাকবে না। কমবে, নয়তো বাড়বে। সুদ নিষিদ্ধ হওয়া সম্পর্কে কোরআন ও হাদিসের নির্দেশ স্পষ্ট। কোনো কোনো মহলে অজ্ঞতার কারণে এ ব্যাপারে কিছু বিভ্রান্তি রয়েছে। মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও যারা সুদ সম্পর্কে প্রশ্ন তোলেন তাদের বক্তব্য মূলত দুইটি ক্ষেত্রে কেন্দ্রীভূত। কিছু লোকের ধারণা, সরল ও নিম্নহারের সুদের ব্যাপারে ইসলামে নিষেধাজ্ঞা নেই। তাদের মতে, ইসলাম শুধু চক্রবৃদ্ধি বা উচ্চহারের সুদ নিষিদ্ধ করেছে। এ উচ্চসুদ স্বল্প সময়ের মধ্যে মূলের ওপর দ্বিগুণ, চারগুণ হারে বেড়ে যায়। এ যুক্তির পক্ষে তারা সূরা আলে ইমরানের ১৩০ নম্বর আয়াত উদ্ধৃত করেন। এ আয়াতে বলা হয়েছে- ‘হে ঈমানদাররা, তোমরা চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ খাওয়া ত্যাগ করো এবং আল্লাহকে ভয় করো; আশা করা যায় তোমরা কল্যাণ লাভ করবে।’ এ শ্রেণীর লোক আল কোরআনের একটিমাত্র আয়াত পাঠ না করে পুরো কোরআন সামনে রাখলে দেখবেন, মক্কা ও মদিনা মুনাওয়ারায় সময়ের ব্যবধানে চারটি স্তরে সুদ সম্পর্কিত আয়াত নাজিল হয়েছে। প্রতিটি সময়ের একটি তাৎপর্য রয়েছে। প্রতিবার আয়াত নাজিলের রয়েছে স্বতন্ত্র পটভূমি ও প্রেক্ষাপট। সামগ্রিক বিষয় একসঙ্গে না দেখে, কোরআন থেকে বিধান অনুসরণের সঠিক নীতি ও পদ্ধতি অনুসরণ না করে বিচ্ছিন্নভাবে কোনো আয়াত বা তার অংশ উদ্ধৃত করলে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হওয়াই স্বাভাবিক। সুদ সম্পর্কিত সব আয়াত সামনে রাখলে তারা এ ধরনের বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত হওয়ার সুযোগ পাবেন। পবিত্র কোরআনে সুদের বিষয়ে প্রথম ঘোষণা এসেছে, ‘মানুষের ধন-সম্পদে তোমাদের সম্পদ বৃদ্ধি পাবে, এ আশায় যা কিছু তোমরা সুদে দিয়ে থাক, আল্লাহর কাছে তা বর্ধিত হয় না। পক্ষান্তরে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য যা কিছু তোমরা জাকাতরূপে দিয়ে থাক, তবে এরূপ লোকরাই (তাদের প্রদত্ত বস্তুকে) আল্লাহর সমীপে বর্ধিত করতে থাকবে।’ (সূরা রুম : ৩৯)। দ্বিতীয় ঘোষণা : ‘আর (ইহুদিদের জন্য আমি অনেক উপাদেয় বস্তু হারাম করে দিয়েছি) তাদের সুদ গ্রহণের কারণে, অথচ তা তাদের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছিল এবং তাদের অন্যায়ভাবে মানুষের ধন-সম্পদ গ্রাস করার কারণে। আর আমি তাদের মধ্য থেকে কাফেরদের জন্য প্রস্তুত রেখেছি যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।’ তৃতীয় ঘোষণা : তৃতীয় ধাপে উপর্যুক্ত সূরা আলে ইমরানের ১৩০নং আয়াত অবতীর্ণ হয়। ‘হে ঈমানদাররা, তোমরা চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ খাওয়া ত্যাগ করো এবং আল্লাহকে ভয় করো; আশা করা যায় তোমরা কল্যাণ লাভ করবে।’ এ আয়াতে চক্রবৃদ্ধি প্রাসঙ্গিক নয়; বরং সাধারণভাবে তা সুদের নিষিদ্ধতা ঘোষক। সুতরাং এটাই সুদ হারামের ভিত্তি এবং চক্রবৃদ্ধির সুদ তো ভয়াবহ শোষণ, বৈষম্যের নির্মাতা হিসেবে আরও ঘৃণ্য ও পরিত্যাজ্য। যেভাবে চতুর্থ ও চূড়ান্ত ধাপে সূরা বাকারার ২৭৫-২৮১নং আয়াত অবতীর্ণ করে আল্লাহ তায়ালা সব ধরনের সুদকে হারাম ঘোষণা করেন এবং তার ভয়াবহ পরিণতি জানিয়ে দেন। আবার কেউ কেউ বলতে চান যে, ব্যবহার্য পণ্য সংগ্রহ বা ভোগ্য ঋণের বেলায় সুদ পুরোপুরি নিষিদ্ধ হলেও ব্যবসায়িক কর্মকা- পরিচালনার জন্য ঋণ গ্রহণ বা উৎপাদন ঋণের বেলায় সুদ নিষিদ্ধ নয়। এ ধারণার পেছনে তাদের যুক্তি হলো, প্রথমত বাণিজ্যিক ঋণগ্রহীতা ঋণের টাকা দিয়ে ব্যবসা করেন লাভের উদ্দেশ্যে। কাজেই তার উপার্জিত লাভ থেকে একটি নির্দিষ্ট হারে সুদ দেয়ায় আপত্তির কারণ নেই। তাদের দ্বিতীয় যুক্তি হলো, রাসুলুল্লাহ (সা.) এর যুগে মূলত ভোগ-ব্যয়ের উদ্দেশ্যেই ঋণের লেনদেন হতো। বর্তমান যুগে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য নেয়া ঋণের বেলায় সুদ গ্রহণ ও প্রদান তাদের মতে অবৈধ না হওয়াই যুক্তিযুক্ত। ব্যবসায়িক সুদ বা ব্যাংকিং সুদকে তারা বৈধ বলতে চান। তাদের এ যুক্তি সঠিক নয় এ কারণে যে, ব্যবসায়ে লাভের সম্ভাবনার পাশাপাশি লোকসানের ঝুঁকিও থাকে। সুদের কারবারে লোকসানের ঝুঁকি পুরোটাই উদ্যোক্তার মাথায় চাপিয়ে দিয়ে মূলধনের জোগানদাতা পূর্বনির্ধারিত নিশ্চিত লাভের সুযোগ ভোগ করেন; চাই সে টাকা আদৌ ব্যবসায় খাটানো হোক কিংবা না হোক। এটি তো ন্যায়বিচার হতে পারে না। ব্যবসায় সেই টাকা বিনিয়োগ করে কখনও ক্ষতির সম্মুখীন হলে ঋণগ্রহীতার সে ক্ষতির দায় ঋণদাতা নিতে সম্মত থাকেন না। কারণ অর্থের জোগানদাতা নিজেকে কখনোই ব্যবসায়ী ভাবতে রাজি হন না; বরং সুদগ্রহণকারী মনে করেন। অনেকে আবার সুদ মানবিক চিন্তাধারার ফসল বলে থাকেন ‘কস্ট অব ফান্ড’ এবং ‘কস্ট অব অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ নামে। লেখক : সেক্রেটারি জেনারেল, সেন্ট্রাল শরিয়া বোর্ড ফর ইসলামিক ব্যাংক অব বাংলাদেশ

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়