Friday, April 10

মোনাজাতের তাৎপর্য ও ফজিলত


আলম শামস: মহান আল্লাহর দরবারে নিজের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা, আরাধনা করা, একান্তভাবে মনের চাওয়া-পাওয়ার কথা, নিজের ও অপরের জন্য রাব্বুল আলামিনের কাছে আবেদনের অন্যতম মাধ্যম হলো মোনাজাত বা দোয়া। দোয়া একান্তে করলে আল্লাহ অবশ্যই শুনবেন। দোয়ার শাব্দিক অর্থ ডাকা, আরাধনা, প্রার্থনা, জিকির। শরিয়তের পরিভাষায় মালিকের কাছে বিশেষ কোনো আবেদন, প্রার্থনার বা জিকরের নাম দোয়া। দোয়া উম্মতে মুহাম্মাদির ইবাদতের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। হজরত কাতাদাহ (রা.) কাবে আহ্বার থেকে বর্ণনা করেন, আগের যুগে শুধু নবীদেরই বলা হতো, দোয়া করুন, আমি কবুল করব। এ আদেশ উম্মতে মোহাম্মাদির জন্য ব্যাপক করে দেয়া হয়েছে, যা শুধু উম্মতে মোহাম্মদিরই বৈশিষ্ট্য। (ইবনে কাসির ৪ : ৮৫)। পবিত্র কালামুল্লাহ শরিফে এরশাদ হয়েছে, তোমাদের প্রতিপালক বলেছেন, 'তোমরা আমার কাছে দোয়া করো, আমি তোমাদের দোয়া কবুল করব। নিশ্চয় যারা আমার ইবাদতে অহঙ্কার করে, তারা লাঞ্ছিত হয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।' (সূরা মোমিন : ৬০)। এ আয়াতে বান্দাদের আল্লাহপাকের কাছে প্রার্থনা করার আদেশ দেয়া হয়েছে এবং আল্লাহপাক তা পূরণের ওয়াদা দিয়েছেন। আর যারা অহঙ্কার এবং নিজেকে বড় ও বেপরোয়া মনে করে দোয়া ত্যাগ করবে, তাদের কঠোর আজাবের হুমকি দেয়া হয়েছে। সূরা আরাফের ৫৫নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, 'তোমরা স্বীয় প্রভুর কাছে দোয়া করো, অক্ষমতা ও নম্রতা প্রকাশ করে এবং গোপনে, নিশ্চয় আল্লাহপাক সীমা লঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করেন না।' এ আয়াতে দোয়ার দুটি গুরুত্বপূর্ণ আদব বর্ণিত হয়েছে। এক. অক্ষমতা, বিনয় ও নম্রতা প্রকাশ করে দোয়া করা। দুই. অনুচ্চস্বরে দোয়া করা। হজরত আবু বকর জাসসাস আহকামুল কোরআন গ্রন্থে বলেন, এ আয়াত থেকে জানা যায়, নীরবে দোয়া করা উচ্চৈঃস্বরে দোয়ার চেয়ে উত্তম। আল্লামা ইবনে কাসির এ আয়াতের শানে নজুল বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেছেন, একজন বেদুইন রাসুলুল্লাহ (সা.) কে জিজ্ঞেস করেছেন, যদি আমাদের প্রভু আমাদের কাছেই থাকেন, তাহলে আমরা নিম্নস্বরে দোয়া করব, আর যদি দূরে থাকেন, তাহলে উচ্চৈঃস্বরে দোয়া করব। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আয়াতটি অবতীর্ণ হয়েছে। (তাফসিরে ইবনে কাসির : ১-২১৮)। অর্থাৎ আল্লাহপাক বলেন, আমি তোমাদের অতি কাছে। তোমরা আমার কাছে দোয়া করো, আমি তোমাদের দোয়া কবুল করব। এছাড়া অসংখ্য হাদিসে দোয়ার গুরুত্ব ও ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। যেমন- হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, 'আল্লাহর কাছে দোয়ার চেয়ে অধিক সম্মানিত কোনো বস্তু নেই।' (তিরমিজি : ২-১৭৩)। অন্য এক হাদিসে হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, 'যে আল্লাহর কাছে দোয়া করে না, আল্লাহ তায়ালা তার প্রতি রুষ্ট হন।' (তিরমিজি : ২-১৭৩)। অন্যত্র হজরত ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, 'তোমাদের মধ্য থেকে আল্লাহপাক যার জন্য দোয়ার দরজা খুলে দিয়েছেন, অর্থাৎ যাকে দোয়া করার তৌফিক দান করেছেন তার জন্য আল্লাহ স্বীয় রহমতের দরজা খুলে দিয়েছেন। আল্লাহর কাছে অধিক পছন্দনীয় দোয়া হলো, দুনিয়া ও আখেরাতের নিরাপত্তার দোয়া।' (তিরমিজি : ২/১৯৩)। হজরত ছাওবান (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন, 'দোয়া ব্যতীত কোনো জিনিস তাকদিরের ফয়সালাকে পরিবর্তন করতে পারে না এবং নেক আমল ব্যতীত কোনো জিনিস বয়সকে বাড়াতে পারে না।' (মুসতাদরাক : ১-৪৯৩)। আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করে দোয়া করলে তকদিরের লিখিত বালা-মুসিবতও দূর হয়ে যায়। এতে প্রমাণিত হয় যে, দোয়ার কার্যকারিতা অনেক বড়। অন্য এক হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, 'দোয়া হলো মোমিনের হাতিয়ার, দ্বীনের স্তম্ভ এবং আসমান ও জমিনের নূর।' (মুসতাদরাক : ১-৪৯২)। অন্য এক হাদিসে এসেছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, নবী করিম (সা.) এরশাদ করেছেন, 'যে ব্যক্তি আশা করে, যেন আল্লাহপাক তার বিপদ ও মসিবতের সময় তার দোয়া কবুল করুন, তাহলে সে যেন আনন্দ ও সচ্ছলতার সময় বেশি বেশি দোয়া করে।' (তিরমিজি : ২-১৭৪)। এছাড়া বিভিন্ন হাদিসে দোয়ার অনেক আদব বর্ণিত হয়েছে, যেগুলোকে দোয়ার সময় অনুসরণ করা বাঞ্ছনীয়। ইমাম গাজালি (রহ.) ইহয়াউল উলুম গ্রন্থে 'আদাবুত দোয়া' অধ্যায়ে দোয়ার ১০টি আদব বর্ণনা করেছেন। তা হলো- ১. উত্তম দিনগুলোতে দোয়া করা। যেমন- আরাফার দিন, জুমার দিন এবং রমজান মাসের যে কোনো দিন ইত্যাদি। ২. উত্তম সময়গুলোতে দোয়া করা। যেমন- রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আজান এবং একামতের মধ্যবর্তী সময়ে দোয়া বিফলে যায় না। এ ধরনের যত গুরুত্বপূর্ণ সময় রয়েছে সে সময়ে দোয়া করা। ৩. কেবলামুখী হয়ে দোয়া করা এবং বগলের নিচ দেখা যায় এ পরিমাণ দুই হাত উঠিয়ে দোয়া করা। ৪. অনুচ্চস্বরে দোয়া করা। ৫. দোয়া অন্তমিলযুক্ত বাক্য ব্যবহার না করা। ৬. অত্যন্ত অনুনয় ও নম্রতার সঙ্গে দোয়া করা। ৭. দোয়াকে আবশ্যকীয় মনে করে দোয়া করা এবং দোয়া কবুলের ব্যাপারে অন্তরে পূর্ণ বিশ্বাস রাখা। ৮. দোয়ার বাক্যগুলোকে বারবার তেলাওয়াত করা। ৯. আল্লাহর জিকিরের মাধ্যমে দোয়া শুরু করা। ১০. দশ নম্বর আদবটি অন্তরের সঙ্গে সম্পৃক্ত, এটির ওপর দোয়া কবুল হওয়া অনেকটা নির্ভরশীল। তা হচ্ছে, আগের গোনাহের ওপর অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে তওবা করা, জুলুমকে পরিত্যাগ করা এবং আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করা। (ইহয়াউল উলুম : ১-৪০৭)।

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়