মাওলানা মুশাহিদ দেওয়ান:
চৈত্রের এ ভরদুপুরে তৃষ্ণার্ত হৃদয় একবিন্দু পানি পেলে আনন্দে নেচে ওঠে। খেতখামারে উদ্ভিদ-গুল্ম আকাশপানে তাকিয়ে বৃষ্টির অপেক্ষায় আছে। পানির সঙ্গে আমাদের জীবনমরণ সম্পর্ক। প্রকৃতির সি্নগ্ধ আলো-বাতাস যেমন জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য, ঠিক তদ্রূপ পানিও অপরিহার্য। পানি আমাদের জীবন চলার পথে একান্ত বন্ধু। জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি পানির সঙ্গে নিগূঢ় নিশ্ছিদ্র সম্পর্ক রয়েছে। এ অত্যাবশ্যকীয় পানি মহান আল্লাহর অফুরন্ত নেয়ামত, মানবজাতির প্রতি তার অসীম রহমত। প্রতি মুহূর্তে আমরা পানি পান ও নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহার করছি। সবকাজেই পানির ব্যবহার হয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'তিনিই আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেন, তোমরা তা পান করো এবং তা থেকেই উদ্ভিদ উৎপন্ন হয়। তাতে তোমরা পশু চরাও।' (সূরা নাহল : ১০)।
গৃহিণীদের রান্না থেকে শুরু করে সবকাজই সম্পন্ন হয় পানি দিয়ে। বিশ্বের সবুজ জলজ ঐতিহ্যের মৌলিক উপাদান হচ্ছে নদনদী ও বৃষ্টির পানি। পানির অফুরন্ত সিঞ্চনে এ সবুজ মেলার নবোদয় হয়। পানির সুবাদেই সবুজ পৃথিবী জীবন্ত হয়ে ওঠে, বৃক্ষরাজি হয় সতেজ ও প্রাণময়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'তিনিই স্বীয় অনুগ্রহে সুসংবাদবাহীরূপে বায়ু প্রেরণ করেন এবং আমি আকাশ থেকে বিশুদ্ধ পানি বর্ষণ করি, যা দিয়ে আমি মৃত ভূখ-কে জীবিত করি এবং আমার সৃষ্টির মধ্যে বহু জীবজন্তু ও মানুষকে তা পান করাই এবং আমি এ পানি তাদের মধ্যে বিতরণ করি, যাতে তারা স্মরণ করে। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ কেবল অকৃতজ্ঞতাই প্রকাশ করে।' (সূরা ফোরকান : ৪৮-৫০)।
আকাশ থেকে বর্ষিত পানি আর ভূতলের সঞ্চিত পানির গুণেই ফসল উৎপন্ন হয়। বিশ্ব অধিপতি আল্লাহ তায়ালা এ সম্পর্কে বলেন, 'তিনি পানি দ্বারা ফসল, জয়তুন, খেজুর, আঙুর এবং সব ধরনের ফল উৎপন্ন করেন। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল লোকের জন্য নিদর্শন রয়েছে।' (সূরা নাহল : ১১)।
ঠিক এ বিষয়টিকেই অন্যত্র আল্লাহ তায়ালা এভাবে বলেন, 'এবং আমি পরিপূর্ণ মেঘমালা থেকে প্রচুর পানি বর্ষণ করি যেন আমি সেই পানি দ্বারা উৎপন্ন করি শস্য ও শাকসবজি এবং নিবিড় উদ্যানরাজি।' (সূরা নাবা : ১৪-১৬)।
জগতের সবকিছুই পানির মাধ্যমে বেঁচে আছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, আমি পানি দিয়ে প্রত্যেক প্রাণ জীবন্ত করেছি। তবুও কি তারা ঈমান আনবে না?' (সূরা আম্বিয়া : ৩০)।
আল্লাহর নেয়ামত পানির গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা বলে শেষ করা যাবে না। সাগর, মহাসাগর ও সমুদ্রে কোটি কোটি টন পানি স্বাচ্ছন্দ্যে প্রবাহিত হচ্ছে। তাতে মাছ ও জলজ প্রাণী বিচরণ করে। পানির সুবাদে জলপথে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। সমুদ্র পথে লঞ্চ, জাহাজ ও স্টিমার প্রভৃতি জলযানে রফতানি ও আমদানিসহ যাতায়াত ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয়ে আসছে সেই প্রাচীনকাল থেকেই। পবিত্র কোরআনে এ অনুগ্রহকে আল্লাহ তায়ালা এভাবে বর্ণনা করেন, 'এবং তুমি তাতে (সমুদ্রে) পানি বিদীর্ণ করে নৌকা চলতে দেখ এবং যাতে তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করতে পার এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার করো।' (সূরা নাহল : ১৪)।
একজন সুস্থ মানুষ প্রতিদিন সাধারণত দুই লিটার পানি পান করে। ৬০ বছরের জীবনে ৪৩ হাজার ৮০০ লিটার পানি শুধু এক ব্যক্তিই পান করে। সে হিসাবে পৃথিবীর প্রায় ৭০০ কোটি মানুষ গড়ে কী পরিমাণ পানি পান করছে তা চিন্তা করলে বিস্মিত হতে হয়। এ মহান নেয়ামত আল্লাহ তায়ালা বান্দাদের বিনা প্রতিদানে দিয়ে যাচ্ছেন। অথচ দুনিয়ার মানুষ শত চেষ্টা করেও এক গ্লাস বিশুদ্ধ পানি তৈরি করতে পারবে না। প্রাণপণ ঐকান্তিক চেষ্টা করেও আকাশ থেকে এক ফোঁটা পানি নামাতে পারবে না। এতে মহান শক্তিধর আল্লাহ তায়ালার একক প্রভুত্ব প্রকাশ পায়। সুতরাং আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা ব্যতীত আর কোনো পথ নেই। অত্যন্ত চমৎকার ভঙ্গিমায় এ বিষয়টিই ফুটে উঠেছে আল্লাহর বাণীতে, 'তোমরা যে পানি পান করো সে সম্পর্কে কি ভেবে দেখেছ? তা কি তোমরাই মেঘমালা থেকে নামিয়ে আনো নাকি আমি বর্ষণ করি? আমি ইচ্ছা করলে তা লবণাক্ত করে দিতে পারি। (তখন কিন্তু পান করতে পারবে না!) তবুও তোমরা কেন কতৃজ্ঞতা প্রকাশ করো না?' (সূরা ওয়াকিয়া : ৬৮-৭০)।
জ্ঞানী সমাজের চিন্তার বিষয়, যদি পৃথিবীর সব পানি অপেয় ও অব্যবহার্য করে দেয়া হয় তাহলে আমাদের অবস্থা কী হবে? আমরা কীভাবে বাঁচব? সুতরাং এ নেয়ামতের যথাযথ ব্যবহার ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা একান্ত আবশ্যক। আর পানি যেহেতু নেয়ামত, তাই পানির সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। যথেচ্ছ ব্যবহার ও অপচয় রোধ করতে হবে। অনেক পরিবারে দেখা যায়, গৃহিণী বা ছোট বাচ্চারা অনর্থক পানি অপচয় করে। প্রয়োজনীয় ব্যবহারের তুলনায় অনেক পানি নষ্ট করে।
ঢাকায় পানির তীব্র সঙ্কট। ওয়াসার তথ্য মতে, প্রতিদিন যে পরিমাণ পানি উত্তোলন করা হচ্ছে, তাতে দ্রুত ভূতল শুকিয়ে যাবে। পানি বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এভাবে প্রচুর পানি তোলা হলে ঢাকা সিটি যে কোনো সময় তলিয়ে যেতে পারে। সুতরাং অপচয় প্রতিরোধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রচার মাধ্যমে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। একইসঙ্গে সমাজের বিত্তবানদের উচিত বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় সহায়তা করা।
বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। এখানে বিশুদ্ধ পানির তীব্র সঙ্কট। তারা বিশুদ্ধ পানি পাচ্ছে না। নলকূপ নেই। মফস্বল এলাকার অধিকাংশ বাড়িতেই নিরাপদ পানির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নেই। আর্সেনিকমুক্ত পানির অভাবে সাধারণ মানুষ রোগাক্রান্ত হচ্ছে। ধনীরা ইচ্ছা করলেই এসব মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসতে পারে। এসব দরিদ্রের বাড়িতে নলকূপ স্থাপন করে দেয়া আমাদের নৈতিক ও ঈমানি দায়িত্ব।
এ জাতীয় জনহিতকর কাজ সদকায়ে জারিয়া হিসেবে গণ্য হবে। ওসমান (রা.) মুসলিম সমাজের জন্য অনেক কূপ খনন করে দিয়েছিলেন। ইহুদিদের কূপ কিনে বিনামূল্যে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করেন। পানির ব্যবস্থা করা অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ একটি আমল। একজন নলকূপদাতা মৃত্যুপরবর্তী সময়ও নেকি পেতে থাকবেন, যতদিন এ নলকূপ থেকে মানুষ পানি পান করবে।
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়