মো. আবদুর রহমান:
আধুনিক যুগে নগরায়ণ ও সভ্যতা বিকাশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশ-বিদেশে ফুলের প্রয়োজনীয়তা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফুল এখন আর শুধু সৌন্দর্য ও সৌখিনতার সামগ্রীই নয়, বরং এটি এখন দেশের জাতীয় অর্থনীতি এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। বর্তমানে বিশ্বের অনেক দেশই বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ফুল চাষ, বিপণন ও ব্যবহার করছে। থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, হল্যান্ড প্রভৃতি দেশ অর্কিড রপ্তানি করে এবং পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ফুল রপ্তানিকারক দেশ নেদারল্যান্ডস টিউলিপ ফুল বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে থাকে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশেও বাণিজ্যিকভাবে অর্থকরী ফসল হিসেবে ফুল বিশেষ করে রজনীগন্ধা ও গোলাপ উৎপাদন ও বিদেশে রপ্তানি শুরু হয়েছে।
বাংলাদেশের যশোর জেলার ঝিকরগাছা, শার্শা, চৌগাছা ও সদর উপজেলা এবং কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ ও চুয়াডাঙ্গার জীবননগরে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে রজনীগন্ধার চাষ হচ্ছে। তাছাড়া সাতক্ষীরা, জয়দেবপুর, কুমিল্লা এবং চট্টগ্রামেও অল্পবিস্তর রজনীগন্ধার চাষ হয়। ইদানীং খুলনা জেলায়ও কিছু কিছু রজনীগন্ধা ও গোলাপ ফুলের চাষ শুরু হয়েছে। তাছাড়া ঢাকা জেলার সাভার, গাজীপুর, কালিয়াকৈর এবং যশোরে গোলাপ ফুলের ব্যাপক চাষ হয়। বিশ্ব জুড়ে চলছে এখন ফুলের বাণিজ্যিক উৎপাদন। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে টাটা ও বিড়লার মতো বড় মাপের ব্যবসায়ীরা বাণিজ্যিকভাবে ফুলের চাষ করছে। ভারতে ফুল চাষকে উৎসাহিত করার জন্য ভর্তুকি ব্যবস্থা আছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই ভর্তুকির পরিমাণ ৫০% পর্যন্ত হয়ে থাকে। বাণিজ্যিকভাবে ফুল উৎপাদনের লক্ষ্যে ভারতের মতো আমাদের দেশেও ভর্তুকি ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন।
এখন রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলা শহরে, এমনকি কোনো কোনো উপজেলা সদরেও তাজা ফুলের স্থায়ী দোকান গড়ে ওঠেছে। এই দোকানগুলোতে ঋতু বৈচিত্র্যের ফুলের পাশাপাশি বারো মাস রজনীগন্ধা, গোলাপ ও গাঁদা ফুল পাওয়া যায়। বিভিন্ন জাতীয় উৎসবগুলোতে এই দোকানগুলোতে ফুল ক্রয়ের জন্য ক্রেতাসাধারণের প্রচুর ভিড় পরিলক্ষিত হয়। এসব দোকানে ফুলের বিকিকিনি ভালো হয় বলে জানা যায়। এটি নিঃসন্দেহে দেশে ফুলের সমাদরের পরিচয়। বিদেশে বাংলাদেশের ফুলের বিশেষ করে রজনীগন্ধা ও গোলাপের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। সম্প্রতি লন্ডন, সিঙ্গাপুর, সৌদি আরব, হল্যান্ড এবং আবুধাবীতে বাংলাদেশ থেকে ফুল রপ্তানি করা হচ্ছে। কাজেই এ কথা বলা যায় যে, আমাদের দেশেও বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ব্যাপকভাবে ফুলের চাষ করে তা বিদেশে রপ্তানির উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে।
বাংলাদেশের মাটি ও জলবায়ু ফুল চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। গোলাপ, রজনীগন্ধা, ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা ও গাঁদা এদেশের কয়েকটি জনপ্রিয় ফুল। এদেশে নানা প্রকার মৌসুমি ফুল জন্মে থাকে। শীতের মৌসুমি ফুলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো এস্টার, এলিসাম, ক্যালেন্ডুলা, কসমস, কার্নেশান, কর্ণ ফ্লাওয়ার, চন্দ্রমল্লিকা, ডেইজী, ডায়ান্থাস, ডালিয়া, লার্কস্পার, গাঁদা, হলিহক, ন্যাস্টারসিয়াম, লুপিন, পপি, পর্টুলেকা, ভারবেনা, প্যান্সী, জিনিয়া, এন্টিরিনাম, সুইট পী, ফ্লক্স প্রভৃতি। মোরগজবা, বোতাম ফুল, দোপাটী, ক্লিওম, গাইলারডিয়া, মর্নিং গ্লোরী, অপরাজিতা, জিনিয়া, সন্ধ্যামনি, , গন্ধরাজ, টগর ইত্যাদি গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালের উল্লেখযোগ্য মৌসুমি ফুল। দীর্ঘজীবী ফুলের মধ্যে গোলাপ, সর্বজয়া, স্বর্ণচাপা, করবী, শেফালী, রঙ্গন, মাধবী, টগর, মালতি অপরাজিতা, জবা, বাগান বিলাস, পাতাবাহার, চামেলী বেলী, জুঁই, রজনীগন্ধা, মল্লিকা, গন্ধরাজ, দোলনচাঁপা, টগর, কামিনী, হাসনাহেনা, শিউলী, মুসান্ডা, বকুল, নয়নতারা প্রভৃতি অন্যতম।
আন্তর্জাতিক বাজারে ফুলের চাহিদা ব্যাপক এবং প্রতি বছরই এই চাহিদা বাড়ছে। সে তুলনায় সরবরাহ কম। এক তথ্যে জানা যায়, বিশ্বে প্রতি বছর গড়ে আড়াই হাজার কোটি ডলার মূল্যের ফুল বেচাকেনা হয়। ফুল রপ্তানির দিক থেকে বাংলাদেশ পৃথিবীর অনেক দেশের চেয়ে বেশি পিছিয়ে আছে। বাংলাদেশের চেয়ে ক্ষুদ্র রাষ্ট্র ইসরাইল ফুল রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রায় যে পরিমাণ অর্থ প্রতি বছর আয় করে থাকে, তা বহু উন্নয়নশীল দেশের রপ্তানি বাণিজ্যের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রতি বছর ফুল রপ্তানি করে কোটি কোটি রুপি আয় করছে। তাদের অভ্যন্তরীণ বাজারও বিশাল। আমাদের দেশে উৎপাদিত ফুলের আকার, রঙ, গন্ধ স্থায়িত্ব ও সৌন্দর্য অপেক্ষাকৃত উন্নত। তাই বিদেশে বাংলাদেশের ফুলের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। একটু চেষ্টা করলেই বিশ্ববাজারে এ দেশের উৎপাদিত ফুল স্থান করে নিতে পারে। এ জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা খুবই প্রয়োজন।
ফুলের বাণিজ্যিক চাষ ও ফুল রপ্তানি বাংলাদেশের রপ্তানি আয়কে উজ্জীবিত করতে পারে। কাজেই আমাদের দেশেও বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ব্যাপকভাবে ফুল উৎপাদন করে তা বিদেশে রপ্তানির ব্যবস্থা আরো জোরদার করা আবশ্যক। এতে একদিকে যেমন দেশে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হবে, অপরদিকে অনেক বেকার মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি এবং আয়ের পথ সুগম হবে, যা দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ও গ্রামীণ দারিদ্র্য বিমোচনে বিরাট অবদান রাখবে।
লেখক : উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা, উপজেলা কৃষি অফিস, রূপসা, খুলনা
খবর বিভাগঃ
কৃষি বার্তা
ফিচার
বিশেষ খবর
সাফল্য
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়