Tuesday, December 16

ব্রিটিশ চলচ্চিত্র নির্মাতা থেকে কুইন অফ অ্যামাজন!


কানাইঘাট নিউজ ডেস্ক: সারা বেগম নামে ব্রিটিশ নারী সিনেমা নির্মাতা বিয়ে করেছেন ইকুয়েডরের অ্যামাজন বনাঞ্চলের এক গোত্রীয় যোদ্ধাকে। দানবীয় বহুজাতিক তেল কোম্পানিগুলো কিভাবে অ্যামাজনে ওই যোদ্ধার গোত্রীয় আবাসস্থলগুলো ধ্বংস করছে সে বিষয়টি বিশ্ব দরবারে ফুটিয়ে তোলার জন্যই এ বিয়ে করেন ওই ব্রিটিশ নারী ফিল্ম মেকার। ২১ বছর বয়সে সারা বেগম লন্ডন থেকে ইকুয়েডরের হুয়ারোনি গোত্রের জীবন যাত্রার ধরন নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম বানাতে ২ সপ্তাহের জন্য সেখানে যান। ইকুয়েডরের খনিজ সম্পদে ভরপুর রেইন ফরেস্ট অঞ্চলে বসবাসকারী ওই গোত্রের সদস্য সংখ্যা মাত্র ৩ হাজার। ব্রিটিশ চলচ্চিত্র নির্মাতা থেকে কুইন অফ অ্যামাজন! ১৯৫০ এর দশক থেকেই বহিরাগতদের সঙ্গে ওই গোত্রের সাপে-নেউলে সম্পর্ক ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের ধর্ম প্রচারকরা ওই গোত্রে তাদের মতবাদ প্রচার করতে গেলে তাদেরকে হত্যা করা হয়। কিন্তু সারা বেগম দাবি করেন তাকে তারা উষ্ণ অভ্যর্থনাই জানিয়েছে। গিঙ্কটো নামে ওই গোত্রের ৫০ বছর বয়সী এক যোদ্ধাকে বিয়েও করেন সারা। তাদের ওই বিয়ে ছিল বহুজাতিক দানবীয় তেল কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে বিশ্ব দরবারে সাহাজ্যের আবেদন জানানোর জন্য একটি প্রতিকী বিয়ে। বিয়ের পর সারাকে এক নগ্ন উৎসবের মাধ্যমে সম্বর্ধনা জানানো হয়। উৎসবে সারাকে আমেরিকান কাকাতুয়া পাখির পালক দিয়ে তৈরি একটি মুকুট উপহারের মাধ্যমে গোত্রের রানী হিসেবে বরণ করে নেওয়া হয়। সারা বলেন, প্রথমে আমার নগ্ন হতে ইচ্ছে করছিলো না। কারণ পুরো অনুষ্ঠানটি ভিডিও করা হচ্ছিল। অনুষ্ঠানের এক মুহূর্তে আমি পালিয়ে যাওয়ার কথাও ভাবছিলাম। ওই দুই সপ্তাহে সারা ঘাস দিয়ে কাপড় বোনা এবং বাঁকনল দিয়ে পশু শিকার করা শেখেন। অবশেষে গিঙ্কটো নামে ৫০ বছর বয়সী ওই গোত্রের সেরা যোদ্ধাকে বিয়ে করেন। গিঙ্কটো হুয়ারোনি উপভাষা এবং সামান্য স্প্যানিশ জানতেন। ব্রিটিশ চলচ্চিত্র নির্মাতা থেকে কুইন অফ অ্যামাজন! সারা ও গিঙ্কটোর বিয়ে ছিলো একটি প্রতিকী বিয়ে। ওই বিয়ের কোনো আইনগত বাধ্য-বাধকতা ছিলো না। কিন্তু ভাষাগত দূরত্বের কারণে তার সঙ্গে ঠিক কি ঘটতে যাচ্ছে তা প্রথমে বুঝতে পারেননি সারা। সারা বলেন, গোত্রের জেষ্ঠ্য সদস্যরা আমাকে পছন্দ করেন। কিন্তু আমার কোনো ধারনাই ছিল না যে আমার সঙ্গে কী ঘটতে যাচ্ছে। আমাকে একটি কুড়ে ঘরের ভেতরে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে উপস্থিত সকলেই নগ্ন ছিল। আমাকে বলা হয়েছিল যে, পরিধান করার জন্য তারা আমাকে তাদের গোত্রীয় ঐতিহ্যগত পোশাক দিবে। পোশাকটি ছিল গাছের বাকল থেকে তৈরি এক টুকরো সরু তন্তু মাত্র! সেটি কোমরের চারপাশে পেঁচিয়ে রেখে পরিধান করতে হয়! আমি প্রথেমে ভেবেছিলাম, নগ্ন হতে পারবো না। এক মুহূর্তে আমি পালিয়ে যাওয়ার কথাও ভাবছিলাম। কিন্তু আমি তাদের ঐতিহ্য পুরোপুরি হৃদয়ঙ্গম করা এবং বুঝতেও আগ্রহী ছিলাম। সেখানে উপস্থিত নারীদের একজন এসে আমার আন্ডারওয়্যার খুলে ফেললেন। এরপর আমাকে ওই কুড়ে ঘরের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হলো। গোত্রের বয়জেষ্ঠ্য নেতারা গান গাইছিল আর নারীরা চিচা নামে এক ধরনের পানীয় তৈরি করছিল। ব্রিটিশ চলচ্চিত্র নির্মাতা থেকে কুইন অফ অ্যামাজন! সারা বেগম ওই গোত্রে তার ভ্রমণ সংক্রান্ত পুরো ঘটনাটি ভিডিও করে একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম তৈরি করেন। গত বছর ফ্রান্সের কান চলচ্চিত্র উৎসবে ওই ডকুমেন্টারি ফিল্মটি প্রদর্শন করা হয়। সারা বেগম বলেন, আমি পুরোপুরি নগ্ন হয়ে তাদের সঙ্গে যোগ দেওয়ায় এবং কাকাতুয়া পাখির পালক দিয়ে নিজেই নিজের জন্য একটি মুকুট তৈরি করায় ওই গোত্রের সদস্যরা খুবই খুশি হয়। আমাকে বলা হয় যে, তারা আমাকে তাদের রানী বানতে যাচ্ছে। গোত্রের নারী ও যোদ্ধারা আমাকে ঘিরে গান গাইছিল এবং নাচছিল। আমার মনে হচ্ছিল আমাকে রানী হিসেবে অভিষিক্ত করা হচ্ছে। এরপর তারা আমাকে চিচা পান করতে দেয়। আর তাদের ভাষায় আমার নামকরন করা হয় ইমাকা। এরপর গোত্রের সবচেয়ে বিখ্যাত যোদ্ধা গিঙ্কটোর সঙ্গে আমার প্রতীকি বিয়ে হয়। কিন্তু আমার সঙ্গে ঠিক কী ঘটতে যাচ্ছে সে ব্যাপারে আমার কোনো ধারনাই ছিল না। প্রথমে আমি ভেবেছিলাম তারা আমাকে শুধুমাত্র তাদের রানী হিসেবে অভিষিক্ত করার জন্যই ওই উৎসবের আয়োজন করেছিল। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই আমি আমার পাশে এক ব্যাক্তিকে দেখতে পাই। সে আমার চারপাশে তার অস্ত্র দিয়ে ঘিরে ধরে। পুরো ঘটনাটাই আমার কাছে পরাবাস্তব মনে হচ্ছিল। সারা বলেন, এ ঘটনায় তিনি প্রথমে মানসিকভাবে একটা ধাক্কা খান। তবে তাকে পরে খোলাসা করে বলা হয় যে, বিয়ে করলে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে তেমন কোনো বাধ্য-বাধকতা নেই। বরং গোত্রের সঙ্গে বিশ্বস্ত সম্পর্ক স্থাপনের জন্য এটি একটি প্রতীকি বিয়ে। সারা বলেন, তারা জানতো আমি সেখানে কেনো গিয়েছিলাম। আর তারাও আমাকে দেখাতে চেয়েছিল তারা কীভাবে জীবন যাপন করেন। গিঙ্কটো ভালোবাসার যোগ্য পাত্র ছিল। সে ছিল খুবই শক্তিশালি শিকারি। আর এ কারণে গোত্রের নারীদের মধ্যে তার ব্যাপক জনপ্রিয়তা ছিল। গিঙ্কটো খুবই কৌতুকপ্রবণ এবং লন্ডনে আমার জীবন যাত্রার ধরন সম্পর্কেও জানতে আগ্রহী ছিল। গিঙ্কটোর সঙ্গে আমি আমার স্প্যানিশভাষী ক্যামেরা ম্যান এবং ওই গোত্রের স্প্যানিশভাষী আরেক যোদ্ধার মাধ্যমে যোগাযোগ করতাম। সে আমার বাবা-মা, পরিবার এবং বন্ধুদের সম্পর্কে জানতে চায়। ব্রিটিশ চলচ্চিত্র নির্মাতা থেকে কুইন অফ অ্যামাজন! উল্লেখ্য, বিগত বেশ কয়েকবছর যাবৎ ওই গোত্রের আতিথ্য গ্রহণকারী অসংখ্য পরিবেশ-পর্যটক এবং ডকুমেন্টারি সিনেমা নির্মেতাদের একজন সারা বেগম। তবে এই ধরনের বিয়ের উৎসব খুবই বিরল ঘটনা। তবে গিঙ্কটো সারাকে ছাড়াও আরো একজন ব্রিটিশ নারীকে বিয়ে করেছেন। দুই বছর আগে ওই যোদ্ধা ক্যারেন মরিস-ল্যাঞ্জ নামে মিল্টন কেইনস এর এক স্বামীহীন মাকে বিয়ে করেন। ক্যারেন বিবিসি’র জন্য বিয়ে সংক্রান্ত একটি ডকুমেন্টারি বানানোর জন্য ওই গ্রামে এক সংক্ষিপ্ত সফরে গিয়েছিলেন। সারা বেগম বলেন, গিঙ্কটো আর আমি পরস্পরের ভালো বন্ধু বনে যাই। আমরা পরস্পরের সঙ্গে এখন প্রচুর কৌতুক বিনিময় করতাম। সারা জানান, তিনি নয় বছর বয়স থেকেই অ্যামাজানের গভীর জঙ্গলে ভ্রমণে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। হুয়ারোনি গোত্রের আবাসস্থল থেকে ইকুয়েডরের সবচেয়ে কাছের শহরটিতে নৌকায় করে যেতে অন্তত দুই দিন লাগে। বর্তমানে ২৬ বছর বয়সী সারা বেগম তার ওই অসাধারণ রোমাঞ্চকর ভ্রমণ অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি আধা ঘন্টার ডকুমেন্টারি ফিল্ম তৈরি করেছেন। অ্যামাজান সৌলস নামের ওই সিনেমাটি গত বছর কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়েছে। প্রসঙ্গত, হুয়ারোনি গোত্র যে এলাকায় বসবাস করে তার মাটির নিচে দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে বেশি তেলের রিজার্ভ রয়েছে। ১৯৫৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকজন খ্রিস্টান মিশনারি সেখানে নিজেদের ধর্মীয় মতবাদ প্রচার করতে গেলে হুয়ারোনি গ্রামের বাসিন্দারা পাঁচ ধর্মপ্রচারককে প্রকাশ্যে হত্যা করেন। এরপর থেকে আর কেউ হুয়ারোনি গোত্রে যাওয়ার সাহস করেনি। সারা বেগমই সর্বপ্রথম হুয়ারোনি গোত্রের জীবন যাপন নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ তথ্য চিত্র নির্মাণ করে তা বিশ্ব দরবারে তুলে ধরতে সক্ষম হন। তবে বর্তমানে বহির্বিশ্বের সঙ্গে ওই গোত্রের ব্যাপক যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। এমনকি গোত্রের অনেক সদস্য পশ্চিমা পোশাক-আশাক পরাও শুরু করেছেন। ইকুয়েডরের ওই রেইন ফরেস্ট এলাকার মাটির নিচে প্রচুর তেল ও খনিজ সম্পদের মজুদ রয়েছে। এছাড়া অনেক বহিরাগত ওই বন থেকে অবৈধভাবে কাঠ আহরন করে থাকে। আর জনসংখ্যা বাড়ার কারণে গোত্রের সদস্যদের মধ্যে জমি নিয়ে বিরোধও বেড়েছে। এছাড়া হুয়ারোনি অঞ্চলের সঙ্গে বহির্বিশ্বের যোগাযোগ স্থাপনের জন্য বেশ কয়েকটি রাস্তাও তৈরি করা হয়েছে। রানী সারা বেগম এখনো ই-মেইল এবং ফেসবুকে ওই গোত্রের সদস্যদের সঙ্গে প্রায়ই যোগাযোগ করে থাকেন। আর সময় পেলে পুনরায় ওই গোত্রের সঙ্গে বসবাসের আগ্রহও প্রকাশ করেন রানী সারা বেগম।

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়