Tuesday, October 28

প্রতিবন্ধী বাহার এখন ক্ষুদে বিজ্ঞানী

দেলোয়ার হোসেন সেলিম/মাহবুবুর রশিদ:
শারিরীক প্রতিবন্ধীরা আজ সমাজের বোঝা নয়, তারা সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। প্রতিবন্ধী মানুষেরাও উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় সম্পৃক্ত হতে পারেন। তারই প্রমান বাহার উদ্দিন। শারিরীক প্রতিবন্ধী হলেও সাফল্য ধরা দিচ্ছে তার ভাগ্যে। একটু সহাভূতি পেলে বাহার বড় কিছু করতে পারবেন, এমন আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন দেশের নাম করা প্রোগামার কম্পিউটার বিজ্ঞানী মোস্তফা জব্বার । সম্প্রতি বাহারের কুইক লাক কম্পিউটার একাডেমীর সনদ বিতরণ অনুষ্ঠানে এসেছিলেন তিনি। শারিরীক প্রতিবন্ধী বাহার উদ্দিন আকুতিভরে বলেন,যারা আজ প্রতিবন্ধী হিসেবে সমাজে বা পরিবারের অবহেলার শিকার, হচ্ছেন নানা ভাবে এবং বঞ্চনার শিকরে পরিনত হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন, সেই সকল মানুষদের দিকে আপনারা যারা সূস্থভাবে বেচে আছেন, তারা যেন হাতটা প্রসারিত করেন। বাহার শারিরীক প্রতিবন্ধী হয়েও পড়াশোনা শিখে ব্যক্তিগত জীবনে যতেষ্ট দতার পরিচয় রেখে চলেছেন।সূপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘঠিয়ে একজন যোগ্য ও সাবলম্ভী নাগরিকরুপে যতেষ্ট ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি আরো বলেন, প্রতিবন্ধীরাও আপনাদের মতো মানুষ। আমাদের মন ও শরীর দুই আছে। মানবিক গুনাবলিতে সমৃদ্ধ প্রতিবন্ধীদের ও আশা আকাংখা,সাধ আহলাদ ও আত্বসম্মানবোধ আছে। তাই তারা সমাজে মানুষের তো বাচতে চায়। জীবন সংগ্রামে টিকে থাকতে শারিরীক প্রতিবন্ধী বাহার বেচে নিয়েছেন এক অনন্য এবং যোগপযোগী পেশা। কম্পিটার শেখানোর কাজ। এক কথায় বলা যায় কম্পিউটার প্রশিক্ষক। প্রতিদিন গড়ে ৫/৬ জন তরুন,যুবক ও শিতি বেকার লোকজনকে কম্পিউটার শেখাচ্ছেন তিনি। এতে স্বল্প খরচে স্থানীয় প্রশিনার্থীরা যেমনি উপকৃত হচ্ছেন, তেমনি ঘরে বসে বাহার প্রতিমাসে কয়েক হাজার টাকা উপার্জন ও করছেন। কঠোর পরিশ্রমী ও উদ্যমী বাহারের বাড়ী সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার বানিগ্রামে। বয়স আনুমানিক ২৮ বছর। সম্প্রতি তার গ্রামের বাড়ীতে গিয়ে আলাপকালে জানা গেছে, ছোটবেলায় এক অজ্ঞাত রোগে তার ২টি পা পঙ্গু হয়ে যায়। বাবার আর্থীক অসচ্ছলতার জন্যে সু চিকিৎসার অভাবে এই র্নিমম ভাগ্য মেনে নিতে হয় তার। তিনি অনেক প্রতিকুলতার মধ্যে মাধ্যমিক পর্যায়ে পড়াশোনা শেষ করে কম্পিউটার গ্রাফিকস্ এবং মাল্টিমিডিয়ার কাজ শেখেন। এরপর উর্পাজন করতে আর দামায় কে? ঢাকাস্থ মিরপুর সিআরপি থেকে ২০০৫ সালে উল্লেখিত বিষয়ে প্রশিন নিয়ে আজ ঘরে বসে তিনি বৈধভাবে আয় উপার্জন করছেন। এখানে তার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি এবং কর্মতৎপরতা তুলে ধরা হলো-  
পরিচিতিঃ 
বাহার উদ্দিন, পিতা মৃত আব্দুল গনী, মাতা মৃত আখতারুন নেছা। জন্ম ১৯৮৩ সালের ১১জুন। সিলেট জেলার কানাইঘাট উপজেলার বানীগ্রামের অধিবাসী। ব্যক্তি জীবনে তিনি ১ সন্তানের জনক। তার প্রিয় একমাত্র কন্যা সন্তানের নাম মাহিনা বাহার সাকি। সহধর্মীনি রুমানা বেগম ও আন্তীয় স্বজনদের নিয়ে জীবন অতিবাহিত করছেন। ১৯৮৯ সালে অজ্ঞাত রোগে আক্রান্ত হয়ে, উন্নত চিকিৎসার অভাবে তার ২টি পা পঙ্গু হয়ে যায়। দেশের ভেতরে অনেক চিকিৎসা করে তার কোন সুফল হয়নি।
 কিভাবে শিক্ষা অর্জনঃ 
প্রতিবন্ধীতাকে জয় করার জন্যে তার মন গর্জে ওঠে। প্রথমে বাড়ীর এবং প্রতিবেশীর বাড়ীর ছেলে মেয়েদের সাথে গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে যেতে থাকেন। স্কুলে গিয়ে শ্রেণী কক্ষে নিরবে মাঠিতে বসে থাকতেন। কোন শিক্ষক তাকে লেখা পড়ার বিষয়ে কোন কথা বলতেন না। আস পাশের ছেলে মেয়েদের কাছ থেকে তিনি অর জ্ঞান অর্জন করেন। এভাবে শিক্ষিত সচেতন নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠতে সেচ্ছায় স্কুলে যাওয়া আসা করেন। প্রতিনিয়ত অন্তত ১৫/২০মিনিট আঁকা বাঁকা মেঠো পথ অতিক্রম করতে হতো। একজন সহকারি শিক্ষক তাকে প্রথম শ্রেণীর ১সেট বই উপহার দেন। এ থেকে তার শিক্ষা জীবনের সূচনা। বর্ষা মৌসুমে তার স্কুলে যাতায়াত একেবারে বন্ধ থাকতো। এভাবেই অনেক কষ্টের বিনিময়ে পাঁচটি বছর লেখা পড়া করে ৫ম শ্রেণী পাশ করেন। এরপর গাছবাড়ী মডার্ণ একাডেমীতে গিয়ে প্রধান শিক্ষকের সাথে পরামর্শ করে ৬ষ্ট শ্রেণীতে ভর্তি হন। এ প্রতিষ্টানের দূরুত্ব তার বাড়ী থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার। সেখানে যাওয়া আসায় প্রায় ২ ঘন্টা সময় লাগতো। বহু কষ্টের বিনিময়ে ১৯৯৯ সালে এস এস সি পাশ করে ১৯৯৯-২০০০ইং শিক্ষা বর্ষে নিকটস্থ গাছবাড়ী আইডিয়্যাল কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু কলেজ জীবনের শিক্ষা শেষ হতে না হতেই নিয়তির করুণ পরিনতিতে তার ২টি হাতে প্রবল ব্যাথা দেখা দেয়। তাই ডাক্তারের পরামর্শে তাকে দীর্ঘ ২ বছর বিশ্রামে থাকতে হয়। এ কারনে উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অর্জন করা সম্ভব হয়নি। লেখাপড়া বন্ধ করে অসহায় জীবন যাপন করতে থাকেন। প্রায় ২ বছর চিকিৎসা করে তার ২টি হাত একটু সুস্থ হয়ে আবার বাংলাদেশ অপেন ইউনিভার্সিটিতে ২০০৩-২০০৪ শিাবর্ষে এইচ এস সি প্রোগ্রামে ভর্তি হন। কিন্তু শারিরীক অসুস্থতার জন্যে কোন ভাবেই ফাইন্যাল পরীায় অংশ নিতে পারেননি। পরবর্তিতে বৃটেনের নাগরিক বেলুরীর প্রতিষ্টান ঢাকা মিরপুর (১৪) সিআরপিতে কম্পিউটার প্রশিক্ষণে ভর্তি হন। কৃতিত্তের সাথে কম্পিউটার গ্রাফিক্র ও অফিস কোর্স সম্পূর্ণ করেন।তিনি পর্যায়ক্রমে সিলেট যুব উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে মোবাইল ইন্জিনিয়ারিং কোর্স, কানাইঘাট উপজেলা যুব উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে মাসব্যাপী মৎস্য প্রশিন কোর্স সম্পন্ন করেন। আবার তার ২টি হাতে বড় আকারে রোগ দেখাদেয়। তাই ইচ্ছা থাকা সত্বেও তিনি আর কোন প্রশিক্ষণ গ্রহন করতে পারেননি। সুষ্ঠু চিকিৎসার জন্য দৌঁড়যাঁপ শুরু করেন। চলতে থাকে একটানা চিকিৎসা।এর ফাঁকে ঘরে বসে কিছু সহায়ক বই র্চচা করে কম্পিউটার হার্ডওয়ারের কাজ, ভিডিও এডিটিং এবং ইন্টারনেটের কাজ অনেকটা আয়ত্ব করেন এবং স্থানীয় ব্যবসায়িক কয়েকটি প্রতিষ্টানের টুকিটাকি কাজ করতে থাকেন। সুন্দরভাবে এ ধরনের কাজসমূহ দেখে এলাকার অনেক বেকার, শিক্ষিত যুবক তার কাছ থেকে এসব কাজ শেখার জন্য আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এক পর্যায়ে তিনি বাড়ীতে “কুইক লাক কম্পিউটার একাডেমী” নামের একটি প্রশিন মূলক প্রতিষ্টান গড়ে তুলেন। ২০০৮ সালের মাঝা মাঝী সময় থেকে এ পর্যন্ত অর্ধ শত জন প্রশিক্ষনার্থী প্রশিক্ষ নিয়েছেন। এর মধ্যে ২০-২৫ জন প্রশিক্ষনার্থী বিদেশে চাকুরি লাভ করেছেন। কেউ আবার এ প্রতিষ্টান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে বিভিন্ন ব্যবসা বানিজ্য পরিচালনা করছেন। কেউবা আবার পারিবারিক ও ব্যক্তিগত ভাবে কম্পিউটার চালাচ্ছেন।  
যেভাবে চাকুরি করেনঃ 
  ২০০৫ সালে সিলেট গনউন্নয়ন গ্রন্তাগার (সিডিএল) এ কম্পিটার অপারেটর এবং নিউজ কাটিং এর কাজে নিয়োগ লাভ করেন। কিন্ত শারিরীক অসুবিধার কারনে এই চাকুরি ছেড়ে দিতে হয়। আবার ২০০৭ সালে ১জানুয়ারী সিলেট গ্রীণডিস্এ্যাবল্ড ফাউন্ডেশন (জি,ডি,এফ) এ শারিরীক প্রতিবন্ধি এবং অন্ধপ্রতিবন্ধিদের কে কম্পিউটার প্রশিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। কিন্তু রোগের কারনে এ চাকুরি ও ছাড়তে হয়। অবশেষে নিজ উদ্যোগেই বাড়ীতে প্রশিক্ষণ একাডেমী চালূ করেন। যা আজ পর্যন্ত সুনামের সাথে চলছে।  
তার স্বরণীয় কিছু ঘটনাঃ
  প্রতিবন্ধী বাহারের মন কখনও প্রতিবন্ধী ছিলনা। দৈহিক দিক দিয়ে কিছুটা ঘাটতি দেখা দেয়ার পর আরো কয়েকটি ঘটনা তার মনে দারুনভাবে দাগ কাটে। তিনি ব্যতিত, শিহরিত হয়ে ওঠেন। পরম শ্রদ্ধেয় মা বাবা হারানোর ঘটনায় প্রায়ই তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। এছাড়া ২০০৪ সালের ভয়াবহ বন্যায় তার বসত ঘরে প্রবল বেগে পানি ঢুকে তার চিকিৎসার কাগজ সহ মূল্যবান কিছু ডকুমেন্ট বিনষ্ট হয়ে যায়।এখন তার একান্ত ইচ্ছা উন্নত চিকিৎসা গ্রহন করে স্বভাবিক বেচে থাকা। তার সপ্ন দেশ ও জাতির জন্য কিছু করা। তিনি দেশের প্রতিবন্ধি মানুষদের নিরর মুক্ত করে শিার আলো ঘরে ঘরে জ্বালাতে একটি প্রতিবন্ধি শিক্ষা প্রতিষ্টান গড়তে চান।#

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়