Thursday, October 30

হারিয়ে যাওয়া আদমজী জুটমিল


পাট শিল্প খাতে ৫২ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা, আর দীর্ঘদিনের তনি্নষ্ঠ গবেষণার ভিত্তিতে 'জীবন স্রোতে পাটশিল্প : সেকাল-একাল' শীর্ষক একটি পা-ুলিপি তৈরি করেছেন বিশিষ্ট গবেষক কে আর হাসান। তাঁর পা-ুলিপির একটি অংশ ছাপা হচ্ছে 
কেন ২০০২ সালে আদমজী চিরতরে বন্ধ হলো? আদমজী ছিল এ জাতির গৌরব। শিল্প ও সমৃদ্ধির প্রতীক। আমার সুযোগ হয়েছিল বিভিন্ন পদে ও সময়ে এখানে কাজ করার। কেউ দায়ী করে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের, কেউ অভিযোগ তোলে শ্রমিকরা কাজ করত না, আর কেউবা বলে শ্রমিক ইউনিয়ন আয়ত্তের বাইরে চলে গিয়েছিল। পাঠকের ধৈর্যচ্যুতির আশঙ্কায় হাজার কারণের মধ্যে দুই থেকে তিনটি বাস্তব অভিজ্ঞতা আমি তুলে ধরছি। জুটমিলে আমার শিক্ষানবিসকাল ১৯৬১ থেকে চার বছর, যা শুরু হয়েছিল আগাখান ফাউন্ডেশনের খুলনার ক্রিসেন্ট জুটমিলে। ১৯৬৭ সালে ম্যাকনিল অ্যান্ড কিলবার্নের ব্যবস্থাপনায় স্টার জুটমিলে যোগ দেই। ১৯৭৩ পর্যন্ত সেখানেই কর্মরত ছিলাম। এরই মধ্যে যুক্তরাজ্যের ডান্ডি ও বেলফাস্টের জেমস ম্যাকি থেকে জুট টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ও Belfast College of Technology থেকে Works management-এ উচ্চতর প্রশিক্ষণ পাই। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের ৯ মাসই সদ্যোজাত কন্যাসন্তান নিয়ে পলাতক ছিলাম। সাহস আর পরিবারের নিরাপত্তার অভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেইনি। তাই বিহারি, রাজাকার আর পাকিস্তান আর্মির ভয়ে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছিল গ্রামে-গঞ্জে। স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত মিলে আগের পদে বহাল হলাম। শুরু হলো অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে মিলটিকে স্বাভাবিক পর্যায়ে আনার প্রচেষ্টা। '৭৩-এর নভেম্বরে বদলি হয়ে আদমজী জুটমিলের ইউনিট-প্রধান হিসেবে ব্রড লুম মিলে যোগদান করি। এ মিলেই আমি ম্যানেজার, জেনারেল ম্যানেজার ও এঙ্িিকউটিভ ডিরেক্টর হিসেবে তিন দফায় কাজ করার সুযোগ লাভ করি। '৭৩-এর ডিসেম্বরেও আকস্মিকভাবে না জানিয়েই জাতির জনক তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক সকালে দলবলে মিল পরিদর্শনে আসেন। ভেজা ও পচা পাট কেনার অভিযোগে মিলটির ব্যবস্থাপনায় বড় রদবদল করেন। সে পর্যায়ে মিলটির কর্ণধার হয়ে আসেন মরহুম মোঃ মজহারুল কুদ্দুস। কথিত আছে, তিনি ছিলেন কলকাতায় বঙ্গবন্ধুর সহপাঠী। জনাব কুদ্দুস তার আদমজীতে যোগ দেয়ার ব্যাপারে অপারগতা জানান। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কোনো কিছুতেই কর্ণপাত করেননি। কুদ্দুস ছিলেন একজন আপসহীন, সৎ, নিবেদিত, কঠোর পরিশ্রমী, দক্ষ ও কাজে-কর্মে নিষ্ঠাবান ব্যক্তি। অতিসুদর্শন মধ্যবয়সী ভদ্রলোক ছিলেন অনাড়ম্বর জীবনে বিশ্বাসী। রাষ্ট্রপ্রধানের একজেদি মনোভাবের কারণে মনের বিরুদ্ধে জনাব কুদ্দুস আদমজী জুটমিলের মহাব্যবস্থাপক ও চেয়ারম্যান, (ম্যানেজমেন্ট বোর্ড) হিসেবে যোগ দেন ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বরে এবং মিলের মধ্যে সপরিবারে বাস করতে শুরু করেন। প্রশাসনে আমূল পরিবর্তন হলো। যারা অলস, দুর্নীতিবাজ, তাদের আদমজী থেকে সমূলে উৎপাটন করলেন। কর্মকর্তাদের সব ধরনের আড়ম্বরপূর্ণ সুযোগ-সুবিধা বন্ধ হয়ে গেল। খাওয়ার সময় ছাড়া আমাদের কাজ করতে হতো ভোর ৫টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত। রাত ১০টার পরও কখনও-সখনও ডাক পড়ত তার অফিসে। একদিন আমার জ্বর হয়েছিল। জ্বর নিয়ে মিলে গেলাম। ফ্লোরে কাজ করছি, কিন্তু জ্বর বাড়ছেই। খেয়াল করিনি জ্বর কখন ১০৪ থেকে ১০৫ ডিগ্রিতে উঠে গেছে। মিলের মধ্যে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলাম। মিলের ডাক্তার এলেন। পরীক্ষার পর ওষুধ দিয়ে আমাকে বাংলোয় পাঠিয়ে দিলেন। খবর পেয়ে কুদ্দুস সাহেব দুটো কমলালেবু নিয়ে অফিস থেকে সোজা রাত ১১টায় আমাকে দেখতে এলেন। যাওয়ার সময় বললেন, 'কাল সকালে ইনশাল্লাহ দেখা হবে মিলে।' যিনি রাষ্ট্রপতির এত কাছের লোক ছিলেন, তিনি অনায়াসে কোটি কোটি টাকার মালিক হতে পারতেন, বিলাসবহুল জীবন কাটাতে পারতেন- যদি নীতি ও আদর্শের সঙ্গে একটু আপস করতেন, তাহলে আর তাকে গরু পুষে দুধ খাওয়া ও জোগান দিতে হতো না। তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন আদমজী জুটমিলকে আদমজীদের চেয়ে আরও ভালোভাবে চালানোর জন্য; তাই সক্ষম হয়েছিলেন বিশ্বের দরবারে আদমজীর হৃতগৌরব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে। শুরু হলো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ক্রেতার আনাগোনা। অনেক রাষ্ট্রপ্রধান, রাষ্ট্রদূত ও বিদেশি বিশিষ্টজনের আপ্যায়ন ছিল নৈমিত্তিক ব্যাপার। বাইরের কোনো আমলা, রাজনীতিবিদ, শ্রমিক ইউনিয়নের অসাধু নেতা- কারও কোনো অন্যায় আবদার রাখতে দেখিনি তাকে। মনে পড়ে, আমার ১০ বছরের পুরনো সরকারি গাড়িটির রঙ উঠে গিয়েছিল। আমি ছিলাম তার স্নেহধন্য। তাই একদিন আবদার করলাম, তিনি যেন নির্দেশ দেন গাড়িটি বাইরে পাঠিয়ে রঙ করিয়ে আনতে। প্রধান প্রকৌশলী আমার উপস্থিতিতে আদিষ্ট হলেন, আমার এবং তার সরকারি গাড়ি দুটি ব্রাশ কিনে মিলের ওয়ার্কশপে রঙ করে দিতে। রঙ হলো, কিন্তু রূপ খুলল না। ওই গাড়ি নিয়ে বন্ধের সময় মিল থেকে ঢাকা আসতাম। কিন্তু চলার পথে গাড়ি চড়ার সুখ পাইনি কোনোদিন। ড্রাইভার স্টিয়ারিংয়ে আর আমি বেশিরভাগ সময় বন্ধ গাড়ি ঠেলেছি। কখনও-সখনও ঠেলেছে আমার গাড়িচালক- সদয় হয়ে তার সিটে বসতে বলত আমাকে, আর সে গাড়ি ধাক্কা দিত। উল্লেখ্য, ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে আমাকে বদলি করে এক হাজার তাঁতের তিন নম্বর মিলের ইউনিটপ্রধান করা হয়েছিল। তখন আদমজীদের ফেলে যাওয়া ১৬০০ সিসির একটি পুরনো গাড়ি পেয়ে কিছুটা কষ্ট দূর হয়েছিল। এরই মধ্যে আমার বাংলোর পর্দাগুলোর রঙ উঠে ছিঁড়ে গেছে। কুদ্দুস সাহেবের কাছে নতুন পর্দার আবদার করলাম। কার্পেট ব্যাকিং মিল থেকে পাট দিয়ে পর্দার কাপড় বানিয়ে নেয়ার নির্দেশ দিয়ে মহানন্দে উচ্চারণ করলেন, 'আমার পণ্য আমার মিল'- এই হচ্ছে তখনকার আদমজী জুটমিলের চিত্র। আদমজী জুটমিলের একটা চিত্র তুলে ধরলাম পাঠকের অবগতির জন্য যে, সৎ নেতৃত্বের ছোঁয়ায় কেমন করে পাল্টে যায় এত বড় প্রতিষ্ঠান। অমস্নান বদনে আমরা সবাই সন্তুষ্টচিত্তে মনোযোগ দিয়ে কাজ করেছি। প্রতিষ্ঠাকালে আদমজীর যে রূপ ছিল, আমরা কুদ্দুস সাহেবের নেতৃত্বে ১৯৭৪, '৭৫ ও '৭৬-এ আরও সুন্দর রূপ দিয়েছিলাম। ছিল না কোনো বাইরের হস্তক্ষেপ, ভেতরের ইউনিয়নের উপদ্রব ও দুর্নীতি। শ্রমিকরা সময়মতো মজুরি পেত। বিভিন্ন বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। শ্রমিক ইউনিয়নকে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছিল তাদের সীমাবদ্ধতা। আইনশৃঙ্খলার তীক্ষ্ন দৃষ্টি এড়িয়ে তারা কখনও সীমা লঙ্ঘন করেনি। দৈনিক উৎপাদন ২৭০ টনের নিচে নামেনি কখনও। উৎপাদিত পণ্য ক্রেতার কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল এবং গুদামজাত হয়ে পড়ে থাকেনি। একটি সুশাসন মিলটিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল উন্নততর প্রবৃদ্ধির দিকে। স্বাধীনতা-উত্তর বিধ্বস্ত আদমজী পুনরুদ্ধারের এক চিত্র তুলে ধরলাম। এবার ১৯৮৯ সালের ডিসেম্বরে আমাকে আদমজী জুটমিলের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে যোগ দিতে হয়। আদমজীর যে চিত্র আমি উপরে তুলে ধরেছি, আজ তার কিছুই বিদ্যমান নেই। উপরস্থ কর্মকর্তাদের গাড়ির বাহার আমাকে বিস্মিত করল। বাইরে এবং ভেতরের হস্তক্ষেপ চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গেছে। কাজে-অকাজে, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে শ্রমিক নেতাদের অহেতুক হস্তক্ষেপের জন্য নির্বাহী পরিচালক, মহাব্যবস্থাপক এবং সব বিভাগীয় প্রধান আসল কাজ করার সময় পেতেন না। মিলের মধ্যে অবৈধ বসতি স্থাপন, নিষিদ্ধ পণ্যের বিপণন নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বেড়ে গিয়েছিল। মিলের আইনশৃঙ্খলার অবনতির জন্য অবৈধ বসবাসকারীরা হুমকি হয়ে দাঁড়াল। উপরন্তু কথায় কথায় সব শ্রমিক ও অবৈধ বসবাসকারী দিয়ে ঢাকা-চিটাগাং মহাসড়ক বন্ধ করে রাজধানীকে অচল করার পুনঃপুন পদক্ষেপ অব্যাহতভাবে চলতে থাকল। কিছু দুর্বৃত্তের হাতে জিম্মি হয়ে রইল আদমজীর ব্যবস্থাপনা, যা মরহুম কুদ্দুস সাহেবের আমলে অচিন্তনীয় ছিল। এরই মধ্যে অগণিত অবৈধ অস্ত্র ঢুকে পড়ে আদমজীর মধ্যে। বেশিরভাগ শ্রমিকই নিরীহ। এদের মধ্যে কিছু দুর্বৃত্ত রাজনৈতিক দলের আশ্রয়ে শুরু করল গোলাগুলি। পরিবেশ হয়ে উঠল অনিরাপদ ও অসুস্থ, যা ১৯৮২ সাল পর্যন্ত কল্পনাতীত ছিল। শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর দলীয়করণকে চিহ্নিত করা যায় মিলটি বন্ধের আরেকটি প্রধান কারণ হিসেবে। প্রয়োজন ছিল সরকারিভাবে কঠোর হস্তে অস্ত্রের সংঘাত, দলাদলি, আইনবহির্ভূত বিক্ষোভ চিরতরে বন্ধ করে মিলটিকে বাণিজ্যিকভাবে চালানো। সক্ষম হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু ও মরহুম কুদ্দুস সাহেব। প্রয়োজনে সাইদুল হক সাদুর মতো শ্রমিক নেতাকেও অতর্কিতে কারারুদ্ধ করেছিলেন তারা। ভ্রূক্ষেপ করেননি শ্রমিক-জনতার রক্তচক্ষু আর জনপ্রিয়তার প্রতি। জানা যায়, আমি আদমজীর দায়িত্বভার নেয়ার কয়েক দিন আগে রাষ্ট্রপতি মিল পরিদর্শনে আসেন এবং শ্রমিকদের জনসভায় ঘোষণা করেন, 'সিদ্দিক সর্দার (তৎকালীন সিবিএর সভাপতি) আমারও সর্দার।' সহজেই অনুমেয়, চেইন অব কমান্ড কোথায় পেঁৗছেছিল। তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি থেকে বিজেএমসির পরিচালক পর্যন্ত সবার অহেতুক হস্তক্ষেপ আমাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল। মহামান্য রাষ্ট্রপতি সমাবেশ করবেন, মিল বন্ধ করে বাস-ট্রাক ভাড়া করে শ্রমিকদের পূর্ণ বেতনে সমাবেশে যোগদান করানোর দায়িত্ব আদমজী মিল কর্তৃপক্ষের। সচিব মহোদয়ের বাড়িতে নিরাপত্তার জন্য আদমজী থেকে তিনজন সিকিউরিটি গার্ড পাঠানো হবে ধানমন্ডিতে। তাদের আসা-যাওয়ার ভাড়া ও দুপুরের খাওয়ার খরচ দিতে হবে মিল কর্তৃপক্ষকে। মনে পড়ে চিফ সিকিউরিটি অফিসারকে। অসহায়ভাবে বললাম খরচ জোগাড় করতে। পাঠকরা সহজেই বুঝতে পারেন, খরচ কোথা থেকে এসেছিল। আদমজীর মালিকরা গুলশানে ৭৫নং রোডে এক বিঘা জমির ওপর একটি দ্বিতল বাড়ি করেছিলেন। গুলশান ৭৩ ও ৭৯নং রোডে কয়েক বিঘা জমির ওপর আরও আটটি স্বতন্ত্র বাংলো- যেখানে আদমজী পরিবার বসবাস করত, যা স্বাধীনতা-উত্তরকাল থেকে অনেক বেশি টাকায় বিদেশি দূতাবাসের কাছে ভাড়া দেয়া হতো। আমি আদমজীতে যোগদান করে বিস্মিত হলাম, দেখলাম এত দামি বাড়িগুলোর কিছু বেদখল হয়ে গেছে বিজেএমসির পরিচালক (অর্থ) ও পরবর্তী সময়ে চেয়ারম্যান এবং পরিচালক পরিকল্পনা দ্বারা। সে সময় ওই বাড়ির মাসিক ভাড়া ছিল প্রায় ৮০ হাজার টাকা, কিন্তু ওই পরিচালক দিতেন মাসিক ২ হাজার ৮০০ টাকা। বিষয়টি চার্টার্ড অ্যাকাউন্টস ফার্ম J. Abedin & Co. নিরীক্ষায় আপত্তি তুলেছিল। পরবর্তী সময়ে সরকারি বাণিজ্যিক নিরীক্ষা আপত্তি করে, কিন্তু সব আপত্তি উপেক্ষা করে তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে ওই বিলাসবহুল বাড়িতে থেকে গেলেন। তার আগে বহু জাঁদরেল চেয়ারম্যান যথা এমকে আনোয়ার চিশতি, মনজুর মোর্শেদ, মরহুম গোলাম রব্বানী, মরহুম সালাউদ্দিন আহম্মেদ, মরহুম আবু সাঈদ (সাবেক সিইসি), তারা কখনও এসব বাড়ির দিকে দৃষ্টিপাত করেননি। বহু জাঁদরেল পরিচালক যথা এসওয়াই বখত, রফিকুল আমিন, রফিউল করিম, এসএ চৌধুরী, এমআর তালুকদার, মোঃ আলী, আমিনুল হক আরও অনেকে কেউ দখল করেননি। অথচ একজন পরিচালক (উৎপাদন ও পাট) দাবি করলেন, ভাড়াটেকে জোর করে উঠিয়ে দিয়ে তাকে গুলশানের ওই বিশাল জমির ওপর স্বতন্ত্র বাংলোটি দিতে। আমি সায় দেইনি। পক্ষান্তরে লিখিতভাবে দাবি করেছিলাম, তদানীন্তন অর্থ পরিচালক ও পরিচালক (পরিকল্পনা) বিজেএমসিকে গুলশানের বেদখলকৃত বাড়ি ছেড়ে দিয়ে তাদের পদাধিকার অনুযায়ী বাড়ি ভাড়া নিয়ে ওই বিশাল বাংলো দুটি খালি করতে, যাতে আদমজী কোনো বিদেশি দূতাবাসকে ভাড়া দিয়ে আর্থিকভাবে লাভবান হয়। কেউ কর্ণপাত করেননি। এর মধ্যে ওই পরিচালক (পরিকল্পনা) বিজেএমসির পরিচালনা পর্ষদের সভায় পাস করিয়ে নিলেন আদমজীর জিএম (অর্থ) যে গাড়িটিতে সরকারিভাবে চড়তেন, সেই গাড়িটি ওই পরিচালক (পরিকল্পনা) তার দাফতরিক গাড়ি ছাড়াও অতিরিক্ত হিসেবে ব্যবহারের জন্য দিতে। আমি অপরাগতা প্রকাশ করায় বিজেএমসির পর্ষদের মিটিংয়ে তদানীন্তন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মোফাজ্জল করিমের উপস্থিতিতে সেই পরিচালক অন্যায়ভাবে আমাকে চরম অপদস্থ করলেন। বিষয়টি তদানীন্তন পাটমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত গড়ায়। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, ওই দিন হবে আমার বিজেএমসির শেষ কর্ম দিবস। পাটমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে ভগ্নহৃদয়ে আবার ফিরে যাই আদমজীতে। এরই মধ্যে ১৯৯০ সালের মার্চ মাসে আমাকে নির্দেশ দেয়া হয় আদমজীর একটি গাড়ি পাট মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করতে পাট মন্ত্রণালয়ের আমলাদের জাতীয় সংসদের অধিবেশনে যাওয়ার জন্য। (চিঠি সংরক্ষিত, সূত্র নং পাম/শা-৩/১৩৭/৮৯/৩১ গাড়ি নং ঢাকা ঘ-১০৫৯)। সঙ্গে দেয়া হয় পুলের ড্রাইভার আবুল হোসেনকে গাড়ি চালিয়ে মন্ত্রণালয় থেকে সংসদে ও সংসদ থেকে মন্ত্রণালয়ে আসার জন্য। তিন মাস পর অবহিত হই ওই গাড়িটি তদানীন্তন পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব মহোদয়ের একান্ত সচিব ব্যবহার করছেন। ১৯ এপ্রিল ১৯৯০ সালে পাট মন্ত্রণালয়ের ওই সিনিয়র সহকারী সচিব আমাকে একটি চিঠি দেন, যা তিনি সই করেন ১৯-০৪-১৯৯০-১৬-০৩-১৯৯০ থেকে ১০-০৪-১৯৯০ পর্যন্ত ২৩০ ঘণ্টা ওভার টাইমের মজুরি আবুল হোসেন ড্রাইভারকে প্রদান করার জন্য। অন্যদিকে দেখা যায়, ওই ১ হাজার সিসির স্টারলেট গাড়িটি (শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত নয়) কর্মদিবসে দৈনিক গড় পেট্রল খরচ হয়েছিল ৩৮.৪৫ লিটার, মাসিক ১ হাজার ১৫৩ লিটার- যা অবিশ্বাস্য হলেও সত্য। (আদমজী জুটমিলের প্রশাসন বিভাগের ২৩-০৪-৯০ তারিখের গাড়িটির জ্বালানি খরচ ও ড্রাইভারের অতিরিক্ত মজুরির বিবরণ সংরক্ষিত, অকটেন খরচ হয়েছিল ১৮-০১-১৯৯০ থেকে ১৫-০৪-১৯৯০ ইং মোট ২৩৮৪ লিটার)। ব্যাপারটি মন্ত্রণালয়ের গোচরে আনা হয়, যার চিঠির সূত্র নং আদমজী/প্রশাসন/৬২/৯০/৩২৩, ২৯-০৪-৯০ইং। ফলে গাড়িটি পাট মন্ত্রণালয় থেকে ফেরত দেয়া হয় আদমজীতে, আর আমি অর্জন করি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কোপানল। বিষয়টি তদানীন্তন কিছু পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। এরই মধ্যে তদানীন্তন চিফ হুইপ আমাকে দূরলাপনিতে নির্দেশ দেন ২ লাখ টাকা তাকে অনতিবিলম্বে পাঠানোর জন্য। আমি অপারগতা প্রকাশ করি, তখন মাননীয় চিফ হুইপ বললেন, তিনি ঠাট্টা করছিলেন। এত ঠাট্টা আর বিরাগের ফলশ্রুতিতে সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে জুন ১৯৯০ সালে আমি সাক্ষাৎ করি তদানীন্তন পাটমন্ত্রী শেখ শহিদুল ইসলামের সঙ্গে। তাকে অনুরোধ করি, তিনি যেন আমাকে আদমজী থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে বদলি করে ওএসডি হিসেবে রেখে দেন। তিনি ভারাক্রান্ত হৃদয়ে কাজটি করেছিলেন। যার জন্য সহজ হলো আমার পদত্যাগের নোটিশ বিজেএমসিতে পেশ করতে (যার নং জেপি ২৬৬, তাং-২৭-০৪-১৯৯১ইং এবং যা গৃহীত হয়েছিল ১৫-০৬-১৯৯১ইং, সূত্র নং প্রশাসন/পি/১২৫০/৮৮০ চিঠিটি সংরক্ষিত)। ব্যতিক্রমধর্মী এক পদত্যাগপত্র। চিঠিতে লেখা আছে, 'আমি কর্তৃপক্ষের ন্যায়নিষ্ঠার প্রতি আস্থা হারাইয়াছি বিধায় পদত্যাগপত্র পেশ করলাম'। উল্লেখ্য, আমার সময়েই দীর্ঘ ১২ বছর পর আদমজীতে সিবিএর নির্বাচন হয়। সে নির্বাচনে দুর্ভাগ্যবশত রেহান গ্রুপ জয় হয়- যে রেহান ছিল ওই এলাকার কুখ্যাত সন্ত্রাসী ও যার বিরুদ্ধে ধর্ষণ, লুটপাটসহ বহু অভিযোগ বিচারাধীন ছিল এবং সে নিজেও কারাদ- ভোগ করছিল। আমার স্বল্পকালীন সময়ে নির্বাচনী ডামাডোলের মধ্যেও আদমজীর গড় দৈনিক উৎপাদন ছিল ২২০ টন। আমি ভারাক্রান্ত হৃদয়ে শেখ শহীদের আদমজী থেকে আমাকে বদলি করার উল্লেখ করলাম; কেননা তাঁকে পেয়েছিলাম একজন সৎ, নিবেদিত, দেশপ্রেমিক হিসেবে- যার কোনো অহেতুক হস্তক্ষেপ ব্যবস্থাপনাকে বিব্রত করেনি। এর কিছুদিন আগে আদমজীর ১নং মিলের ইউনিট প্রধানকে আমি সাময়িকভাবে বরখাস্ত করেছিলাম তার মিলের শ্রমিক অসন্তোষের জন্য। বিষয়টি পাটমন্ত্রী পর্যন্ত গড়ায়। ইউনিট প্রধানের বাবা ছিলেন মন্ত্রী শেখ শহিদের এলাকার একজন ক্ষমতাধর রাজনীতিবিদ। তিনি মন্ত্রীকে অনুরোধ করেছিলেন তার ছেলের সাসপেনশন অর্ডার তুলে নিতে। মন্ত্রী কুণ্ঠিতচিত্তে সচিবকে অনুরোধ করেন আমাকে বলতে, কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিয়ে ওই ইউনিট প্রধান তালুকদারকে কাজে যোগ দেয়াতে। সচিব আমাকে অনুরূপ নির্দেশ দেন। আমি সবিনয়ে অপারগতা প্রকাশ করি। কেননা ব্যাপারটি তাদের কাছে সামান্য, কিন্তু একটি অনুরোধ রাখতে গিয়ে প্রশাসনে চেইন অব কমান্ড নষ্ট হবে; প্রশাসন অকার্যকর হয়ে পড়বে। পরের দিন স্থানীয় রাজনৈতিক চাপে মন্ত্রী শেখ শহিদুল ইসলাম টেলিফোনে আমাকে অনুরোধ করলেন, কোনো রকমে ঘটনাটি সহানুভূতির সঙ্গে পর্যালোচনা করে তালুকদারকে কাজে যোগ দেয়ায়। কেননা তিনি প্রচ- চাপে আছেন। আমি আবার সবিনয়ে অপারগতা প্রকাশ করি। মন্ত্রী মহোদয়ের সরাসরি অধীনস্থ থেকে আদমজী জুটমিলের স্বার্থে আমি তার অনুরোধ রাখতে পারলাম না। কিন্তু তিনি আমার বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেননি; বরং যেদিন তার বাসায় গিয়ে তাকে অনুরোধ করলাম- ১৪ দিনের মধ্যে আমাকে আদমজী থেকে বদলি করে প্রয়োজনে ওএসডি করতে। সব শুনে তিনি বললেন, 'আপনি আদমজীতে থাকায় আমি খুব স্বস্তিতে আছি, নিশ্চিত আছি, কোনো রকমে থাকা যায় না?' আমার একজেদি মনোভাবের কারণে তিনি আমাকে আদমজী জুটমিল থেকে বদলি করে পাট মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং সেলে রাখলেন। কয়েক দিন পরে জানতে পারলাম, তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে আমার নাম সুপারিশ করেছেন বাংলাদেশ জুট করপোরেশনের চেয়ারম্যান হিসেবে পদোন্নতি দেয়ার জন্য। বিষয়টি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়েছিল, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বিআরটিসির চেয়ারম্যানকে বিজেএমসির চেয়ারম্যান হিসেবে বদলি করে দেয়া হলো। বিষয়টি উল্লেখ করলাম পাঠকের জন্য যে, এত বড় মন নিয়েও অনেকে মন্ত্রিত্ব করে গেছেন। এরই মধ্যে পাট সচিব তার চিঠি নং পাম/কেবিক/প্র-১/৯০/৩৭২, তারিখ : ২৭-৭-৯০ইং নিজস্ব স্বাক্ষরে আমাকে মনিটরিং সেলের অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে কেন্দ্রীয় বিক্রয় কমিটির দায়িত্ব দেন। মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব নিউমার্কেটের ইউনিভার্সিটি বুক ডিপোর পক্ষ থেকে তারেক স্বাক্ষর করে ৪৬ হাজার ১৩২ টাকার বিল পাঠান ব্যক্তিগতভাবে আজিজুল হক। সহকারী সচিব বিলটি আমার কাছে আনেন ৮-১০-৯০ তারিখে। পরীক্ষা করে দেখা যায় যে, কোনো বই কেবিকোর প্রয়োজনে কেনা হয়নি। বিলটি কেবিকোর চেয়ারম্যানের অনুকূলে- যিনি পাট সচিবের পদাধিকার বলে কেবিকোর চেয়ারম্যানের পদ অলঙ্কৃত করেন। বইগুলোর মধ্যে পাট বা বাজার উন্নয়নের কোনো বই নেই (লিস্ট সংরক্ষিত)। বিলের মধ্যে রামায়ণ, মহাভারত, বেদ, শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, রবীন্দ্র রচনাবলি, শরৎ সাহিত্য, জিন্নাহ, পাকিস্তান নতুন ভাবনা, আসামী হাজির, বেগম মেরী বিশ্বাস, কড়ি দিয়ে কিনলাম, বিমল মিত্র ১ম ও ২য় খ-, শ্রেষ্ঠ নজরুল স্বরলিপি, ইকোনমিকস-স্যামুয়েলসন, অর্থনীতির কিছু টেঙ্ট বুক ইত্যাদি। বিল আমি পেমেন্টের জন্য অনুমোদন দিলাম না। ফলশ্রুতিতে মাননীয় পাট সচিব মহোদয় দুই দিন পরে ১০-১০-১৯৯০ আমাকে পুনরায় বদলি করে মনিটরিং সেলে আনলেন (কপি সংরক্ষিত কপি নং পাম/শা-১/৯৭৭/৮৯/২৬২৩)। এরই মধ্যে পাট সচিবের বিভিন্ন দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রতিবেদন বেরোয়। ফলশ্রুতিতে মন্ত্রণালয় আমাকে বিজেএমসির সার্বিক পাট কেনার দায়িত্ব দিয়ে পাট মন্ত্রণালয় থেকে বিজেএমসিতে বদলি করা হয়। কর্তৃপক্ষের কোপানল এড়াতে আর কিছুটা হতাশ হয়ে শেষ পর্যন্ত বিজেএমসি ছেড়ে ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে যোগ দিয়ে এখনও পাটশিল্পের সঙ্গেই জড়িত আছি। উপরে আদমজী জুটমিলকে কেন্দ্র করে দুটি চিত্র তুলে ধরা হলো আদমজী সার্বিক অব্যবস্থাপনা, নৈরাজ্য, দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন, অহেতুক হস্তক্ষেপের শিকার হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। প্রয়োজন ছিল শক্ত হাতে হাল ধরার। অব্যবস্থাপনা আর অহেতুক হস্তক্ষেপে মিলটি জাতির জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াল। দৈনিক গড় উৎপাদন ৭০ থেকে ৮০ টনে নামল। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির শেষ সীমায়। প্রশাসন নাজেহাল। তাই আদমজী জুটমিল বন্ধ করে দেয়া হলো। কিন্তু দায়ী ব্যক্তিরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেল; হারিয়ে গেল শিল্পাঙ্গনের ঐতিহ্য।

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়