Wednesday, November 6

লুভার 'পরে চাঁদের রোদে

মাসুম সায়ীদ
দুই চোখের সাগরে ঘুমের গাঙচিলেরা ঢুঁ মেরে যাচ্ছিল বারবার; কিন্তু বাসা বাঁধছিল না কিছুতেই। সময়ের সঙ্গে কমে যাচ্ছিল পথের দূরত্ব। এক সময় আমার নির্ঘুম চোখ সিলেটের ভোর দেখল। গাড়ি থামল গিয়ে দরগা গেটে। এত সকালেও জায়গাটা রীতিমতো জমজমাট। প্রচুর গাড়ি, অনেক লোকের হাঁটাহাঁটি। একটা বন্ধ অফিস বিল্ডিংয়ের সামনে আমরা প্লাস্টিকের মাদুর পাতলাম। ব্যাকপ্যাক নামিয়ে হালকা হয়ে মসজিদের টয়লেটে সাফসুতরো হতে গেলাম। ফিরে এসে নোনতা বিস্কিটের সঙ্গে চা খেলাম। সূর্য উঠল পুব আকাশ লাল করে। আমাদের বাহন ঠিক করা ছিল। নাস্তা সেরে উঠে পরলাম। ১১ জনের ১১টি ব্যাকপ্যাক। আরো দুটি অতিরিক্ত- একটি তাঁবুর অন্যটি লাইফ জ্যাকেটের। বেশির ভাগের কাছে আবার ক্যামেরা ব্যাগ। আমরা কোনো রকমে গাদাগাদি করে হাত-পা ভাঁজটাজ করে পড়ে রইলাম। ৪০ মিনিটের পথ বুঝি দেড় ঘণ্টায়ও যেন শেষ হতে চায় না।
কানাইঘাট সদর সুরমা নদীর তীরে। লোকসংখ্যা খুব বেশি নয়। তবে বাজার এলাকা বলে কথা। আমাদের ঘিরে ছোটখাটো ভিড় লেগে গেল। এখান থেকে আমাদের যাত্রা শুরু হবে নৌকায়। বাংলাবাজার পত্রিকার কানাইঘাট উপজেলা প্রতিনিধি মাহবুব ভাই নৌকা ঠিক করে রেখেছিলেন। দুই দিনের খাবার পানি, শুকনো খাবার আর টুকটাক এটা সেটা কিনে উঠে পড়লাম নৌকায়।
মাঝি আবদুর রহিম নৌকা চালু করলেন। নৌকার ছইটা বেশ শক্তপোক্ত। আমরা কেউ ছইয়ের ভেতরে কেউ বাইরের খোলা জায়গায় বসলাম। ভাটি অঞ্চলের নৌকার চেয়ে এখানকার নৌকাগুলোর ধরন আলাদা। ছিপছিপে লম্বা আর নিচু। বেশির ভাগ নৌকা পাথর তোলা আর পাথর বহন করার কাজ করে। পাহাড়ি নদীর গভীরতা যাই থাক খুব বেগবান। আর প্রচুর পাথর গড়িয়ে আসে স্রোতের টানে। পাথরে ধাক্কা লেগে যাতে তলা ফেটে না যায় সে কারণেই নৌকাগুলো এমন।
সুরমার বুকে উজান ঠেলে চলেছি। উল্টো দিক থেকেও নৌকা আসছে। ভাটিতে চলছে বলে তাদের গতিও বেশি। দুই নৌকা পাশাপাশি হলেই ঢেউয়ের তালে নৌকা নেচে ওঠে। নদীর বুকে জাল নিয়ে ভেসে বেড়ানো, খেয়া নৌকার জন্য অপেক্ষমাণ পথিক, গায়ের বধূর লাজুক গোসল, কৌতূহলী চাহনি, দুরন্ত বালকের ডুব সাঁতার- চিরচেনা সব দৃশ্য। তবু যেন নতুন। যেন প্রথম দেখার ভালোলাগা! আমাদের ক্যামেরাগুলো ক্লিক করে উঠছিল বারবার। এক সময় সুরমা ছেড়ে আমরা লুভাছড়াতে গিয়ে পড়লাম। লুভাছড়া সুদূর মেঘালয়ের পাহাড় থেকে নেমে আসা চটুল এক মেয়ে। তার স্বচ্ছ জলে আকাশের ছায়া। স্রোতের টানে নূপুরের সুর। ছুঁয়ে না দেখলে মন শান্ত হতে চায় না।
সূর্য মাথায় নিয়ে আমরা নতুনবাজার নামলাম। নতুনবাজার লুভাছড়ার দক্ষিণ তীরে। উত্তর-পশ্চিমে মুলাগুল আর উত্তর-পূর্বে বড়গ্রাম। নতুনবাজার থেকে লুভাছড়া বাঁক নিয়ে ভারতের সীমানা ছুঁয়েছে। বালির উত্তাপ তখনো আছে। এলোমেলো পায়ের ছাপ এঁকে আমরা এগিয়ে গেলাম গ্রামের দিকে। গ্রাম ছাড়িয়ে উত্তরে যতদূর যাওয়া যায় যাব। গ্রামের মুখে স্থানীয় বাসিন্দা জহিরকে পাওয়া গেল। খানিকটা হতচকিত- এই অবেলায় এরা কোথায় যায়? এলোই বা কোথা থেকে?
লুভাছড়া এখানে যেন শাড়ির পাড়। রমণীর কোমর, বুক ও কাধ ছুঁয়ে উঠে গেছে মাথায়। আর মেঘালয়ের কালচে পাহাড়গুলো চুল ছড়িয়ে বসে থাকা সেই তরুণীর আবছা মুখ। সূর্য তখন অস্তরেখায়। মেঘালয়ের পাহাড়চূড়ার শহরে বিজলি বাতি জ্বলতে শুরু করেছে। আমরা দাঁড়িয়ে আছি বাংলাদেশের শেষ সীমানায়। ওপারেই ভারত। আমরা নদীতে নামলাম। স্বচ্ছ নীল শীতল জলে রাত-দিনের ক্লান্তি ধুয়ে ফিরে এলাম গ্রামে। মসজিদে তখন মাগরিবের নামাজ চলছে। নামাজ শেষে বয়োবৃদ্ধরা বেরিয়ে এলেন রাস্তায়। তাঁদের চোখেমুখে জিজ্ঞাসা। জহির সবার কৌতূহল মেটায়।
ক্যাম্পের জন্য নির্ধারিত স্থান নিয়ে জহির দ্বিমত করল। মাঝরাতে ঝড়ের বেগে শুরু হয় বাতাস। নদীর দিক থেকে প্রবাহিত তীব্র বাতাস থেকে রক্ষা পাওয়ার কোনো আড়াল নেই এখানে। আজ পূর্ণিমা। চাঁদের ঠাণ্ডা রোদে ভেজার জন্য চারদিক উন্মুক্ত এই জায়গাটা আমরা নির্বাচন করেছিলাম। শেষ পর্যন্ত জহিরের পরামর্শে গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের সামনে তাঁবু খাটালাম। দেখতে দেখতে চাঁদ চলে এলো মাথার ওপর। হাটফেরত গ্রামবাসী আমাদের কিছুতেই উন্মুক্ত প্রান্তরে ছেড়ে যেতে চায়নি। তারা তাদের ঘর ছেড়ে দিতে চেয়েছিল। আমরা চাঁদের দোহাই দিয়ে নিরস্ত করেছি। হিম বাতাস, নিস্তব্ধ চরাচর। এর মাঝে চুয়ে পড়ছে জ্যোৎস্না! ইচ্ছা করছিল জেগে থাকি সারারাত। কিন্তু ক্লান্ত শরীরের কাছে মুগ্ধ মন হার মানল।
আজানের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। চারপাশটা নীরবতায় ডুবে আছে। উঠে পড়লাম সন্তর্পণে। বাইরে তাকিয়ে অভিভূত হয়ে গেলাম। চাঁদ পূর্ব-উত্তর দিক থেকে ঘুরে চলে এসেছে উত্তর-পশ্চিম কোণে। একেবারে আমাদের তাঁবুর ছোট্ট দরজাটির মুখোমুখি। ফসলের মাঠ, বালুচর, ঘুমন্ত পাহাড়, ফিতার মতো একচিলতে নদী আর দিগন্তজুড়ে ছড়িয়ে থাকা মৌনতার এমন মহিমা বড়গ্রামে না এলে জানাই হতো না। দুপুর নাগাদ আমরা ক্যাম্প গুটিয়ে নতুনবাজার চলে এলাম। ছোলা আর তেল-ভাত খেলাম। ঘণ্টা দেড়েকের বিরতি নিয়ে মুলাগুল চা বাগানের ভেতর দিয়ে পশ্চিম দিকে হাঁটা দিলাম। বাগানের একদম পশ্চিম পাশে টিলার ওপর একটি মাজার। গনি ভাই, সাগর ভাই আর আমি এগিয়ে যেতে থাকলাম। একটা উপত্যকা পেলাম। উপত্যকার তলা বেয়ে ঝিরি নেমে গেছে। ঝিরিটা পেরিয়ে এগিয়ে যেতে থাকলাম। এখানে কুলিকামিনদের পাড়া। কয়েকটা ছোট ছেলেমেয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে। ওদের কাছাকাছি হতেই একজন দুই হাত জোড় করে সুন্দর করে আদাব দিল। সামান্য ঘটনা; কিন্তু অভিভূত হলাম। গনি ভাই জেনে ছিলেন এখানে কোথাও ব্রিটিশ আমলে তৈরি একটি লোহার ব্রিজ আছে। একজন পথচারীকে পেয়ে জিজ্ঞেস করতে জানা গেল ১০ মিনিটের পথ।
পশ্চিমের আকাশ থেকে সূর্যের শেষ লালটুকুও হারিয়ে যাচ্ছে। প্রায় ২০ মিনিট হাঁটার পরও ১০ মিনিটের পথ শেষ হওয়ার লক্ষণ দেখা গেল না, মানে ব্রিজ চোখে পড়ছে না। ছবি তোলার জন্য আমি বারবার থামছিলাম। কী কারণে যেন সাগর ভাইও। গনি ভাই হাঁটছিলেন টানা। সূর্য পাহাড়ের আড়ালে হারিয়ে গেছে। কিন্তু শেষ রেখাটা মুছে যায়নি। আমরা আরো ১০ মিনিট হাঁটার পর ব্রিজটা পেলাম। পুরোটাই ঝুলন্ত। ১৯২৫ সালে কলকাতার জিও ক্রেডক কম্পানির করা। এখনো ঠিকঠাক আছে। যখন নৌকার কাছে ফিরলাম তখন রাত।
মাঝি নৌকা ছেড়ে দিল। এবার আমরা ভাটি পথে। খানিক পর আকাশে চাঁদ উঁকি দিল। দেখতে দেখতে চাঁদের ঢল নামল নদীতে। নৌকা এগিয়ে যাচ্ছে চাঁদকে পেছনে ফেলে। আমি স্বপ্নে পাওয়া মানুষের মতো নৌকার ছইয়ের ওপর বসে ভাবছিলাম- এইতো মুহূর্ত কয়েক মাত্র। তারপর লুভাছড়ার সব সৌন্দর্য রয়ে যাবে পেছনে। এই চাঁদটাই কেবল সাথী হয়ে উঁকি দেবে ঢাকাগামী বাসটার জানালায়।
ছবি : অভিজিৎ নন্দী ও ফাহিম

কিভাবে যাবেন
ঢাকার সায়েদাবাদ থেকে শ্যামলী, হানিফসহ আরো কিছু পরিবহনের বাস সিলেট যায়। ভাড়া ৪৫০ টাকা। সিলেটের বন্দরবাজার থেকে বাসে কানাইঘাট পর্যন্ত ভাড়া ৮০ টাকা। কানাইঘাট থেকে মুলাগুল চা বাগান বা লুভাছড়া রিজার্ভ নৌকার ভাড়া দুই দিন ২০০০ থেকে ২৫০০ টাকা। ১২ জনের একটি দলের জনপ্রতি খরচ ২২২০ থেকে ২৫০০ টাকা।

শেয়ার করুন

1 comment:

  1. অসাধারণ লেখা মাসুম ভাই

    ReplyDelete

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়