Monday, June 17

ট্রানজিটে দু’রাত


ড. তানিয়া হোসেন, অতিথি লেখক
সুনন্দা বসে আছে লন্ডনের হিয়ত্রো এয়ারপোর্টে। প্রচুর তুষার পাতের কারনেই ইউরোপের সমস্ত ফ্লাইট বাতিল, কবে ছাড়বে তা কেউ জানে না। সুনন্দা প্যারিসে থেকে ফ্লাই করে লন্ডনে ট্রানজিট নিয়ে বাংলাদেশে যাবার কথা। লন্ডনে সুনন্দা কাউকে চেনে না। যদিও এয়ারলাইন হোটেলের ব্যবস্থা করে দিয়েছে তবুও এ অনিশ্চয়তার মাঝে কারইবা অপরিচিত দেশে হোটেলে বসে থাকতে ভাল লাগে? তুষারপাতের কারনেই বাইরে যাবার কোন উপায় নেই। এক অসহ্য রকমের ঠান্ডা। যদিও হোটেল রুমে হিটার আছে তবুও বাইরে যেতে হলে এক বস্তা কাপড় পড়তে হয়। আর তাছাড়া রাস্তাঘাটও সুনন্দা একেবারে চেনে না। অসহ্য যন্ত্রণায় সুনন্দার চোখে পানি এসে যাবার মতন হলো। যন্ত্রণা উপশমের জন্য সুনন্দা লবিতে বসে কফি খেয়ে তারপর ফেইসবুকে বন্ধুদের সাথে কথা বলবে বলে সিদ্ধান্ত নিল।

কফি শপে ব্ল্যাক কফির অর্ডার করে টেবিলে রাখা ম্যাগাজিন হাতে নিতেই একজন ভদ্রলোক এসে বললেন, “কিছু মনে না করলে এখানে একটু বসতে পারি"। সুনন্দা চোখ তুলে তাকায়। সুদর্শন পুরুষ। মনে হয় না ভারতীয় তবে ইউরোপীয়ও বোধ হয় না। সুনন্দা কফি শপের সবগুলো টেবিলে চোখ ঘুরিয়ে দেখে যে শুধুমাত্র তার সামনের সিটটিই খালি আছে। তাই ভদ্রলোককে না বললে অভদ্রতা হবে। সুনন্দা জবাবে বললো, “প্লিজ বসুন"।
ভদ্রলোক বসলেন এবং হাতের আই প্যাড পড়তে লাগলেন। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ সময় কাটে দ’জনার। কেউ কোন কথা বলে না। সুনন্দা মনে মনে ভাবে ভদ্রলোক দেখতে বেশ চমৎকার, সুন্দর চোখ কেমন যেন মায়া মায়া। সামনে একজন সুন্দরী ও স্মার্ট মেয়ে বসা তবুও আমার একবারও তাকাচ্ছে না, আশ্চর্য! এত কিসের অহংকার? ছেলেরা তো কোনদিনও আমার সাথে এরকম করেনা।
ভদ্রলোক ভাবেন মেয়েটি দেখতে বেশ সুন্দর। চমৎকার পোষাকের রুচি। মনে হয় ভারতীয় বংশোদ্ভুত। আর একটু স্বাস্থ্য হলে ভালো হতো, বেশি চিকন। আমার মতোন একজন হ্যান্ডস্যাম ছেলে পাশে বসে আছে অথচ একবারও কথা বলছে না, আশ্চর্য! এরকমতো আমার সাথে কখনো হয়নি। ভাবতে ভাবতেই সুনন্দার কফি কাপটি একটু হাত থেকে পিছলে পড়ে যায়। সাথে সাথেই ভদ্রলোক টিস্যু পেপার এগিয়ে দেন। সুনন্দা বলে, “থ্যাংক ইউ।” ভদ্রলোক জবাবে বলেন, “ইউ আর ওয়েলকাম।” মনের অজান্তেই ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করে বসেন, “আপনি কি একা?”। সুনন্দা জবাবে বলে, “ জি ট্রানজিটে। জানি না কখন বাড়ী যেতে পারব। প্রচন্ড তুষারপাত, নতুন দেশ, নতুন মানুষ, নতুন সমস্যা।”“

সুনন্দা চুপ করে থেকে জিজ্ঞাসা করে, “আপনি কি বলতে পারেন কত সময় লাগবে প্রেøন ছাড়তে? ভদ্রলোক বললেন, “যদি এই রকম তুষারপাত হয় আমার অভিজ্ঞতা বলে দু’দিনের আগে না।” সুনন্দা জবাবে বললো, “দুদিন?” ভদ্রলোক জবাবে বলেন, “আমার অভিজ্ঞতা তাই বলে।” এ কথা শুনে সুনন্দার মন খুব খারাপ হয়ে যায়। ভদ্রলোক এটা বুঝতে পেরে জিজ্ঞাসা করেন, “আপনি কোথায় যাচ্ছেন?” সুনন্দা বলে, “আমি বাংলাদেশে যাচ্ছি।” ভদ্রলোক অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেন, “বাংলাদেশ?”
সুনন্দা : “জ্বি, আমি বাংলাদেশী। প্যারিসে পড়াশোনা করছি”।
“আমার মা বাংলাদেশী এবং আমি বাংলা বলতে পারি। ভালো পারি কারণ বাবা আরবী হলেও পাকিস্তানি বংশোদ্ভুত আরবী। তাই বাড়িতে অনেক বাংলায় কথা বলা হয়”,  বলেন ভদ্রলোক।
সুনন্দা আনন্দে লাফিয়ে বলে, “ওহ্! থ্যাংক গড। একজন বাংলাভাষীকে পেলাম। আপনি কতদিন থাকবেন এ হোটেলে?”
ভদ্রলোক জবাবে বলেন, “বোধ হয় আরো দু’দিন। কারণ আমিও আপনার মতোন। তুষার পাতের কারণে দেশে ফিরে যেতে পারছি না।”
সুনন্দা জিজ্ঞাসা করে, “আপনার দেশ কোথায়?”
“দুবাই।”
“আপনি আরব?” আমি এই প্রথম কোন আরবীকে দেখলাম। কি করনে আপনি?”
আমি ড্রাইভার।
ড্রাইভার? কিসের ড্রাইভার- ট্যাক্সি না ট্রাক?
আমি প্লেনের ড্রাইভার।
আপনি পাইলট?
হ্যাঁ, আমি এয়ার লাইনের পাইলট।
কোন এয়ারলাইন্সের পাইলট?
এমিরেটস।
এমিরেটস! এই জীবনে প্রথম আমার কোন পাইলটের সাথে পরিচয়।
আজকেও কি আপনার ফ্লাইট বাতিল তুষারের কারণে।
হ্যাঁ, তবে আজ আমি পাইলট হিসেবে না যাত্রী হিসেবে অনেকদিন পর ফ্লাই করছি। আমি আজ আপনার মতন সাধারণ যাত্রী।
ও আচ্ছা! তবে আপনিতো এ শহর চেনেন, তাইতো আপনার কোন অসুবিধা নেই, কিন্তু আমি যে কিভাবে এই অনির্দিষ্ট সময় পার করবো?
আপনার যদি এতে কোন আপত্তি না থাকে চলুন ঘুরতে বের হই। আপনিতো এ শহর কখনো দেখেননি তাই না? প্রথমে লন্ডন ব্রীজ দেখবো এবং এরপর আমার এক ব্রিটিশ বন্ধুর একটি পুরনো আমলের বাড়ি দেখতে যাবো। ঐ বাড়িতে কেউ থাকে না তবে আপনার ভালো লাগবে। শহর থেকে একটু দূরে, এখনকার দিনে ঐ ধরণের ঘরবাড়ি এখন খুব একটা চোখে পড়ে না। দেখতে যাবেন?
সুনন্দা এক বাক্যে বললো, যাবো, ধন্যবাদ।
ভদ্রলোক হোটেল থেকে গাড়ি ভাড়া করলেন এবং দু’জনে রওনা হয়ে গেলো পুরনো বাড়ির উদ্দেশ্যে। পথে পড়ল লন্ডন ব্রিজ। ব্রিজটি খোলা। সুনন্দাতো দেখে অবাক! ব্রিজ খোলা কেন? ভদ্রলোক বললো যে বড় যানবাহন চলাচলের সময় ব্রিজটি খুলে দেয়া হয়। এটা দেখতে পাওয়া খুবই সৌভাগ্যের ব্যাপার। লন্ডনের টেমস নদীর কথা কার না জানা। ঐ নদীর তীরে তুষারের রাতে ধীরে ধীরে গাড়িতে করে খোলা লন্ডন ব্রিজ দেখতে পাওয়া অপ্রত্যাশিত ট্রানজিটের মাঝে যে কত আনন্দের তা বোঝানো সুনন্দার কোন ভাষাতেই সম্ভব না। কোন পুরুষের পাশে বসে থাকতে সুনন্দার কখনো এতো ভালো লাগেনি। সবাইতে বলে পাইলটরা চরিত্রহীন হয়। কোথায় ভদ্রলোকের কোন আচরণে তা একবারের জন্যও বোঝা গেল না। কি অসাধারন ব্যক্তিত্বের অধিকারী এ ভদ্রলোক। চমৎকার গাড়ি চালান। এত ভালো লাগছে কেন? বাইরে ঠান্ডা তাই নাকি আঁধার তাই? রাতের আঁধার কি ভালোলাগাকে দ্বিগুন করে দেয়?
দু’ঘন্টা গাড়ী ড্রাইভ করে দু’জনে পৌঁছে গেলো পরিত্যক্ত লন্ডনের ঐ বাড়িতে। বাড়িটা কি অসাধারন সুন্দর। বাড়িতে ঢুকতেই সুন্দর বড় একটা গেইট। তার চারিদিকে পুরনো আমলের কতগুলো টব দেয়া। দেখলেই বোঝা যায় যে এ বাড়িতে অনেক ফুলের গাছ ছিল। বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করতেই সুনন্দা দেখলো যে পুরো বাড়িটাই ছিমছাম, টিপটপ করে সাজানো। বোঝার কোন উপায়ই নেই যে এটা একটা পরিত্যক্ত বাড়ি। ভদ্রলোক বললেন যে উনি মাঝে মাঝেই এ বাড়িতে আসেন। ও বাড়ির দেখাশোনা করেন। ভদ্রলোক প্রথমেই কাঠের চুল্লী জ্বালালেন। কাঠের বাড়ি তাই প্রচন্ড ঠান্ডা। কাঠের চুল্লীর অভিজ্ঞতাও সুনন্দার এই প্রথম। খুব ভালো লাগছিল সুনন্দার। এক বিরল অভিজ্ঞতা। ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, “চা খাবেন?”
হ্যাঁ খেতে পারলে ভালো হতো, তবে এখানে চা কোথায় পাবেন?
ব্যবস্থা আছে, দাঁড়ান বানাচ্ছি।
ভদ্রলোক চা বানাতে শুরু করলেন। কাঠের চুল্লীর ওপর কেতলী বসিয়ে দিলেন। গরম পানি ফুটতে লাগলো। সাথে ভদ্রলোক দু’টা টি ব্যাগ দিয়ে দিলেন। দু’টা বড় পুরনো আমলের মগ নিয়ে এলেন এবং তাতে চমৎকার ভঙ্গিতে চা পরিবেশন করলেন।
সুনন্দার মনে একটু খটকা লাগে, ভদ্রলোক কোন খারাপ উদ্দেশ্যে ওকে এখানে নিয়ে আসেনিতো? অপরিচিত এক মানুষের সাথে এত রাতে অচেনা দেশে পরিত্যক্ত বাড়িতে আসাটা বোধ হয় ঠিক হয়নি। তার মধ্যে বলেছেন যে উনি পাইলট। আল্লাহ্ একি ভুল করলাম।
ভদ্রলোক বললেন যে, আপনি কিসে পড়েন?
আমি মনোবিজ্ঞানে তৃতীয় বর্ষে পড়ি।
মনোবিজ্ঞানী? পাগল নিয়ে পড়াশোনা না মন নিয়ে?
সব কিছু নিয়েই করি। আপনি কত বছর প্লেন চালান?
আমি সাত বছর ধরে প্লেন চালাই।
সাত বছর? একটা ব্যতিক্রমধর্মী অভিজ্ঞতার কথা বলবেন প্লিজ?
অনেক আছে কোনটার কথা বলব। দাঁড়াও তোমার দেশের একটি ঘটনা বলি। আমি তখন দুবাই বাংলাদেশ রুটের পাইলট ছিলাম। একবার বাংলাদেশ যাচ্ছি হঠাৎ করে প্লেনের ইঞ্জিনে একটু সমস্যা দেখা দেয়। বাংলাদেশের এয়ারপোর্ট অথরিটি সেটা জানতে পারেন এবং ফ্লাইট নামাবার অনুমতি দেন না। কারণ ইঞ্জিনে আগুন ধরে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। এদিকে আমি আধঘন্টা আকাশে বিমান ঘুরাচ্ছি, যাত্রীদের মাঝে আতংক। যে কোন সময় যে কোন বিপদ দেখা দিতে পারে। সেদিন ফ্লাইটে ৩৫০ জন যাত্রী ছিল। অনেক চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত আমরা ভারতের সাথে যোগাযোগ করি। কোলকাতা এয়ারপোর্ট ফ্লাইট ল্যান্ডিংয়ের অনুমতি পাই। পরে একঘন্টা ফ্লাই করে শেষে আমি ফ্লাইট কোলকাতা নামাই। যদিও শেষে কোন বড় দূর্ঘটনা হয়নি তবুও অসম্ভব আতংকে কেটেছিলো ঐ একঘন্টা সময়। যাত্রীদের চিৎকার আমার অনভিজ্ঞতা সব কিছু এক সাথে মিশেছিল। চার বছর পার হয়ে গেছে তবুও সেদিনের কথা মনে হলে আজও আমার গা শিরশির করে।
তোমার জীবনের কোন মজার কাহিনী বলো?
আমার জীবনের মজার কাহিনী অনেক আছে। তার মধ্য থেকে একটি বলছি। আমার ছাত্রী জীবনের প্রথমদিকের ঘটনা। আসলে প্রথম মাসের ঘটনা। গ্রীষ্মে আমি প্যারিসে প্রথম যাই। ফ্রেঞ্চ ভাষাও ভালো করে জানি না। বন্ধু বান্ধবও তেমন হয়নি আর আত্মীয় স্বজনতো একেবারেই নেই। রাতে গরম, প্যারিসে প্রথম প্রথম সবকিছু টাকায় হিসাব করতাম। তাই এসিও ছাড়ি না। যাই হোক ভাবলাম একটু হাঁটতে যাই। নদীর ধারে অনেক গ্রীষ্মের ফুল ফুটেছে-আমি নির্জন এলাকা দিয়ে রাতে হাঁটছি আর গান গাইছি। এমন সময় হঠাৎ করে দেখি একজন লোক দৌড়ে এসে আমার সামনে দাঁড়ালেন এবং সুন্দর একটা হাসি দিয়ে প্যান্টটা খুলে দেন। আমি কোনদিন কোন বিদেশীকে উলঙ্গ অবস্থায় দেখিনি। জীবনে ওটাই প্রথম। আমি ভয়ে বিস্ময়ে চিৎকার করে চোখ বন্ধ করে দেই দৌড়। কতক্ষণ দৌড়িয়েছি জানি না। তবে যখন চোখ খুলি তখন দেখি আমি একটি বাড়ির সামনে দাঁড়ানো। বাড়ির বৃদ্ধা আমাকে দেখেই অনেক কিছু ফরাসী ভাষায় জিজ্ঞাসা করলেন। আমি কিছুই বুঝতে পারিনি সেদিন। কারন আমি ফরাসী ভাষা ভালো বুঝতাম না। শুধু ঠিকানাটা বলি এবং ওনারা আমাকে বাসায় নামিয়ে দেন।

ভদ্রলোক একথা শুনে হাসতে হাসতে বলেন যে পৃথিবীর সব দেশের পুরুষেরই শারিরিক গঠন এক। এটা নিশ্চয়ই তুমি এত দিনে বুঝে গেছো। ভদ্রলোক নিজের অজান্তেই সুনন্দাকে তুমি বলে ফেলে। এরকম এলোমেলো কথার বিন্যাসে অনেক রাত হয়ে যায়।

সুনন্দা ভাবে কি আশ্চর্য। এত গভীর রাত বাইরে তুষার পড়ছে, ঘরে আলো আগুন জ্বলছে। তারপরও একজন পাইলট আমার মতন সুন্দরীর কাছেও আসছেন না হাতও ধরছেন না? কেন? হাত ধরলে কি হয়? হাতটা ধরুক না প্লিজ। আমার লোকটিকে খুব ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে। একে কি ভালোবাসাকে ছুঁয়ে দেখতে বলা বলে?
লোকটি মনে মনে ভাবে ছূঁতে তো চাই তোমাকে মেয়ে- পারি না যে। এতে তুমিই আমাকে পরে বলবে হায়রে পুরুষ নারী মাংসের লোভ সামলাতে পারলে না। তোমার প্রতি এত দুর্বলতা কেন অনুভব করছি? এত তাড়াতাড়িতো এ বয়সে ভালোবাসা হয় না। তার অর্থ কি ভালোবাসা এই একবিংশ শতাব্দীতেও আছে?

এভাবেই চোখের সাথে চোখের, মনের সাথে মনের কথার মাধ্যমেই রাত পেরিয়ে ভোর হয়ে যায়। জানা যায় যে সেদিনও কোন ফ্লাইট ছাড়বে না। তাই দু’জনে হোটেলে ফিরে একটু বিশ্রাম করে বিকেলে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে যাবো বলে সিদ্ধান্ত নেয়। বিকেল পাঁচটায় লবিতে অপেক্ষা করবো বলে জানায়।

বিকেল পাঁচটায় সুনন্দা ও ভদ্রলোক ব্রিটিশ মিউজিয়ামে যায়। ব্রিটিশ মিউজিয়ামে পৌঁছে তো সুনন্দার চোখ চড়ক গাছ। এত বড় মিউজিয়াম। ঢুকতেই বড় বড় ডাইনোসরের কঙ্কাল রাখা। অনেক সেকশন আছে ঐ মিউজিয়ামে ব্রিটিশ সেকশন। ইউরোপীয়ান সেকশন, ভারতীয় বিভাগসহ অনেক বিভাগ। মিউজিয়ামে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ করেই নিজের অজান্তেই সুনন্দা ভদ্রলোকের হাত ধরে ফেলে। ভদ্রলোক লক্ষ্য করলেও কিছু বলেন না। সুনন্দার মনে হচ্ছে কত দিনের পরিচয়। হাত ধরে থাকতে এত ভালো লাগছে কেন? সারাজীবন আমি এ হত ধরে থাকতে চাই। চাই এরকম নিরাপত্তা। হাঁটতে হাঁটতে রাতের খাবারের সময় হয়ে যায়। ভদ্রলোক বলেন যে চলো আজ তোমাকে ব্রিটিশ ডিনার খাওয়াবো। ব্রিটিশ ডিনার হলো স্ম্যাশ পটেটো, গ্রীল মিট ও সেদ্ধ সব্জি। খাবার শেষে ভদ্রলোক বললো চলো আজ তোমাকে রাতের ব্রিটেন দেখাই। রাতে দু’জন বরফের মতো হাঁটছে। প্রচন্ড ঠান্ডা শীতে জমে যাবার মতন অবস্থা। পথ ঘাট শ্মশানের মত জনশূন্য। মাঝে মাঝে দু’একটা গাড়ি যায়। এত ঠান্ডার মাঝেও হাঁটতে ভালো লাগছে কারণ পথ পিচ্ছিল, একটু একটু পা ফসকে যাচ্ছে এবং এতে করে ভদ্রলোক সুনন্দার হাত ধরছে। সুনন্দার যে কি আনন্দ লাগছে! অভিনব অভিজ্ঞতা এই ভদ্রলোককে এত ভালো লাগছে কেন? স্বল্পভাষী লোকটি কথা কম বলেন। এ রাত যেন কখনো শেষ না হয়। বুকে এক আজব ধরণের অনুভূতি অনুভূত হচ্ছে। ঝিরি ঝিরি তুষার, কনকনে ঠান্ডা, অচেনা বন্ধুর অজানা হাত, নিঃশব্দ নির্জন রাত্রি, ভিন্ন মহাদেশ সব মিলিয়ে এক ব্যতিক্রমধর্মী আনন্দ। এ ভালোলাগা আমি কারে বোঝাবো? অথবা কি করে ভুলবো? সারাজীবন ধরে আমি এ আনন্দ উপভোগ করতে চাই। সারাজীবন এ মানুষটির সাথে আমি জীবন যাপন করতে চাই।

ভদ্রলোক ভাবেন মেয়ে এত তাড়াতাড়ি কাছে আসতে চাও কেন? আর একটু জানো আমাকে। দেখে নাও আমাকে। ভালোতো আমারও লাগছে। জীবনটাতো অনেক বড়। বহমান এ জীবনে অনেক ঘটনাই ঘটে। এত তাড়াতাড়ি এত ভালোবাসা কেন? এভাবে দেখো না- ভুলতে পারবো না। তোমার চোখ আমার হৃদয়কে শিহরিত করে দেয়, শরীরে এনে দেয় মৃদু কম্পন।
হোটেলে ফিরতে ফিরতে রাত আটটা বেজে যায়। পরের দিন ফ্লাইট ছাড়বে কিনা তা কেউ জানে না। তবে সম্ভাবনা আছে। তাই সবাইকে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সকালে নাস্তার টেবিলে আবার দেখা হবে বলে যে যার রুমে চলে যায়। ঘুম থেকে উঠতে সুনন্দার সকাল আটটার মতন বেজে যায়। সকাল ন’টায় নাস্তার টেবিলে এসে জানতে পারে যে দুবাইয়ের ফ্লাইট সকাল আটটায় ছেড়ে চলে গেছে এবং সে কারনেই ব্রেকফাস্ট রুমে ভদ্রলোক নেই। সুনন্দার কামড়া নম্বর ভদ্রলোক জানতেন না তাই বোধ হয় জানাতে পারেননি। আচ্ছা তাকে পরে ইমেইল করা যাবে। একথা ভেবে নাস্তা সেরে সুনন্দা নিজের ফ্লাইটের খোঁজ নিতে যায়। দুপুর দু’টায় ঢাকার ফ্লাইট ছাড়বে।
এয়ারপোর্টে চেকিং করে দেখে বোর্ডিং করতে আরো ত্রিশ মিনিট বাকি। তাই সুনন্দা ভাবলো যে ভদ্রলোককে একটি ইমেইল করি আর ফেইসবুকে এড করি। সুনন্দা কম্পিউটার অন করে ব্যাগ থেকে ভদ্রলোকের কার্ড বের করবে বলে ব্যাগ খুলে। ব্যাগ খুলে দেখে কোন নতুন কার্ড নেই। হঠাৎ করে মনে পড়ে যে ভদ্রলোকের নাম জিজ্ঞাসা করা হয়নি। কার্ড দেয়া বা নেয়া হয়নি। ভদ্রলোকও তার নাম জানে না। সুনন্দাতো বলেনি তার নাম, দেয়নি তার কার্ডও। সুনন্দা শুধু জানে এমিরেটস পাইলট। কিন্তু কোন স্টেশনের পাইলট? দুবাই-বাংলাদেশ না বলেইতো মনে হয়। কিভাবে খুঁজবো ওনাকে? এটা ভাবতেই নিজের অজান্তেই সুনন্দা ‘না-অ-আ’ বলে চিৎকার করে আর লবির সবাই তার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। সুনন্দা অস্থির মন নিয়ে ফ্লাইটে উঠে বসে। কোন কিছুতেই মন বসে না। কোন অবস্থাতেই তার নিজের এত বড় বোকামির কথা মানতে পারে না। দু’রাতে একবারও কেন তার মনে হয়নি যে তার নাম সে জানে না, কেন জিজ্ঞাসা করেনি তার নাম। কোন দেয়নি তার কার্ড। কেন, কেন এবং কেন? শত কেন’র বোঝা মনে নিয়ে এমিরেটস এর ফ্লাইট নামে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে।

দেশে ফিরে সুনন্দার কোন কিছুতেই মন বসে না। বুকে অনুভূত হয় সব সময়ই অস্থিরতা আর হৃদয়ে অনুভূত হয় এক অদ্ভুত ব্যাথা। একেই কি রোমান্টিক পেইন বলে। শুনেছিলাম ‘দুরত্ব সম্পর্ককে দূরে ঠেলে দেয়’ অথবা ‘চোখের আড়াল হলে মনের আড়াল হয়।’ আমার হৃদয়ের সাথে তার হৃদয় ভালোবাসার কথা বলছে- কেন আমার এরকম মনে হচ্ছে? মন তো শান্ত হয় না। কি করা যায়? খোঁজার কি শেষ চেষ্টা করবো একটু। কিভাবে খুঁজবো ফেইসবুকে কিন্তু কি নামে খুঁজবো? দেখি এমিরেটস পাইলট এ নাম দিয়ে। এ নাম দিয়ে সার্চ  দিলেতো আসে ‘নো রেজাল্ট ফাউন্ড’। পরবর্তী আহমেদ এমিরেটস পাইলট। এভাবে নেটে খুঁজতে খুঁজতে একদিন পার হয়ে যায় কিন্তু কোন ক্লু-ই পায় না সুনন্দা। এরপর ভাবে যে সে এমিরেটস দুবাইকে ফোন করবে। আমারতো ওকে খুঁজে বের করতেই হবে। এমিরেটস দুবাইয়ের কোন নম্বর ইন্টারনেট থেকে বের করে এমিরেটস প্রধান শাখায় টেলিফোন করে সুনন্দা। হাজার হাজার পাইলটের মাঝে কে দু’দিন লন্ডনের ট্রানজিটে ছিল তা কেউ বলতে পারে না।  
এভাবে চলে যায় এক মাস। সুনন্দার মন শান্ত হয় না। কিছুতেই মন মানে না তাই সে ঐ ভদ্রলোককে একটি চিঠি লেখবার সিদ্ধান্ত নেয়। শেষ পর্যন্ত একটি চিঠি লেখে সুনন্দা।

প্রিয় তুমি,
শুভেচ্ছা রইল।  জানি না তুমি এ চিঠিটা পাবে কিনা? যদি পাও তবে জেনে নিও তোমার ঐ ট্রানজিটের সুনন্দাই তোমাকে এ চিঠিটা লিখছে। জানো তোমাকে দেখার পর আমার মন কি পরিমাণে অশান্ত। কোন কিছুতেই মন বসাতে পারছি না। আবার বুঝতেও পারছি না যে কেন নাম না জানা একজনের জন্য এত ভালোবাসাই বা কেন? তুমিও কি আমাকে এত ভালোবাসো? আমার পরিচয়তো তোমাকে দেয়া হয়নি। আমি সুনন্দা চৌধুরী। বয়স ২৮ বছর, অবিবাহিত। বাংলাদেশী, প্যারিসের স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানে পড়ছি। আমার ইমেইল-sunonda@gmail.com. যদি তুমি আমার এ চিঠিটা পাও তবে আমাকে ইমেইল করো। এ চিঠিটা আমি তোমাকে ধন্যবাদ জানানোর জন্য লিখছি। কেন জানো? কারণ, তোমার কাছে এসেই আমি সত্যিকারের ভালোবাসাকে জেনেছি। অনুভব করেছি ভালোবাসার ব্যাথা। ইন্টারনেট, ফেইসবুক, আধুনিকতা আমাদের ভালোবাসা ভুলিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তোমার কাছে এখনো তা অক্ষত রয়েছে। তুমিই শেখাতে পারো নিঃস্বার্থ ভালোবাসার পবিত্র সংজ্ঞা। ভালোবাসি তোমাকে, কাছে চাই তোমাকে, এক সাথে চলতে চাই তোমার সাথে। আমার ভালোবাসা সত্য হলে জানি তুমি আমার হবে, আসবে আমার কাছে। প্রবাহমান এ জীবনে। ক্ষুদ্র এ বিশ্বে আমাদের ভালোবাসা আমাদের আবারো মিলিয়ে দেবে। সৃষ্টি যে ভালোবাসার নকশার অর্ধেকটা আমাকে দিয়েছে তার বাকি অর্ধেকটা তোমার কাছে রয়েছে। জানি এ নকশা একদিন একটি পূর্ণ নকশায় পরিণত হবে। কারণ সৃষ্টি কখনোই অসম্পূর্ণতা পছন্দ করে না, যদিও রহস্য পছন্দ করে তাই রহস্যের তৈরী করে। সব সময়ই ভালো থাকো এ প্রত্যাশায়, আর সর্বদাই আমার ভালোবাসায় থাকো। এই কামনায়-
সুনন্দা।

সুনন্দা এ চিঠিটা লিখে ভাঁজ করে কিভাবে পাঠাবে তা ভাবতে থাকে। চলে যায় যমুনা ব্রিজের কাছে। সন্ধ্যা পর্যন্ত বসে থাকে সুনন্দা তাকিয়ে থাকে যমুনা নদীতে অস্ত যাওয়া সূর্যের দিকে। হঠাৎ একটি পায়রা সুনন্দার কোলে এসে বসে। সুনন্দা চিঠিটি পায়রার পাখায় বেঁধে দেয়। পায়রাটি উড়ে চলে যায়। পায়রাটি যতক্ষণ উড়তে থাকে ততক্ষণ সুনন্দা পায়রাটির দিকে তাকিয়ে থাকে। পায়রাটা কোনদিকে যাচ্ছে? দুবাইয়ের দিকে? কি জানি? ওকি পারবে এ চিঠিটা তার কাছে পৌঁছে দিতে? ও কি পারবে আমার নাম না জানা সেই ভালোবাসার মানুষটিকে আমার করে দিতে? সুনন্দা অপেক্ষায় থাকে।

ড. তানিয়া হোসেন : শিক্ষক, ওয়াসেদা বিশ্ববিদ্যালয়, টোকিও, জাপান। (ডিনিউজ)

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়