Sunday, June 30

পিরোজপুরে নদী আর সবুজের ছোঁয়া


ঢাকা: হুলারহাটের মাইল চারেক দূরে পিরোজপুর শহর। এরই পশ্চিম দিক থেকে বয়ে গেছে বলেশ্বর নদী। নদীর ওপারেই বাগেরহাট জেলা। পিরোজপুর এক সময় ছিল মহকুমা শহর। সে তো বহু বছর আগেকার কথা। বেড়ানোর জন্য পিরোজপুর বেশ আকর্ষণীয়। বহু স্মৃতিবিজড়িত শহর এ পিরোজপুর।

আমার শৈশবের অনেক বছর এখানেই কেটেছে। আজ অনেক স্মৃতিই এ শহর থেকে হারিয়ে গেছে। এখানকার দেশখ্যাত ব্যক্তিত্ব তৎকালীন মন্ত্রী আফজাল মিয়ার দ্বিতল ভবন আছে। কিন্তু তিনি বহু বছর হয় পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। শহরের প্রধান সড়কের উত্তর পাশেই আফজাল মিয়ার বাড়ি। পাশেই ঈদগাহ। এ বাড়িটি স্মরণ করিয়ে দেয় পিরোজপুরের ইতিহাসের অনেক স্মৃতিময় কাহিনী।

পিরোজপুর শহরের কাছে পিঠে রায়েরকাঠি জমিদার বাড়ি। পিচঢালা পথ ধরে হেঁটে কিংবা রিকশায় ওখানে যাওয়া যায়। রায়েরকাঠি জমিদার বাড়ি স্মরণ করিয়ে দেবে নানা স্মৃতি।

জমিদারদের ছিল দালানকোঠা, বসতবাড়ি, মন্দির, নাট্যশালা কত কী। তবে এখন এখানে গেলে দেখা মিলবে কয়েকটি মন্দির আর মঠ। পাশেই দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ। এখানে সকালে-বিকালে খেলা করে উঠতি বয়সের ছেলেরা। গ্রীষ্মকালে মাঠের কাছে এসে দাঁড়ালে কখনও বা আকাশে কালো মেঘ দেখে হয়তো ভাববেন, রায়েরকাঠি কী ছিল, কী হয়ে গেল।

একে একে দেখে নিন মঠ ও মন্দিরগুলো, এ সব আজ সংরক্ষণের অভাবে জঙ্গলে ভরে গিয়েছে। এখানে দাঁড়িয়ে পুরনো ইতিহাস খুঁজতে আপনিও ব্যাকুল হবেন। দেখবেন, জমিদার বাড়ির নহবৎখানা, অতিথিশালা, নাট্যশালা। এসব আলাদা করে আর চেনা সম্ভব নয়। সবকিছু ভেঙে পড়েছে।

ধূসর স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছে রায়েরকাঠি জমিদার বাড়ি। মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে ১৬২০ সালে জমিদার বংশের গোড়াপত্তন হয় এখানে। অমরেন্দ্র রায় চৌধুরী ছিলেন শেষ জমিদার। সেই আমলে এখানে দূর্গাপুজা থেকে শুরু করে সব পুজাই হতো সাড়ম্বরে।

রায়েরকাঠির ধ্বংসাবশেষ মন্দির দেখায় রয়েছে বেশ আনন্দ। উত্তরমুখী শিখররীতির মন্দিরটি দিয়ে দেখা শুরু করুন। এর উত্তর-দক্ষিণে দুটি দরজা। পাশের মন্দিরটিও বেশ সুন্দর। দ্বিতল এবং অলঙ্কারবহুল। এটি শিবমন্দির ছিল।

এ মন্দিরটির চারদিকে চারটি দরজা দেখতে পাবেন। ছয়ভুজা মন্দিরটির ওপর ছোট একটি এক বাংলা বা চারচালা রীতির ছাউনি রয়েছে। তবে মঠটি দেখার মতো। এটি একতলা একটি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে এবং চারদিকে ছোট চারটি শিখররীতির রত্ন আছে। সব মিলিয়ে এটি পঞ্চরত্নবিশিষ্ট।

এসব দেখা শেষ করে আসুন কালীমন্দির, দুর্গামন্দির আর জমিদার বাড়ির কাছে। প্রবীণদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে শুনবেন অতীতের কত না কাহিনী। একদা (১৯২২ সালে) নাট্য সম্রাট শিশির কুমার ভাদুড়ী তার দলবল নিয়ে এখানে এসেছিলেন নাটক করার জন্য। এ কথা শুনে ভাববেন, কী ছিল নামধাম, কী হয়ে গেল আজ জমিদার বাড়ির। সংরক্ষণের যে বড়ই অভাব এখন।

বর্তমানে পিরোজপুর শহর অনেক বড় হয়ে গেছে। নতুন যারা এখানে বেড়াতে আসবেন রিকশা নিয়ে তারা ঘুরে দেখবেন ছায়াঢাকা-মায়ামাখা পিরোজপুর শহরখানি। সর্বত্রই সবুজে ছাওয়া। তখন হয়তো আপনার হৃদয়ে ভেসে উঠবে কবিগুরুর লেখা ‘এ কি এ সুন্দর শোভা! কী মুখ হেরি এ! আজি মোর ঘরে আইল হৃদয়নাথ, প্রেম-উৎস উথলিল আজি॥ বলো হে প্রেমময় হৃদয়ের স্বামী, কী ধন তোমারে দিব উপহার। হৃদয়-প্রাণ লহো লহো তুমি কী বলিব যাহা কিছু আছে মম সকলই লও হে নাথ’ কবিতার এই চরণগুলো।

এখানে বলেশ্বরের তীরে রয়েছে বহু বাড়িঘর। নদীর ওপর ব্রিজ, সদর রাস্তা শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত। মসজিদ, মন্দির, রামকৃষ্ণ মিশন, মঠ, কালীবাড়ি, রিজার্ভ পুকুর, ডিসি পার্ক, রাজারহাট, কুমারখালী, শঙ্করপাশা, বিশ্বরোড, সিঙ্গাপুরী শামীদের বাড়ি, আফজাল মিয়ার বাড়ি, চৌধুরী বাড়ি এখানের অন্যতম আকর্ষণ।

অর্থাৎ ৫০ বছর আগে যিনি এই শহর ছেড়ে চলে গেছেন প্রবাসে কিংবা অন্যত্র, তিনি যদি আসেন তাহলে পিরোজপুর দেখে স্মৃতির জগতেই ফিরবেন। ১৯৬০-৬২ সালের সঙ্গে এখনকার শহরের কোনোই মিল নেই। দামোদর খাল কচা আর বলেশ্বরের সঙ্গে মিশেছে।

খালটি আজ বিলুপ্তির পথে। তবে জোয়ারে এই খাল হয়ে নৌকায় করে হুলারহাটে বেড়ানোতে রয়েছে আনন্দ। সেদিনের সেই কিশোর বালকটির তখন মনে পড়বে

রফু, রুস্তম, কালো খোকা, আবদুল মান্নান, অরবিন্দু, কুদ্দুস, সিদ্দিক, তোতা, জিন্নাত, মোক্তার, আজিজ মল্লিক, সোবহান মোক্তার, চান মিয়া, বাদশা চৌধুরী, আফজাল মিয়া, আফতাব মিয়া, দরবেশ আলীর নামগুলো।

পিরোজপুর সরকারি উচ্চ বালক বিদ্যালয়ের কাছে এসে দাঁড়ালে টিনশেড ভবনের কথা মনে পড়বেই। টিনশেড ভবনে একদা লেখাপড়া করেছিলেন বাংলার আধুনিক কবি আহসান হাবিব। তার কথা মনে হলে ইচ্ছে জাগবে শঙ্করপাশায় যাওয়ার।

কবি আহসান হাবিবের জন্মস্থান তো শঙ্করপাশায়। রিকশা নিয়ে ওই পথে গিয়ে শুনবেন ‘বউ কথা কও’ পাখির ডাক। পিরোজপুর থেকে রিকশায় শঙ্করপাশায় যেতে ২৫ মিনিট সময় লাগবে। আহসান হাবিবের জন্মস্থান দেখে মনে পড়বে ‘রাত্রিশেষ’, ‘ছায়া হরিণ’, সারা দুপুর কাব্য, জাফরানি রঙ পায়রা’ ও ‘আরণ্য নীলিমা’ উপন্যাসের কথা।

রিকশা নিয়ে যদি পারেরহাটে চলে যান তখন দেখবেন নদী। তখন আবারও মনে পড়বে কবি আহসান হাবিবের কথা। তিনিই তো লিখেছিলেন ‘এই যে নদী/নদীর জোয়ার/নৌকা সারে সারে/একলা বসে আপন মনে/ বসে নদীর ধারে/এই ছবিটি চেনা’ কবিতার এই লাইনগুলো।

পড়ন্ত বিকালে না হয় আসুন পিরোজপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে। এখানে এসে দাঁড়ালে মনে পড়বেই আহসান হাবিবের লেখা ‘মাঠের পরে মাঠ চলেছে/নেই যেন এর শেষ...’ কবিতার এই চরণ দু’টি। তখন প্রশ্ন সহকারে অনুশোচনা জাগবে, সেই মাঠ কোথায়? হারিয়ে গেছে কত মাঠ প্রান্তর!

সেখানে গড়ে উঠেছে বাড়িঘর। যেন শ্যামল ছায়া হারাতে বসেছে পিরোজপুর শহরখানি। কত কৃষি জমি নষ্ট করে সেখানে বাড়িঘর ও নতুন নতুন ভবন স্থাপিত হয়েছে। বলেশ্বর তীরে ছিল ফসলী জমি। তাও সময়ে নষ্ট হয়ে গেছে। এখনকার ছেলেটি কি আর তা জানবে!

পায়ে হেঁটে আসুন আদর্শ বিদ্যালয়ের কাছে। একদা এই স্কুলটির নাম ছিল ‘হিন্দু স্কুল’। কত নামধাম এই স্কুলের। কড়া শাসন ছিল তখন। পুজোর সময় এই স্কুল কম্পাউড নব সাজে সেজে উঠত। ঢাকঢোল-বাদ্য বাজত। পুজো দেখার জন্য জনতার ভিড় লেগেই থাকতো।

পাশেই কুঞ্জ বাবুর বাড়ি। এই বাড়িতে বারো মাসে তেরো পার্বণ লেগেই থাকত। ১৯৫৭ থেকে ১৯৬৯ পর্যন্ত এই বাড়িতে ধূমধাম সহকারে রয়ানী কীর্তন চলত। তা দেখার জন্য হাজারো মানুষ ভিড় করত। আজ কুঞ্জ বাবু নেই। সেই উৎসবও হারিয়ে গেছে চিরতরে। বড় মসজিদ আছে। কিন্তু নেই সেই হাফেজ সাহেব। তখন অনুশোচনা জাগবে!

পিরোজপুরে সাংস্কৃতিক উৎসব আজও হয়। কিন্তু যে বালকটির বয়স আজ ষাট, তিনি তো অতীত ভুলে যাননি এখনও। পিরোজপুরের কেউ বেড়াতে এলে তিনি গাইড হয়ে অকপটে বলে যান কণ্ঠশিল্পী ক্ষমাদাশ গুপ্তার কথা। ‘আমারও দেশের মাটির গন্ধে ভরিয়াছে সারাময়’এ গান গেয়ে তিনি সারা শহর মাতিয়েছিলেন। তা কি ভোলার! সে তো প্রায় ৫০ বছর আগেকার কথা।

পিরোজপুরে যে কদিন থাকুন না কেন, ভুলে যাবেন না আশপাশের গাঁও-গেরাম দেখতে। কচা নদীর অববাহিকায় বেশ বড় গ্রাম পাঙ্গাশিয়া। এখানে এসে সবুজ গাছ-গাছালির সৌন্দর্য উপভোগ করুন। দেখা মিলবে নানা প্রজাতির পাখ-পাখালির। গ্রামবাসীর সঙ্গে তাদের দৈনন্দিন কাজেও ইচ্ছা হলে হাত লাগাতে পারেন। আপনি যদি চিকিৎসক কিংবা শিক্ষক হন অথবা শিল্প অনুরাগী হন তাহলে চাদের স্কুলে গিয়ে তাদের হেলথ চেকআপ বা পড়ানো অথবা শিল্প সৃষ্টিতে মেতে উঠতে পারেন।

হুলারহাটের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে বিশাল কচা নদী। এর ওপারেই পাঙ্গাশিয়া গাঁওখানি। এখানেই পুকুর-দীঘি, সবুজ প্রান্তর সবই চোখে পড়বে। নদীতীরে মহিষ চড়ে বেড়ানো, রাখালের হাতে বাঁশি, ঘুঘুর ডাক শুনে সবুজ মাঠের দিকে পা বাড়ান। দেখবেন তখন প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেয়ার সুযোগটুকু পাবেন। তখন মনে হবে পিরোজপুর বেড়ানো যে সফল হলো!

যেভাবে যাবেন : ঢাকা থেকে সড়ক পথে দোলা, ঈগল, পর্যটন, বলেশ্বর, সুন্দরবন পরিবহনে পিরোজপুর যাওয়া যাবে। দোলা পরিবহন ছাড়ে সায়েদাবাদ থেকে। ফোনে টিকিট বুকিং দিতে পারেন। ফোন করুন : ০১৫৫২-৪৬২৮৫২, ০১১৯৯০৩০১৮১, ৭৫৪২৮৮১। পিরোজপুর কাউন্টার নতুন বাসস্ট্যান্ড। ফোন : ০১৭৩৯৬১২২৯৯, ০১১৯০৩৭০০২২। খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী, চট্টগ্রাম থেকেও সড়কপথে বাসে পিরোজপুর যাওয়া যাবে। নদীপথে সদরঘাট থেকে লঞ্চ ছাত্মে অগ্রদূত, টিপু, আচল, রাজদূত। এগুলো এসে থামে  হুলারহাটে।

যেখানে থাকবেন : রাতযাপন করার জন্য পিরোজপুরে বেশ কয়েকটি আবাসিক হোটেল রয়েছে, যেমন- পদ্মা, ছায়ানীড়, বিলাস, রিলাক্স, শরীফ রোজ গার্ডেন, নিরালা প্রভৃতি।

কত টাকা খরচ হবে : ৩ থেকে ৪ দিন সময় হাতে নিয়ে যাবেন। তাহলে ভ্রমণের দিনগুলো হবে আনন্দের। এ ভ্রমণে জনপ্রতি ৩ হাজার টাকা নিয়ে গেলেই চলবে।(ডিনিউজ)

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়