ঢাকা : দুই টাকা ধার চেয়েও পাননি। থেকেছেন অনাহারে। মুখ বুজে সহ্য করেছেন স্বামীর অত্যাচার। পায়ে হেঁটে চলেছেন মাইলের পর মাইল পথ। পোশাক কন্যা সেই রেশমা এখন কেবলই ইতিহাস। প্রবেশ করেছেন নতুন জীবনে। যোগ দিয়েছেন পাঁচ তারকা হোটেল ওয়েস্টিনে। পদের নাম পাবলিক এরিয়া অ্যাম্বাসেডর। যাতায়াত করছেন এসি গাড়িতে। কাজ করছেন এসি অফিসে। বৃহস্পতিবার ওয়েস্টিন কর্তৃপক্ষ স্থায়ী নিয়োগপত্র হাতে তুলে দেয়ার পরপরই বদলে গেছে তার জীবন-যাপন। মাসিক বেতন তুলবেন ৪০ হাজার টাকার বেশি। ঈদ বোনাস, বিশেষ ভাতা ছাড়াও আছে নানা সুযোগ-সুবিধা। এ উপলক্ষে বৃহস্পতিবার বিকাল আড়াইটায় গুলশানের হোটেল ওয়েস্টিনের কনফারেন্স রুমে জমকালো আনুষ্ঠানিকতার আয়োজন করা হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন রেশমা। তার সঙ্গে ছিলেন ইউনিক গ্রুপের চেয়ারম্যান সেলিনা আলী, এমডি মোহাম্মদ নূর আলী ও ওয়েস্টিনের জেনারেল ম্যানেজার আজিম শাহ। ‘ওয়েলকাম টু রেশমা’ শিরোনামের ওই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়েছেন দেশী-বিদেশী গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব। হাজির ছিলেন একাধিক দেশের দূতাবাস কর্মকর্তা। তাদের উপস্থিতিতে রেশমার হাতে স্থায়ী নিয়োগপত্র তুলে দেন সালমা আলী। এ সময় রেশমা হোটেলের ইউনিফরম পরা ছিলেন। বসেছিলেন হোটেল কর্তাদের মাঝখানের চেয়ারে। সাংবাদিকরা তার অনুভূতি জানতে চাইলে বলেন, আগে ছিলাম গার্মেন্টের শ্রমিক। কষ্ট ও যন্ত্রণার নিত্যসঙ্গী। এখন আমি ওয়েস্টিনের অফিসার। এখানে যোগ দিয়ে বেশ ভাল লাগছে। তার কথায় মুহুর্মুহু করতালি দেন আমন্ত্রিত অতিথিরা। ইউনিক গ্রুপের এমডি মোহাম্মদ নূর আলী বলেন, রেশমার জন্য এটা শুধু চাকরি নয়, ওয়েস্টিন কর্তাদের মহৎ প্রাণের উজ্জ্বলতার প্রতীক। সামাজিক দায়িত্ববোধের জায়গা থেকেই এমন কাজ করে থাকি আমরা। ভবিষ্যতেও করে যাবো। রেশমার মতো লড়াকু জীবনের দায়িত্ব নিতে পেরে ওয়েস্টিন গর্বিত হয়েছে। রেশমা আমাদের শিখিয়েছে, প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে কিভাবে বেঁচে থাকা যায়। কিভাবে চ্যালেঞ্জ নিয়ে জয়ী হওয়া যায়। তিনি বলেন, রেশমার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছি দুই কারণে। ধ্বংসস্তূপে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও সে ১৬ দিন বেঁচেছিল। আর উদ্ধার হওয়ার পরই বলেছিল, পোশাক কারখানায় চাকরি করবে না। এমন কথা শোনার পরই ওয়েস্টিন কর্তৃপক্ষ তার জন্য চাকরির প্রস্তাব নিয়ে যায়। অবশ্য তার সামনে অনেক প্রস্তাব ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রেশমা ওয়েস্টিনকেই বেছে নিয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানকে রেশমা কতটুকু দিতে পারবে সেটা বড় নয়, আমরা তাকে কতটুকু দিতে পারবো সেই চেষ্টাই করে যাবো। অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে ওয়েস্টিনের উত্তরীয় পরিয়ে দেয়া হয় রেশমাকে। অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে প্রশ্নোত্তর পর্বে একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, আপনি তো ভবন ধসের পর এনামুল নামে একজন সহকর্মীর হাত ধরে বাইরে বেরিয়েছিলেন। চিকিৎসা নিয়েছিলেন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখান থেকে কিভাবে ফের ধ্বংসস্তূপের অন্ধকারে গেলেন? এ প্রশ্নে বিচলিত হয়ে পড়েন রেশমা। কাতরকণ্ঠের জবাবে বলেন, ওই কথা শুনলে কষ্ট হয়। এত কষ্ট ও যন্ত্রণা পেয়েও জীবিত উদ্ধার হয়েছি। তারপরও ওই ধরনের কথা শুনতে হচ্ছে। সাভারের রানা প্লাজা ধসে পড়ার ১৭তম দিন গত ১০ই মে ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে রেশমাকে জীবিত উদ্ধার করেন সেনা ও ফায়ার সার্ভিসের কর্র্মীরা। এরপরই রেশমাকে নিয়ে দেশ ও দেশের বাইরে তোলপাড় শুরু হয়। এর আগে টানা ১৬ দিন ধ্বংসস্তূপে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে বেঁচেছিলেন তিনি। যেখানে হতাহতের সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে কয়েক হাজারে, সেখানে একজন রেশমার প্রাণের স্পন্দন দেশ ছাপিয়ে নাড়া দিয়েছে গোটা বিশ্বে। খেতাব পেয়েছেন ‘মৃত্যুঞ্জয়ী’ ও ‘বিস্ময়কন্যা’র। তার উদ্ধারের পরপরই মা জোবেদা খাতুন, ভাই জাহেদুল ও বোন আসমা ছুটে যান। তারা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বর্ণনা করেন রেশমার অবর্ণনীয় দুঃখের কথা। ২০১০ সালে দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাট থানার কুশিয়ারি গ্রাম থেকে বড় বোন আসমা ও ভগ্নিপতি শহিদুলের হাত ধরে রেশমা ঢাকায় এসেছিলেন। সাভারের পশ্চিম রাজাসন পালোয়ান পাড়ার ১৩৯ নম্বর ইমান আলীর বাড়িতে ওঠেন। মাসিক ৭শ’ টাকা করে একটি রুম ভাড়া নিয়ে থাকতেন গাদাগাদি করে। ওই সময় সবুজ নামে এক যুবকের প্রেমে পড়েন। কয়েক মাস পর তাকেই বিয়ে করে আলাদা হন। রেশমার বয়স তখন ১৫ বছর। একাধারে চাকরি করেন রাজাসনের আইসা নোয়াদ্দা এলাকার সিলটেক্স গার্মেন্টে, দাদা গার্মেন্ট ও সর্বশেষ রানা প্লাজায়। বেতনের সব টাকা স্বামীর হাতে তুলে দিলেও নিস্তার পাননি। কথায় কথায় মারধর করতো তার স্বামী। ওয়েস্টিনে চাকরির খবর শুনে তার বড় বোন আসমা বলেন, আমরা সবাই খুশি। আল্লাহ ওর দিকে তাকিয়েছে। এখন সুখেই থাকতে পারবে। তিনি বলেন, গার্মেন্টে চাকরির সময় রেশমা অভাব- অনটনে থাকতো। মাইলের পর মাইল পথ হেঁটেই চলতো। ওর স্বামী সব টাকা নিয়ে যাওয়ায় মাঝে-মধ্যেই না খেয়ে থাকতো। গত ২৪শে এপ্রিল সাভারে রানা প্লাজার ধসের পর এখন পর্যন্ত ১১৩০ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন আড়াই সহস্রাধিক লোক। অনেকেই পঙ্গু হয়েছেন। চিকিৎসাধীন আছেন আরও শতাধিক মানুষ।
বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৯ টায় সাভার সেনানিবাসের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের আঙ্গিনায় সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে রেশমাকে হোটেল ওয়েস্টিন এর জেনারেল ম্যানেজার আজিম শাহ্ এর কাছে হস্তান্তর করেন সাভার সেনানিবাসের জিওসি চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দী বীরবিক্রম। এ সময় জিওসি সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, গত ২৪শে এপ্রিল রানা প্লাজা ধসে পরার ঘটনায় ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পরে হাজার হাজার শ্রকিক কর্মচারী। এ ঘটনায় সারা জাতি শোকে কাতর হয়ে পড়ে। এ সময় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি’র নেতৃত্বে সেনাবাহিনী, নৌ-বাহিনী, দমকল বাহিনীসহ বিভিন্ন উদ্ধারকারী সংস্থার লোকজন এবং স্থানীয় জনসাধারণের সহযোগিতায় উদ্ধারকাজ শুরু হয়। এর মধ্যে শাহীনা নামের এক শ্রমিককে দীর্ঘ ১৪ ঘণ্টা প্রাণান্তর চেষ্টা চালিয়েও তাকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে ধ্বংসস্তূপ থেকে যখন জীবিত লোককে উদ্ধারের সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে যাওয়ার পর আমার নির্দেশে ভারী যন্ত্রপাতি দিয়ে ধ্বংসস্তূপ সরানোর কাজ শুরু হয়। কিন্তু দীর্ঘ ১৭ দিন উদ্ধারকাজ চালানোর পর গত ১০ই মে অলৌকিকভাবে বেঁচে থাকা বিস্ময় কন্যা রেশমাকে জীবিত উদ্ধারের পর আমরা আনন্দে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়ি। এই খবর শুনার সঙ্গে সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রেশমাকে দেখার জন্য সাভার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ছুটে আসেন এবং রেশমার চিকিৎসার যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন।
এরপর দীর্ঘ ২৭দিন সাভার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে বিশেষজ্ঞ মেডিকেল বোর্ডের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞের বিশেষ তত্ত্বাবধানে সুচিকিৎসার মাধ্যমে ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠে রেশমা।(ডিনিউজ)
খবর বিভাগঃ
বিশেষ খবর
সর্বশেষ সংবাদ
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়