Tuesday, March 26

::কানাইঘাটের যুদ্ধ::

মুক্তিযুদ্ধের সময় অন্যতম স্মরণীয় যুদ্ধ হলো কানাইঘাটের যুদ্ধ। কানাইঘাট সিলেট জেলার একটি থানা। 




কানাইঘাট থানা সদরটি জৈন্তাপুর-জকিগঞ্জ সংযোগ সড়কে সুরমা নদীর তীরে অবস্থিত। জকিগঞ্জ ও আটগ্রাম দখলের পর মুক্তিবাহিনীর কাছে কানাইঘাট দখল করাটা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়ে। উভয় পক্ষের কাছে
ওয়াকার হাসান

কানাইঘাট সামরিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাই পাকিস্তানিরা সিলেট জেলায় এক ব্রিগেড সেনা মোতায়েন করে শক্তিশালী দুর্গে পরিণত করে। আর পাকিস্তান সরকার এ সময় যুদ্ধকে ‘পাক-ভারত’ যুদ্ধে রূপ দিতে চাইল কারণ মুক্তিবাহিনী মিত্রবাহিনীকে সরাসরি সাহায্য সহযোগিতা করে। ১৯৭১ সালের নভেম্বরের মধ্যবর্তী সময়। এ সময় পাকিস্তানি বাহিনীর সবচেয়ে সম্মুখ অবস্থানের ডিফেন্স লাইন ছিল কানাইঘাটে। কেননা ইতিমধ্যে জকিগঞ্জ, আটগ্রাম স্বাধীন হয়ে গিয়েছিল। এখানে ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের আলফা কোম্পানি, পশ্চিম পাকিস্তানি স্কাউটস দলের এক প্লাটুন মিলিশিয়া এবং বেশ কিছুসংখ্যক দেশীয় সহযোগী। কানাইঘাট-দরবস্তের সঙ্গে সংযোগকারী একটি সড়ক ছিল, তাই মুক্তিবাহিনী কিংবা যৌথ বাহিনীর জন্য এই দুটি স্থান দখল করে নেওয়াটা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়ে। কেননা সিলেট পর্যন্ত অগ্রসর হতে হলে এই পথ ধরেই তাদের এগিয়ে আসতে হবে।



যৌথ বাহিনীর পরিকল্পনা ছিল ৫৬ মাউন্টেন ব্রিগেড, ৮১ মাউন্টেন ব্রিগেড এবং মুক্তিবাহিনীর সম্মিলিত শক্তি সিলেট দখল করবে। পরে অক্টোবরের মাঝামাঝিতে মুক্তিবাহিনীর অন্যতম ব্রিগেড জেড ফোর্সও তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। ১৫ নভেম্বর ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সাফল্যের সঙ্গে জকিগঞ্জ দখল করে। এখানে রেজিমেন্টটি পুনরায় সংগঠিত হয়ে কানাইঘাট দখলপূর্বক সিলেট পর্যন্ত অগ্রসর হওয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। ২২ নভেম্বর তারা কানাইঘাট থেকে মাত্র দুই মাইল দূরে অবস্থিত গৌরীপুরে পৌঁছে যায়। ব্যাটালিয়নটি তার আলফা ও ব্র্যাভো কোম্পানিকে সুরমা নদীর উত্তর তীরে ডিপ্লয় করে। চার্লি ও ডেল্টা কোম্পানিকে সুরমা নদীর দক্ষিণ তীরে ডিপ্লয় করা হয়। জেড ফোর্সের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিয়াউর রহমান ৪ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল চিত্তরঞ্জন দত্তকে তাঁর বাহিনী নিয়ে কানাইঘাট শত্রুমুক্ত করার জন্য অনুরোধ করেন যাতে ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নির্বিঘ্নে তার লক্ষ্যস্থলে পৌঁছাতে পারে। সিলেট শহরের ওপর চূড়ান্ত আঘাত হানার ক্ষেত্রে যাতে ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের শক্তি-সামর্থ্য পূর্ণমাত্রায় বজায় থাকে। ৪ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক পূর্ণ আন্তরিকতার সঙ্গে এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন এবং মিশন সফল করার জন্য পূর্ণ মনোযোগ দেন। চিত্তরঞ্জন দত্ত সেক্টরের সবচেয়ে সিনিয়র কোম্পানি কমান্ডার মেজর আবদুর রবকে ৪ কোম্পানি সেনা নিয়ে কানাইঘাট দখল করার আদেশ দেন। এই অপারেশনের জন্য অন্যান্য কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট জহির, সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট গিয়াস এবং সুবেদার আবদুল মতিন চৌধুরী।



কানাইঘাট যুদ্ধের নকশা

যেহেতু কানাইঘাটে পাকিস্তানিদের একটি শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ছিল তাই পরিকল্পনা করা হয় যে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট গিয়াসের নেতৃত্বে একটি কোম্পানিকে দরবস্ত-কানাইঘাট রোডে এবং সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট জহিরের নেতৃত্বে আরেকটি কোম্পানিকে চরখাই-কানাইঘাট রোডে মোতায়েন রাখা হবে। যাতে পাকিস্তানিরা রি-ইনফোর্সমেন্ট করতে না পারে। বাকি দুটো কোম্পানি মেজর আবদুর রবের নেতৃত্বে সুরমা নদী পেরিয়ে কানাইঘাট আক্রমণ করবে।
পাকিস্তানি ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অতর্কিত আক্রমণে ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অগ্রবর্তী কোম্পানি তথা আলফা কোম্পানি অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় পড়ে যায়। আলফা কোম্পানি অধিনায়ক ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমান আক্রমণকারী শত্রুসেনাদের অবস্থান ম্যাপের গ্রিড রেফারেন্স জানিয়ে কামানের গোলা ফেলার অনুরোধ জানাতে থাকেন। তুমুল গোলাগুলি চলছিল। আলফা কোম্পানি কমান্ডার ক্যাপ্টেন মাহবুব দৃঢ়তার সঙ্গে এই আক্রমণ প্রতিহত করে চলছিলেন। কিন্তু একপর্যায়ে পাকিস্তানিদের গোলাতে ক্যাপ্টেন মাহবুব শাহাদাত বরণ করেন। এরপর ক্যাপ্টেন মাহবুবের জায়গায় কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট লিয়াকত আলী খান। গৌরীপুরে একপর্যায়ে তিনিও শত্রুর বুলেটে আহত হয়ে হাসপাতালে নীত হন।



২৬ নভেম্বর পাকিস্তানিরা ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ডেল্টা কোম্পানির ওপর আক্রমণ চালায়। তারা একই সঙ্গে সুরমা নদীর দক্ষিণে অবস্থানরত আলফা ও ব্র্যাভো কোম্পানির ওপরও আর্টিলারি ফায়ার ও শেলিংয়ের মাধ্যমে প্রচণ্ড আক্রমণ শুরু করেছিল। কয়েক মিনিট পরই ডেল্টা কোম্পানির অধিনায়ক বজলুল গনি পাটোয়ারী জানান যে তাঁর সর্বদক্ষিণের প্লাটুনটি পাকিস্তানিদের হাতে বিধ্বস্ত। পাকিস্তানিরা ডেল্টা কোম্পানির ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে এবং কোম্পানির কেন্দ্রীয় প্লাটুনটিকে বিধ্বস্ত করে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যায়।



নাজুক অবস্থা উপলব্ধি করে ডেল্টা কোম্পানির কেন্দ্রীয় প্লাটুনটির কমান্ডার সুবেদার মুসা তাঁর ওয়্যারলেস সেটের মাধ্যমে ঊধ্বর্তন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কিংবা সাবস্টেশনগুলোর সঙ্গে যোগযোগের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যান। মুসার বাঁ পাশে ছিল আমার প্লাটুনটির অবস্থান। মুসা আমার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হন। সুবেদার মুসা যুদ্ধের সার্বিক অবস্থা আমার কাছে তুলে ধরেন। তিনি আরও জানান, তাঁর পক্ষে আর অবস্থান ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। তাঁর এই বক্তব্য শুনে আমি তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করি। আমি সুবেদার মুসাকে পরামর্শ দিই যেভাবেই হোক অবস্থা নিজেদের আয়ত্তে আনার জন্য। আমি মুসাকে আরও নির্দেশ দিই পুকুরের পারের নিচে শেল্টার নিয়ে সেখানেই অবস্থান নিতে। তারপর আমি ঝোড়োগতিতে পাকিস্তানিদের ওপর পাল্টা আঘাত হানার সিদ্ধান্ত নিই। দুটি মেশিনগান গ্রুপ, ছয়টি এলএমজি গ্রুপ নিয়ে মেশিনগানের ফায়ারিং সাপোর্ট নিয়ে আমি শত্রু অবস্থানের দিকে সুকৌশলে অগ্রসর হতে থাকি। আমি প্রায় ৩০ জন সেনা নিয়ে ক্রল করে দ্রুত অগ্রসর হয়ে পাকিস্তানিদের একেবারে নাকের ডগায় ৫০ গজের মধ্যে চলে যাই।



এখানে দুই পক্ষের মধ্যে ভয়াবহ ধরনের একটি যুদ্ধ সংঘটিত হলো। একপর্যায়ে ক্লোজ কোয়ার্টার কম্বাট বা হাতাহাতি যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধ চলে প্রায় এক ঘণ্টার মতো। পাকিস্তানিরা অবস্থা বেগতিক দেখে ফায়ারিং সাপোর্ট অব্যাহত রেখে ক্রমে ক্রমে পিছু হটতে থাকে। অন্যদিকে আমি আক্রমণের গতি আরও বাড়িয়ে দিই। আমার উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করা। পালানোর সময় পাকিস্তানিদের কোম্পানি কমান্ডার মেজর সারওয়ার নিহত হয়। এই যুদ্ধে নৈপুণ্য আর বীরত্ব প্রদর্শনের স্বীকৃতিস্বরূপ স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার পরবর্তী সময়ে আমাকে বীর প্রতীক উপাধিতে ভূষিত করে। যদিও মুক্তিবাহিনীর এই ছোট সাহসী দলটির পাল্টা আক্রমণ সাফল্য অর্জন করেছিল তথাপি বেশ কিছুসংখ্যক পাকিস্তানি সেনা পালিয়ে আত্মরক্ষা করতে সক্ষম হয়। এরা কানাইঘাটে গিয়ে তাদের ডিফেন্সিভ পজিশনে পুনরায় যোগ দেয়।



আমার এই পাল্টা আক্রমণে ৮৮ জন পাকিস্তানিসেনা ও মেজর সরওয়ার নিহত হয় এবং ২৬ জনকে যুদ্ধবন্দী হিসেবে আটক করা হয়। আমরা ও সুবেদার মুসার হতাহতের সংখ্যা ছিল প্রায় ১৭। এই পাল্টা আক্রমণের পরে পাকিস্তানি সেনা বিধ্বস্ত হয়ে আর কোথাও শক্তভাবে অবস্থান নিতে পারেনি। ফলে ৪ নম্বর সেক্টরের ফোর্স প্রায় বিনা বাধায় খুব সহজেই কানাইঘাট দখল করে। এই বিজয় সম্বন্ধে মেজর জিয়া উদ্দিন আহমেদ বীর উত্তম বলেন, এই যুদ্ধটি ছিল একটি কৌশলগত বিজয়।



 মেজর ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক: জেড ফোর্সের অন্যতম কোম্পানি কমান্ডার(দৈনিক প্রথম আলো তারিখ: ২৬-০৩-২০১৩)









শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়