লোভাছড়া হতে পারে আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র
কাওছার আহমদ :
প্রকৃতির রূপকন্যা সিলেটের লোভাছড়া দেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে অসংখ্য ছোট-বড় পাহাড়-টিলা, নদী-নালা, খাল-বিল পরিবেষ্টিত প্রাকৃতিক ও নৈসর্গিক সৌন্দর্যঘেরা এক দর্শনীয় স্থানের নাম। ইহা সিলেটের একটি সম্ভবনাময় পর্যটন স্পট। প্রকৃতি দেবী যেন সারা বিশ্বের সৌন্দর্যরাশি এনে লোভাছড়ায় পুঞ্জিভুত করেছেন। যারা সৌন্দর্য পিয়াসী, সুন্দরের পুজারী তাদের প েলোভাছড়ার আকর্ষণ এড়ানো কিছুতেই সম্ভব নয় । ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সুউচ্চ পাহাড়ের শিখরে লোভাছড়ার জন্ম। চপল পায়ে নুপুর তালে এঁেকবেঁকে বাংলাদেশের কানাইঘাট উপজেলা দিয়ে প্রবেশ করে সুরমা নদীতে মিলিত হয়ে মূলাগুল অঞ্চলকে লোভাছড়া নামে প্রসিদ্ধ করেছে। লোভা ছড়ার চা বাগান, রাস্তার দু'পাশে সারি সারি গাছ, ঘন সবুজ বনানী, প্রাকৃতিক লেক আর স্বচ্ছ হিমেল পানির ঝর্ণা এখানে আসা লোকজনের দৃষ্টি কেড়ে নেয়। এখানকার দর্শনীয় স্থানের মধ্যে মোঘল রাজা-রানীর পুরাকীর্তি, চা বাগান, ঝুলন্ত সেতু, পাথর কোয়ারী, প্রাকৃতিক লেক, মিরাপিং শাহ মাজার, প্রাচীন দীঘি, বাঘ খেওয়ড়, ব-দ্বীপ প্রভৃতি উল্লেখ্যযোগ্য। লোভাছড়ার সীমান্তে মোগল সাম্রাজ্যের রাজা রাণীদের অনেক পুরাকীর্তি রয়েছে। রাজা রাণীর ঘুটি খেলা স্থানটি খুবই আকর্ষণীয়। চোখাটিলা নামক ১টি পাহাড়ের পাদদেশে ১টি ঝর্ণার পাশে রয়েছে প্রাচীনকালের দু'টি বড় পাথর। এ পাথর দু'টিতে বসে রাজা-রাণী ঘুটি খেলতেন। এছাড়া পাথরে বসে রাজা-রাণী লোভাছড়ার সৌন্দর্য ও অবলোকন করতেন। দেশের দীর্ঘতম নদী সুরমার ডান তীরে এবং লোভাছড়ার উত্তর তীর ঘেঁষে ১৮০২একর জায়গা জুড়ে সুবিসতৃত লোভাছড়া চাবাগান। রোজ সকালে হাজারো শ্রমিকের পদচারনায় মুখরীত হয়ে ওঠে চাবাগানটি। এ বাগান থেকে প্রতি বছর প্রায় ৪ লাধিক কেজি চা উৎপাদিত হয়। সুবিশাল এ চা বাগানে শত শত শ্রমিক আপন মনে কচি চা-পাতা তুলে এবং আপন সুরে গান গেয়ে পর্যটকদের আকর্ষন করে। সড়ক পথে লোভা ছড়ায় আসার পথে পাওয়া যায় বৃটিশ আমলের নির্মিত চা-বাগানের ভিতরেই নুন নদীর উপর ১টি ঝুলন্ত সেতু। ১৯২৫সালে ইংরেজরা লোভা ছড়ায় যাতায়াতের জন্য সেতুটি নির্মাণ করে। সেতুর উপর দাঁড়িয়ে লোভা ছড়ার অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। সুরমা নদীর উত্তর প্রান্তে লোভাছড়া জুড়ে রয়েছে সুবিশাল পাথরের খনি। চারদিকে শুধু পাথর আর পাথর। নদী থেকে পাথর তোলার দৃশ্য ও মনোমুগ্ধকর। এখান থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার শ্রমিক পাথর উত্তোলন করে। এখান থেকে আহরিত পাথর সারা দেশে সরবরাহ করা হয়। এখানকার কোয়ারিতে আসার পথে আকর্ষণীয় অনেক দৃশ্য উপভোগ করা যায়। নৌকায় আ রোহন করার পর পাহাড়, বাগান আর সবুজ বনানী নৌকা আরোহীর দৃষ্টি মন কেড়ে নেয়। নৌকায় বসে স্বচ্ছ পানির নীচ দিয়ে নদীর তলদেশ পর্যন্ত দেখা যায়। লোভাছড়ায় আসার পথে পাওয়া যায় অসংখ্য টিলা। রাস্তার দু'পাশ ও টিলায় রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতীর গাছ-গাছালী। এখানকার অরণ্যের মাঝখান দিয়ে হাঠতে খুবই ভাল লাগে। স্থানীয় বন বিভাগ ১টি সামাজিক বন প্রতিষ্ঠা করেছেন। এ বনটিকে কেন্দ্র করে এখানে ১টি পার্ক তৈরী করা হলে এটি ঢাকার বোটানিক্যাল গার্ডেনের মতো দর্শনীয় স্থানে পরিনত হবে। এখানকার পাহাড়ের মধ্যবতর্ী ঢালু উপত্যকায় রয়েছে অনেকগুলো প্রাকৃতিক লেক। পরিচর্যা করলে এ লেকগুলো চট্টগ্রামের ফয়স লেকের সৌন্দর্যকেও হার মানাত। আয়তনের দিক দিয়ে ছোট হলেও লেকগুলো স্বচ্ছ পানি দেখে মন জুড়ে যায়। এখানকার ঝর্ণার পানির ছল ছল শব্দ শুনে পর্যটকদের মনে আনন্দ জাগে। লোভাছড়ার দণি পাশ্বর্ে মূলাগুল নয়াবাজারের পূর্ব পাশ্বর্ে অবস্থিত ১টি টিলার উপর রয়েছে হযরত শাহ জালাল (রহ:) এর সঙ্গী ৩৬০আউলিয়ার মধ্যে অন্যতম ওলি হযরত মিরাপিং শাহ (রহঃ) এর মাজার। মাজারটি দেখার জন্য এখানে প্রতিদিন ওলি সাহেবের অনেক ভক্ত এসে ভীড় জমান। মাজারটিকে যথাযথভাবে সংরণ ও তত্বাবধান করা হলে হযরত শাহজালাল ও শাহ পরানের মাজারের মতো এখানকার মাজারেও প্রচুর ভক্তকুলের আগমণ ঘটবে প্রতিনিয়ত। লোভাছড়া কুলি বস্তির পাশে রয়েছে ১টি সুবিশাল দীঘি। এককালে দীঘিতে অনেক অলৌকিক জিনিসপত্র যেমন তালা-বাসন, রোপ্য মুদ্রা ইত্যাদি ভেসে উঠতে বলে লোক মুখে বিভিন্ন মুখরোচক কাহিনী প্রচার হয়ে আসছে। এখানকার অরণ্যে বাঘসহ বিভিন্ন প্রজাতীর জীবজন্তু বাস করে। কখনো লোকালয়ে বাঘ চলে আসে। তখন এলাকার লোকজন খেওয়ড় বা কর্ডন দিয়ে বাঘ আটক করেন। আটক হওয়ার বাঘ দেখতে হাজার হাজার লোক দূর দূরান্ত থেকে এসে এখানে সমবেত হয়। এ উপল েস্থানীয় লোকজন এখানে মেলার আয়োজন করে থাকে। লোভাছড়ার পাশেই রয়েছে সুরমা, লোভা ও বরাক নদীর মিলনস্থল। তিনটি নদীর মিলন এখানে ব-দ্বীপের সৃষ্টি করেছে। নসদীগুলোর মিলনস্থলে নদীর এক পাশের পানি খুবই স্বচ্ছ এবং অপর পাশের পানি খুবই ঘোলা। একই নদীতে দু'ধরণের পানি দেখে অনেকেই পুলকিত হন। সিলেট মহানগরী থেকে কানাইঘাট উপজেলার দূরত্ব ৫০কিঃমিঃ। কানাইঘাট উপজেলা সদর থেকে লোভাছড়ার দূরত্ব মাত্র ৮কিঃমিঃ। উপজেলা সদর থেকে সড়ক ও নদী পথে লোভাছড়ায় যাওয়া যায়। লোভাছড়া যাতায়াতের রাস্তাটি অর্ধেকের বেশী কাচা হওয়ায় খুবই কষ্ট করে সেখানে পৌঁছতে হয়। নদী পথে যাতায়াতের জন্য এখানে কোন ট্রলার নেই। তাই ছোট বারকি ও ইঞ্জিন নৌকায় চড়ে যেতে হয়। লোভাছড়া এক অফুরন্ত সম্ভাবনার দুয়ার। এখানে রয়েছে অপার সম্ভাবনার হাতছানি। এখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করার পাশাপাশি দর্শনীয় স্থান সমূহের যথাযথ তত্বাবধান করা হলে এটিকে দেশের এক আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্রে রূপান্তর করা সম্ভব। এখানকার সামাজিক বনায়ন ও চা-বাগান থেকে প্রচুর দেশী মুদ্রা আহরণের পাশাপাশি প্রাকৃতিক লেক ও অন্যান্য স্থানগুলোকে বিদেশি প্রর্যটকদের দৃষ্টিতে নিতে পারলে এর মাধ্যমে প্রচুর বিদেশি মুদ্রাজর্ন করা যেতে পারে। স্থানীয় লোকজন দীর্ঘদিন থেকে এখানে ১টি স্থলবন্দর স্থাপনের দাবী জানিয়ে আসছেন। গত সরকারের আমলে জাতীয় সংসদে এটির প্রস্তাব করা হলেও এখন পর্যন্ত তা কার্যকর হয়নি। শীঘ্রই এটি বাস্তবায়িত হোক এ দাবী এলাকাবাসীর তথা সমগ্র উপজেলার সর্বস্তরের জনসাধারণের। পরিশেষে বলা যায় যে, লোভাছড়ার পযর্টন আকর্ষনগুলোর উপর ভিত্তি করে এখানে ইকো পর্যটন, কৃষিভিত্তিক পর্যটন, গ্রামীণ পর্যটন, ক্রীড়া পর্যটন, নৌ পর্যটন, ধর্ম ভিত্তিক পর্যটন, ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্তি্বক পর্যটনসহ পর্যটনের অন্যান্য দিকগুলো উন্নয়ন সম্ভব। এখানকার পর্যটনশিল্পের উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করে তা বাস্তবায়নে কৌশলী ও সময়োচিত পদপে গ্রহণ করা। পর্যটনশিল্পের বিকাশের মাধ্যমে ব্যাপক কর্মসংস্থানসহ বহুমাত্রিক সাফল্য বর্তমান সরকারের দিনবদলের অঙ্গীকার, ঘরে ঘরে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি তথা স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়ে তোলার এজেন্ডা বাস্তবায়নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়