Tuesday, May 28

যেসব আলামতে বুঝা যাবে শবে কদর

শহীদুল ইসলাম  ::

শবে কদর অর্থ: শবে কদর বরকতময় এক রজনী। শব হচ্ছে ফারসী শব্দ যার অর্থ রাত্রি, রজনী। আর কদরের দুটি অর্থ হয়। (এক) কদর মানে নির্ধারণ। যেহেতু এই রাতে বান্দার রিজিক ও হায়াত নির্ধারণ করা হয় তাই একে শবে কদর বলা হয়। এই নির্ধারণ অবশ্য তাকদিরের নির্ধারণ নয়। বরং তাকদিরে যা লেখা আছে, তার আগামী এক বছরেরটা এই রাতে ফেরেশতাদেরকে বুঝিয়ে দেয়া হয়। (দুই) কদর মানে মর্যাদাশীল। যেহেতু এই রজনী স্বাভাবিক রাতের তুলনায় বেশি সম্মানিত তাই একে শবে কদর বলা হয়। (দরসে তিরমিজী, খন্ড-২, পৃষ্ঠা-৬৩৩) 

কোনো কোনো আলেম বলেন, গোনাহ ও অবাধ্যতার কারণে যাদের কোনো সম্মানই ছিলো না, এই রাতে ইবাদত, তওবা, ইস্তেগফার ও জিকির আজকার দ্বারা সে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ্য থেকে বিশেষ সম্মান লাভ করে তাই একে শবে কদর বা ‘সম্মান লাভের রাত্রি’ বলা হয়।
শবে কদরের ফজিলত: শবে কদর একমাত্র উম্মতে মুহাম্মাদী (সা.) এর বৈশিষ্ট্য। অন্য কোনো উম্মতকে এই মর্যাদা দেয়া হয়নি। তাফসিরে ইবনে কাসিরে বলা হয়েছে, একদিন নবী করীম (সা.) সাহাবায়ে কেরামের সামনে বনী ইসরাইলের কতক বুযূর্গ লোকের নেক আমলের কথা আলোচনা করেন। যারা দীর্ঘ হায়াত লাভ করেছিলো। এবং নিজেদের জীবনকে ব্যয় করেছিলো আল্লাহর ইবাদতে। সাহাবায়ে কেরাম এটা শুনে নিজেদের হায়াত কম হওয়ার ওপর আফসোস করেন। বলতে লাগলেন, আমাদের হায়াত যদি ওই রকম দীর্ঘ হতো তাহলে আমরাও বেশি বেশি ইবাদত করে, আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি লাভ করে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে পারতাম। এই পরিপেক্ষিতে আল্লাহ তায়ালা সূরা কদর নাজিল করেন। যেখানে মুমিনদেরকে সুসংবাদ দেয়া হয়েছে যে, এই উম্মতকে একটি রাত দেয়া হয়েছে, ওই এক রাতের ইবাদত হাজার মাস ইবাদতের চেয়ে উত্তম।
তাছাড়া বহু হাদিসে শবে কদরের ফজিলতের কথা আলোচনা হয়েছে। নিম্নে কয়েকটি হাদিস পেশ করা হলো-
(এক) হজরত আবু হুরাইরা (রা.) এর সূত্রে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি শবে কদরে ঈমানের সহিত, সওয়াব লাভের আশায় দাঁড়ায় তার অতিতের যাবতীয় গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়। (সহীহ বোখারী ও মুসলিম) দাঁড়ানোর অর্থ হচ্ছে নামাজে দাঁড়ানো। তেলাওয়াত, তওবা, ইস্তেগফার ও জিকির আজকারে মশগুল থাকাও দাঁড়ানোর মধ্যে শামিল। সওয়াবের আশায় বলে বুঝানো হয়েছে, মানুষকে দেখানোর উদ্দেশ্যে নয়। বরং এখলাসের সহিত আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য দাঁড়ায়।
(দুই) হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, একবার রমজান আসলে, নবী করীম (সা.) বলেন, তোমাদের নিকট একটি মাস এসেছে। ওই মাসে একটি রজনি আছে, যা হাজার মাস থেক উত্তম। যে ওই রাতের ইবাদত থেকে বিরত থেকে গেলো সে সমস্ত ভালো ও কল্যাণ থেকে বিরত থেকে গেলো। আর ওই রাতের ইবাদত থেকে কেবল ওই লোকই বিরত, যে নাকি প্রকৃত অর্থেই সবকিছু থেকে বিরত। (ইবনে মাজাহ) এত বড় সুযোগ পেয়েও যে কাজে লাগাতে পারে না, সে সকল ধরনের কল্যাণ থেকে বিরত থাকাটাই স্বাভাবিক। কারণ, একদিন কাজ করে যদি আশি মাসের বেতন পাওয়ার সুযোগ থাকে তাহলে এই সুযোগকে কেবল ওই লোকই হাতছাড়া করবে যে নাকি চরম গাফেল।
কদরের রাত্রির কিছু বৈশিষ্ট্য: উবাদা ইবনে সামেত (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী করীম (সা.)-কে শবে কদর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি উত্তর দেন যে, উহা রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাত্রে অর্থাৎ ২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৯ তারিখে বা রমজানের শেষ রাতে হয়। যে ব্যক্তি শবে কদরে ঈমানের সহিত, সওয়াব লাভের আশায় দাঁড়ায় তার অতিতের যাবতীয় গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়। তারপর রাসূল (সা.) এই রাতের কিছু আলামতের বর্ণনা দেন। আলামত সমূহের কিছু হলো, ওই রাতটা নির্মল ঝলমলে হবে, নিঝুম নিথর-না অধিক গরম, না অধিক ঠাণ্ডা বরং সবকিছু মাঝামাঝি পর্যায়ে থাকবে। (নূরের আধিক্যের কারণে) ওই রাতের আকাশ, চাঁদনী রাতের মতো মনে হবে। ওই রাতে সকাল পর্যন্ত শয়তানের প্রতি উল্কা নিক্ষেপ করা হয় না। উহার আরো একটি আলামত হচ্ছে পরদিন সকালে সূর্য কিরণবিহীন একেবারে গোলাকার পূর্ণিমার চাঁদের ন্যায় উদিত হয়। আল্লাহ পাক সেই দিনের সূর্যোদয়ের সময় উহার সহিত শয়তানের  আত্মপ্রকাশকে বন্ধ করে দিয়েছেন। (দূররে মানসূর: আহমদ ও বায়হাকি)
ওই রাতের সকালে সূর্য কিরণবিহীন উদিত হওয়ার কথা আরো বহু বর্ণনায় এসেছে। কোনো কোনো বুযূর্গ বর্ণনা বলেছেন, ওই দিন সকালে সমুদ্রের পানি লবনাক্ত হয় না। তবে এটা জরুরি কোনো কিছু না। আবার সবার কাছে এই আলামত প্রকাশ পাবে এমনও নয়। শাইখুল হাদিস জাকারিয়া (রাহ.) মাশায়েখগণের কথা বর্ণনা করেছেন যে, ওই রজনীতে প্রতিটি বস্তু সেজদা করে।
শবে কদরের তারিখ নিয়ে উলামায়ে কেরামের মাঝে মতভেদ: শবে কদর কোন রাতে হতে পারে এবং শবে কদর একটি নাকি দুটি এ ব্যাপারে ব্যাপক আলোচনা রয়েছে। কারো কারো মতে শবে কদর দুটি। এক শবে কদর হচ্ছে রমজানের শেষ দশকে। আরেকটা হচ্ছে বছরের যে কোনো সময় হতে পারে। এটা ওই শবে কদর যাতে আল কোরআন লাওহে মাহফূজ থেকে দুনিয়ার আসমানে নাজিল হয়। হজরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবি (রাহ.) এই মত পোষণ করতেন। হজরত শাইখুল হাদিস জাকারিয়া (রাহ.) এর পিতাও উক্ত মতটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন।
যারা বলেন, শবে কদর একটি; তাদের থেকে তারিখের ব্যাপারে পঞ্চাশের অধিক মত পাওয়া যায়। প্রথম কথা হচ্ছে শবে কদর রমজানেই সীমাবদ্ধ কী-না। শায়খে আকবর মুহীউদ্দীন ইবনে আরাবী বলেন, আমার কাছে ওই সকল লোকদের কথাই সঠিক মনে হয় যারা বলেন, শবে কদর সারা বছরই ঘুরে ঘুরে আসে। কেননা, আমি শাবান মাসে শবে কদর দু,বার পেয়েছি। (ফাযায়েলে আমল-৯৪৯) এর দ্বারা বুঝা যায়, শবে কদর রমজানে সীবাবদ্ধ নয়। অধিকাংশ আলেমগণের মত হচ্ছে শবে কদর রমজানেই সীমাবদ্ধ। এর মধ্যে শেষ দশকের বেজোড় রাত বিশেষভাবে সাতাইশ তারিখের কথা এসেছে। এখানে মূল বিষয় হচ্ছে, প্রত্যেকে নিজের হিম্মত অনুযায়ী শবে কদর তালাশ করবে। কারো হিম্মত হলে সারা বছর তালাশ করবে। তার চেয়ে যারা দুবর্ল তারা শুধু রমজানে তালাশ করবে। আরো দুর্বল যারা তারা রমজানের শেষ দশকে। একেবারে শেষ পর্যায়ের লোকদের দায়িত্ব হচ্ছে, সাতাশ তারিখে শবে কদর তালাশ করা। এর থেকেও যারা বিরত থাকবে তারা তো হতভাগা হবেই।
শবে কদরের দোয়া: হজরত আয়শা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করি, যদি আমি জানতে পারি যে, আজ রাতেই শবে কদর তাহলে আমি কোন দোয়টা পড়বো? রাসূল (সা.) বলেন, এই দোয়াটা পড়বে ‘আল্লাহুমা ইন্নাকা আফুব্বুন তুহিব্বুল আফওয়া ফা’ফু আন্নী’
অর্থ :‘হে আল্লাহ আপনি বড় ক্ষমাশীল, ক্ষমাকে ভালোবাসেন। অতএব, আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন।’ খুবই ব্যাপক অর্থবোধক দোয়া। পুরো রমজানেই এই দোয়া পড়া চাই।
ঝগড়ার কারণে শবে কদরের তারিখ ভুলিয়ে দেয়া: হজরত উবাদা ইবনে সামেত (রা.) বলেন, একবার নবী করীম (সা.) আমাদেরকে শবে কদরের  নির্দিষ্ট তারিখ জানানোর জন্য বাহির হলেন। তখন দুজন মুসলমানের মধ্যে ঝগড়া হচ্ছিল। হুজুর (সা.) বলেন, আমি তোমাদেরকে শবে কদরের নির্দিষ্ট তারিখ জানানোর উদ্দেশ্যে বের হয়েছিলাম। কিন্তু ওমুক দুই লোকের মাঝে ঝগড়া হচ্ছিলো। তাই তা ওঠিয়ে নেয়া হয়েছে। হয়তো তা ওঠিয়ে নেয়ার মধ্যেও কোনো কল্যাণ রয়েছে। অতএব তোমরা নবম, সপ্তম ও পঞ্চম রাত্রিগুলোতে তা তালাশ করো। (সহীহ বোখারী)
উক্ত হাদিসে তিনটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ: (এক) মুসলমানদের পরস্পর ঝগড়া-বিবাদ কত বড় অনিষ্টকর তা বুঝা যায় এই হাদিস থেকে। কারণ, শবে কদরের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের তারিখ এই ঝগড়া-ফেসাদের কারণে ওঠিয়ে নেয়া হয়েছে। শুধু এখানেই নয়, বরং ঝগড়া-বিবাদ সর্বদা বরকত ও কল্যাণ থেকে মানুষকে বিরত করে। এ জন্য কোনো কোনো হাদিসে ঝগড়াকে বলা হয়েছে মুণ্ডনকারী। তখন সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করেছেন। কোন জিনিসকে মুণ্ডায়। উত্তরে বলা হয়েছে, দ্বীনকে মুণ্ডাইয়া দেয়। অর্থাৎ ক্ষুর যেমন মাথার চুল সম্পূর্ণ কেটে ফেলে তেমনি ঝগড়া-বিবাদও দ্বীনকে বিনাশ করে দেয়। এ জন্য ঝগড়া মিটানোকে অনেক ফজিলতের বিষয় বলা হয়েছে। এক হাদিসে বলা হয়েছে, রাসূল (সা.) বলেন, আমি কী তোমাদেরকে নামাজ, রোজা ও সদকা থেকে উত্তম বিষয়ের কথা বলবো না? সাহাবায়ে কেরাম আরজ করিলেন, অবশ্যই বলে দেন। রাসূল (সা.) বলেন, পরস্পর সদ্ব্যবহার সবচেয়ে উত্তম বস্তু। দ্বিতীয় বিষয় হলো, কারো সঙ্গে অমিল বা ঝগড়া তখনই খারাপ বিষয় বলে বিবেচ্য হবে যখন তা জাগতিক বিষয়কে কেন্দ্র করে হবে। আর যদি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হয় তাহলে তা খারাপ হবে না। প্রকৃত পক্ষ্যে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যা হয় তা হক ও ন্যায়ের পক্ষ্যেই হয়। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হবে আবার অন্যায়ের পক্ষ্যে যাবে তা কখনো হতে পারে না। তৃতীয় বিষয় হলো, শবে কদরের তারিখ ভুলিয়ে দেয়ার মধ্যেও কল্যাণ নিহিত আছে। যেমন যদি শবে কদর নির্দিষ্ট থাকতো তাহলে দুর্বল বান্দারা সারা বছর ইবাদত না করে এই এক রাতের আশায় বসে থাকতো। এতে সারা বছর ইবাদতের সওয়াব থেকে বিরত হতো। যারা খারাপ প্রকৃতির তারা যখন শবে কদর জেনেও খারাপ কাজ করতো এতে তাদের ওপর আল্লাহর পাকড়াও আরো কঠোর হতো।
মোটকথা শবে কদর আল্লাহর পক্ষ্য থেকে উম্মতে মুহাম্মাদিকে দেয়া বিশেষ সুযোগ। যা অন্য কোনো উম্মতকে দেয়া হয়নি। এ জন্য রমজানের শেষ দশকে নিজেদের আরাম আয়েশ পরিহার করে নামাজ, তেলাওয়াত, জিকির আজকার ও তাসবিহ তাহলিলে মশগুল থেকে আল্লাহর দেয়া নেয়ামতকে কদর করবো।

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়