Friday, May 31

তারাবির হাদিয়া ও সম্মানি

মুফতি মো. আবদুল্লাহ::
নামাজ, রোজা, তারাবি ও তাতে কোরআন খতমÑ এসবই ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। আর সব ইবাদতই একমাত্র মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পরকালীন মুক্তি লাভের উদ্দেশ্যে সম্পাদনের নির্দেশ রয়েছে। জাগতিক লাভ/বিনিময়/হাদিয়া প্রাপ্তির নিয়ত বা প্রত্যাশা তাতে বৈধ নয়। কিন্তু নিয়ত একটা অদৃশ্য ও মনোজগতের ব্যাপার। আর শরিয়তের মাসআলা বা বিধান প্রযোজ্য হয়ে থাকে দৃশ্য ও স্বীকারোক্তিকেন্দ্রিক কথাবার্তার নিরিখে। অন্তরে বা মনে কী আছে, তা ধারণা করে বা মনে মনে যোগ-বিয়োগ করে একজন মুফতি ফতোয়া কিংবা একজন বিচারক রায় দিতে পারেন না। সুতরাং যেখানে তারাবির হাফেজের পক্ষ থেকে বা কমিটির লোকজন কেউ তারাবিতে নিয়োগকালীন বা খতম শেষকালীন ‘তারাবি’ তথা ইবাদতের বিনিময় দিচ্ছেন বা নিচ্ছেন তেমন কিছু না বলার পরও, ওই হাদিয়া বা সম্মানিকে ‘ইবাদতের বিনিময়’ বা ‘মজুরি’ দিচ্ছেন বা নিচ্ছেন মর্মে ফতোয়া দেন এবং ‘নাজায়েজ’ বলেন, তা স্রেফ বাড়াবাড়ির নামান্তর।
‘হাদিয়া’ বা ‘সম্মানি’ বাবত কিংবা এই নামে হাফেজদের দেওয়ার ক্ষেত্রেও কোনো কোনো আলেম অবৈধতার পক্ষে যুক্তি দেখান, সারা বছর হাদিয়া দেন না কেন? তারাবি পড়িয়েছেন বিধায় কেন দিচ্ছেন? অথচ এমন প্রশ্ন তো অন্য বক্তা, পীর, ওস্তাদ শ্রেণির সব আলেমের ক্ষেত্রেও হতে পারে, যারা বিভিন্ন ধর্মীয় কাজে জড়িত এবং হাদিয়াদাতাদের সাক্ষাতে এসেছেন বা আনা হয়েছে বিধায় বা একটু ওয়াজ শুনিয়ে বা কোরআন শুনিয়ে বা মাসআলা-বিধান শিক্ষা দিয়ে বা আধ্যাত্মিক দীক্ষা দিতে এসেছেন বা আনা হয়েছে; তাই তখন দেওয়া হচ্ছে। সারা বছর বা অন্য সময় আসেন না বিধায় তখন দেওয়া হয় না বা দেওয়ার কথা মনে জাগে না। এসব তো একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। কূটতর্ক বা নেতিবাচক মনোভাব থাকলে এমন আরও অনেক কথাই বলা যায়; অনেক প্রশ্নই উত্থাপন করা যায়। কিন্তু তাতে সংশ্লিষ্ট বিষয়টির সহজ সমাধান বেরিয়ে আসে না এবং মসজিদ কমিটি ও মুসল্লিদের সংশয়, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থেকে বাঁচানো যায় না।
নিজেদের কল্যাণে ধর্মীয় কাজ বা ইবাদত করা হবে এটাই ধর্মের নির্দেশনা। তাতে ১০ জনের যৌথ একটি ইবাদতের (জামাতের) সুবিধার্থে অন্য ২-১ জন হাফেজকে শুধু জড়িতই নয় বরং নিয়মিত থাকতে এবং ২৫-২৭ দিন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট সময়দানে বাধ্য করার প্রয়োজন দেখা দেয়। অথচ সংশ্লিষ্ট সহযোগিতাকারী হাফেজদের ব্যক্তিগতভাবে ওই ইবাদতটি পালনে তেমন বাধ্য-বাধকতায় আটকা পড়ার প্রয়োজন ছিল না। ওই ‘সময়দান’ ও ‘আটকে পড়ার’ বিবেচনায় ইমাম-মুয়াজ্জিন প্রমুখের বেতন-ভাতার বৈধতা বের করা হয়। তবে পার্থক্য বের করা হয় এই মর্মে যে, তারা ফরজ ইবাদতে সাহায্য করেন আর এই হাফেজরা সুন্নাত কাজে। যদিও ফরজ ও নফলের মধ্যে তেমন পার্থক্য এক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য নয়। যেমনÑ ‘আর ফরজ ও নফল সালাত এ ক্ষেত্রে সমান। আপনি কি জানেন না যে, যদি কোনো এক ব্যক্তি অপর একজনকে ফরজ বা নফল নামাজ পড়ানোর জন্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে নিয়োগ করেÑ তাতে তেমন পারিশ্রমিক ধার্য জায়েজ নয়। একইভাবে আজানের ক্ষেত্রেও।’ (নষ্ট ইজারা অধ্যায় : ৪/১৬; কিতাবুল-আসল : ইমাম মুহাম্মদ ইবনুল হাসান শায়বানি)।
অর্থাৎ ‘পারিশ্রমিক’ বা ‘সম্মানি’ বৈধ হলে উভয়টিতে হবে; আর অবৈধ হলেও উভয়টিতেই হবে। সুতরাং ইমাম প্রমুখ ফরজ কাজে সহযোগিতা করেন বিধায় ‘পারিশ্রমিক’ বা ‘বেতন’ নামেও বিনিময় গ্রহণ করতে পারেন (যা সব ফতোয়া গ্রন্থেই বিদ্যমান)। আর এরা হাদিয়া হিসেবেও নিতে পারবেন নাÑ এমন ফয়সালা বিতর্ককেন্দ্রিক হতে পারে; সহজ-সরল দ্বীন ধর্মকেন্দ্রিক হতে পারে না।
শরিয়তের বিধি-বিধান তথা ইবাদত-উপাসনার দুটি দিক লক্ষণীয়। একটি হচ্ছে, ‘ফাজাইল’ বা উৎসাহ-উদ্দীপনাকেন্দ্রিক; আরেকটি হচ্ছে তৎসংশ্লিষ্ট বিধি-বিধানকেন্দ্রিক। ‘ফাজাইল’ প্রশ্নে অনেক ক্ষেত্রে নফল/মুস্তাহাব বিষয়েও অনেক বেশি উৎসাহব্যঞ্জক বা অনেক কঠোর বাণী-বর্ণনা থাকে। কিন্তু ফাজাইল সংশ্লিষ্ট হাদিস-দলিল দ্বারা বিধান নির্ধারিত হয় না; বিধান সংশ্লিষ্ট হাদিস-দলিল ভিন্ন হয়ে থাকে। সে কারণে জায়েজ-নাজায়েজ বলা বা ফতোয়াদানের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিধানটি সম্পর্কিত হাদিস-দলিলে কী বলা হয়েছে, সেটিই মূল বিবেচ্য।
‘হারাম’/‘নাজায়েজ’কে যে আঙ্গিকে উপস্থাপন বা পেশ করা হবে : ‘মাকরুহ’ (‘অপছন্দনীয়’ তবে ‘নিষিদ্ধ নয়’)-কে সেভাবে উপস্থাপন করা যাবে না। আবার যা কিছু (মুস্তাহাব/নফল) শুধু ‘উত্তম’/অধিক উত্তম; কিন্তু ‘নাজায়েজ’ও নয়, ‘মাকরুহ’ও নয়; তেমন বিষয়াদিকে নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে আদৌ পেশ করা যাবে না। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এমনকি শহরে-বন্দরেও এক শ্রেণির আলেম/ইমাম/বক্তা আছেন যাদের নিজেদের প্রথমত ওই বিধানগত পার্থক্য-জ্ঞান নেই। দ্বিতীয়ত আবার কিছু এমন আছেন যারা জুনিয়র হওয়ায় নতুন নতুন কিছু মাসআলা শিখেই জ্ঞানগত ধৈর্য-সংযম না থাকায় সংশ্লিষ্ট বিষয়টির সবদিক না বুঝে, সার্বিক বিবেচনা না করেই, ওয়াজের মাঝখানে ভারসাম্যহীন ভঙ্গিতে তেমন কোনো মাসআলা বলে ফেতনা বা দ্বন্দ্বের সূত্রপাত করে বসেন; যা ঠিক নয়।
ইমাম মুহাম্মদ (রহ.) এর ‘কিতাবুল আসল’ তথা ‘আল-মাবসুত’ (১/১২০) গ্রন্থেও বলা হয়েছে, ‘হাদিয়া বা সম্মানি হিসেবে দেওয়া যাবে এবং সেটাই উত্তম।’ যেমনÑ ‘আমি বললাম, আপনি কি ইমাম ও মুয়াজ্জিনের জন্য নির্দিষ্ট পারিশ্রমিকের বিনিময়ে আজান দেওয়া ও ইমামতি করা মাকরুহ মনে করেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ, আমি তাদের জন্য তেমনটি মাকরুহ মনে করি; এবং মুসল্লিদের জন্যও তাদের তা পারিশ্রমিক হিসেবে প্রদান করা সমীচীন নয়। আমি বললাম, যদি তিনি নির্দিষ্ট পারিশ্রমিক গ্রহণ করে আজান দেন ও ইমামতি করেন? তিনি বললেন, তাদের জন্য (নামাজ-জামাত) জায়েজ হয়ে যাবে। আমি বললাম, যদি তিনি নির্দিষ্ট কিছুর শর্ত না করেন; তবে তারা তার প্রয়োজন বুঝতে পেরে তার জন্য বার্ষিক (বা মাসিকÑ একই সূত্রে হাফেজদের) কিছু সংগ্রহ করে তা তাকে প্রদান করেন; সে ক্ষেত্রে আপনার অভিমত কি? তিনি বললেন, এটাই উত্তম।’
‘উসুল’ বা ‘কায়দা’ দ্বারা ‘জুযঈ মাসআলা’ প্রশ্নে বৈধতা-অবৈধতা নির্ধারিত হয় না। ‘উসুল’ বা ‘কায়দা’ বিধান গবেষণার প্রয়োজনে স্থিরীকৃত। তবে হ্যাঁ তা দ্বারা বিধান বুঝতে সহায়ক হয়। সে কারণেÑ
‘যা পরিচিত বা প্রচলিত তাই যেন শর্তকৃত’ শুধু এই নীতিবাক্য দ্বারা হাফেজদের জন্য প্রদত্ত হাদিয়াকে অবৈধ বলা যাবে না। তার কারণ :
(১)  গবেষণা মতে বৈধতাদানের মূল উৎস বা প্রসঙ্গ শ্রম/মজুরি নয়।
(২) তেমনটি ক্ষণিকের জন্য ধরে নিলেও, তাতে পারিশ্রমিকের ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয়াদি তথা পূর্বচুক্তি, মজুরি নির্ধারণ ইত্যাদি বাস্তবে থাকে না বিধায় হাফেজদের সম্মানি ‘ইবাদতে মজুরি’ এর আওতায় গণ্য হয় না।
(৩) হাফেজদের যা দেয়া হয় তা সাধারণত ‘সম্মানি’ এর আওতায়ই পরিগণিত হয়ে থাকে।
(৪) ‘হাদিয়া’ এর  বৈধতার পক্ষে মৌলিক নস (দলিল) বিদ্যমান। হাদিয়াদানের উপলক্ষ যা-ই হোক না কেন। কেননা, এ ক্ষেত্রে তো আর দাতাদের জাগতিক কোনো স্বার্থ কাজ করছে না। আর গ্রহীতাদের অন্তরে কী আছে? তা তো আর কেয়ামতের দিন দাতাদের জিজ্ঞাসা করা হবে না। কারণÑ ‘তারা যা অর্জন করেছে তা তাদের, তোমরা যা অর্জন করেছ তা তোমাদের। আর তারা যা করত সে সম্মন্ধে তোমাদের প্রশ্ন করা হবে না।’ (সূরা বাকারা : ১৩৪ ও ১৪১)। 
সার-সংক্ষেপে বলা যায় :
(১) বেতন-পারিশ্রমিক ও হাদিয়া-সম্মানি এক বিষয় নয়।
(২) বেতন-পারিশ্রমিক আইনকেন্দ্রিক হয়ে থাকে আর হাদিয়া-সম্মানি বিবেককেন্দ্রিক হয়ে থাকে।
(৩) মাহে রমজানে হাফেজদের আর্থিক সহযোগিতা ‘ভাতা’ ও ‘সম্মানি’ বিবেচনায় প্রদান করা অধিক উত্তম এবং অনেক সওয়াবের কাজ। বেতন-পারিশ্রমিক বিবেচনায় প্রদান (কোনো কোনো ফকিহর মতানুযায়ী) যদিও বৈধ; তবে তা অধিক উত্তম নয়।
(৪) হাদিয়া বিবেচনার ক্ষেত্রে চাপাচাপি করে অর্থ উসুল সঠিক নয়; পারিশ্রমিক বিবেচনার ক্ষেত্রে জোর দিয়েও উসুল করা যায়।
(৫) আর্থিক সঙ্গতি থাকা সাপেক্ষে মসজিদের সাধারণ তহবিল থেকেও ‘সম্মানি’ প্রদান করা যায়; নতুবা চাঁদা আদায়ের মাধ্যমেও প্রদান করা যায়।
(৬) মসজিদটি রাষ্ট্রীয় কোনো প্রতিষ্ঠানের আওতাধীন হলে কিংবা সংশ্লিষ্ট অফিসের আওতায় ‘খতমে তারাবি’র ব্যবস্থা করা হলে, বিধি মোতাবেক সম্মানির ব্যবস্থা অফিস তহবিল থেকেও করা যেতে পারে; নতুবা চাঁদা আদায়ের মাধ্যমেও করা যেতে পারে।
(৭) শুধু তারাবির হাফেজদের কথা বলে সম্মানি উসুল করলে, তা অন্যদের প্রদান বৈধ হয় না। তবে অন্যদেরও প্রদানের সুবিধার্থে এবং অন্যান্য খরচেরও প্রয়োজনের কথা জানান দিয়ে যৌথভাবে উসুল করা হলে সে ক্ষেত্রে উল্লেখকৃত সব খাতে ব্যয় করা যায়।
(৮) কঠোর পরিশ্রম ও সাধনার মাধ্যমে সম্মানিত যে হাফেজরা ৩০ পারা পবিত্র কোরআন স্বীয় বক্ষে ধারণ করে রাখেন, তারা প্রকারান্তরে মহান আল্লাহর পবিত্র বাণী, ‘নিশ্চয় আমিই কোরআন নাজিল করেছি এবং আমি অবশ্যই তার হেফাজত করব।’ (সূরা হিজর : ০৯)। এর বাস্তব উদাহরণ-উপায়। সুতরাং এসব কোরআনের বাহক হাফেজদের সাহায্য, সহযোগিতা ও সম্মান প্রদর্শন অবশ্যই খোদ মহান আল্লাহকে সম্মানের নামান্তর এবং বিরাট সওয়াবের কাজ বটে।
মোটকথা, আমাদের মসজিদ সরকারি হোক বা পাড়া-মহল্লার জনগণের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত হোক; উপরিউক্ত বিস্তারিত ব্যাখ্যার আলোকে আমরা সম্ভাব্য যে কোনো ফান্ড থেকেই মাহে রমজানের নিয়োগপ্রাপ্ত হাফেজদের সম্মানি প্রদান করতে পারি। আর ‘হাদিয়া’ শিরোনামে এবং খুশি খুশি যা উসুল হয়, তা কালেকশন করে যাদের কথা বলে নেব, তাদেরই বণ্টন করে দেব। এটাই সর্বোত্তম কর্মপন্থা এবং বিরাট সওয়াবের কাজ বলে গণ্য।

লেখক : মুফতি, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়