Sunday, January 17

মানবিক সাংবাদিকতা


ইকবাল মাহমুদ : সকল পেশায়ই মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষ আছেন। সৎ চিকিৎসকরা রোগীর সেবা করে মানবতার জয়গান করেন, শিক্ষকরা মানুষ গড়ে সমাজ আলোকিত করেন, জনপ্রতিনিধিরা মানুষের সুখে-দুঃখে পাশে দাঁড়ান। তেমনি সাংবাদিকদেরও নৈতিক দায়বদ্ধতা আছে সমাজের প্রতি। বর্তমান কর্পোরেট সংস্কৃতির প্রভাব থেকে মুক্ত নয় মিডিয়া অঙ্গন। তাই অনেকটা চাকরী বাঁচাতে দিন রাত খাটতে হয় সাংবাদিকদের। কিন্তু এর মধ্যেও আর্ত মানবতার কল্যাণে বহু কাজ করার সুযোগ থাকে সাংবাদিকদের। ২০০৫ সালের একটি গল্প খুব মনে পড়ে। আমি তখন দৈনিক সিলেটের ডাক এর রিপোর্টার। রাতের শিফটে অফিস। দিনের বেলায় খবরের সন্ধানে ঘুরে বেড়াতাম শহর কিংবা গ্রামে। একদিন সন্ধ্যায় অফিসে ঢুকছি। রিশিপশন পেরিয়ে বিজ্ঞাপন বিভাগের পাশ দিয়ে লম্বা করিডোর হয়ে যেতে হয় নিউজরুমে। বিজ্ঞাপন বিভাগে এক নারী কন্ঠের শব্দ কানে বাজলো। কালো বোরখা পরা ২৫-২৬ বছরের মেয়েটি তার একটি কিডনী বিক্রী করতে চায়। ক্রেতা আকর্ষনের জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেবে। কিন্তু সে বিজ্ঞাপন ছাপতে হলে যে টাকা দরকার তা তার কাছে নেই। পা আটকে গেলো, থমকে দাঁড়ালাম। বিজ্ঞাপন এক্সিকিউটিভ রফিক ভাইয়ের অনুমতি নিয়ে মেয়েটির সাথে কথা বললাম। প্রথমেতো মেয়েটি কথাই বলতে চাইলোনা। তারপর রফিক ভাইয়ের অভয় পেয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় জীবনের করুণ এক গল্প শুনালো মেয়েটি। সিলেটের সীমান্তবর্তী জৈন্তাপুর উপজেলার নিভৃত পল্লীর মেয়ে। বৃদ্ধ বাবা বাড়িতে শয্যাশায়ী। বিবাহ উপযুক্ত তিন বোন। বাবার চিকিৎসা ব্যায় নির্বাহে এরই মধ্যে সর্বস্বান্ত হয়েছে পরিবারটি। ভিটে ছাড়া আর কিছুই নেই। এরই মধ্যে ভিলেজ পলিটিক্স এর শিকার হয়ে একমাত্র ছোটভাইটি হয়েছে মামলার আসামী। পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। তাকে ছাড়িয়ে আনতে সাতাশ হাজার টাকা খরচ হয়। ভিটে বন্ধক দিয়ে টাকা ঋণ আনা হয় পাশের বাড়ীর দুঃসম্পর্কের এক আত্মীয়ের কাছ থেকে। এখন টাকার জন্য চাপ দিচ্ছেন সেই পাওনাদার, অন্যথায় বাড়ি ছাড়ার আল্টিমেটাম দিয়েছেন। উপায়ান্তর না দেখে নিজের একটি কিডনি বিক্রী করার সিদ্ধান্ত নেয় মেয়েটি। আর সেজন্য পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতেই তার সিলেটের ডাক অফিসে আসা। মেয়েটির কাছ থেকে দুদিনের সময় নিলাম। সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন মারফতে খবরের সত্যতা যাচাই করে নিলাম। বিস্তারিত তথ্য দিয়ে এক আবেগঘন রিপোর্ট নামালাম সিলেটের ডাক এর পাতায়। পরদিন সকাল থেকেই ফোন আসা শুরু হলো ডাক অফিসে। দিনের শিফটের সহকর্মীরা আমাকে অনবরত ফোন আসার খবর জানালেন। বিপদগ্রস্ত সে পরিবারের পাশে দাঁড়াতে চান সবাই। নগদ টাকা, চেক জমা হতে থাকলো বার্তা সম্পাদকের টেবিলে। মেয়েটিকে খবর দেয়া হলো। বৃদ্ধ, অসুস্থ পিতাকে সাথে নিয়ে মেয়েটি আসলো। ঋণমুক্ত হলো পরিবারটি। বৃদ্ধ সেই পিতার জীর্ণ-শীর্ণ চেহারাজুড়ে সেদিন যে আনন্দাশ্রু দেখেছিলাম তা আজো ভাসে চোখের সামনে। ২০১৪ সালে টানা তিনমাস সারাদেশে অবরোধ কর্মসূচি পালণ করে বিএনপি-জামায়াত জোট। এসময় সিলেটের জৈন্তাপুরে পিকেটারদের ছোড়া পেট্টোল বোমায় নিহত হন ট্রাক চালক বকুল দেবনাথ। বকুল ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। ঘরে তার সন্তানসম্ভবা স্ত্রী আর ৫ বছরের ছোট্ট শিশু নিলয়। বিছানায় কাতরাচ্ছেন অসুস্থ বৃদ্ধা মা। বড় ভাইটি বেকার হওয়ায় তার পরিবারও ভরণপোষন করতেন বকুল। বড় ভাইয়ের স্ত্রী ক্যান্সারের রোগী। দিনমজুর বকুলের মৃত্যু যেন এক অমানিষার অন্ধকারে ফেলে দেয় পুরো পরিবারটিকে। ঘরে খাবার নেই, নিলয়ের স্কুলে যাওয়া বন্ধ। সহিংসতায় নিহতদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার ঘোষনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু বকুলের পরিবারের ক্ষতিপূরণের আবেদনটি আটকে আছে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায়। নানা অজুহাতে বার বার ঘুরাচ্ছেন কর্মকর্তারা। লাশ সৎকারের সময় বাড়িতে গিয়ে দশ হাজার টাকা অনুদানের ঘোষনা দিয়েছিলেন স্থানীয় সংসদ সদস্য, সে টাকার জন্য মাসের পর মাস ঘুরাচ্ছেন এমপি সাহেব। একদিন সন্ধ্যায় আমার অফিসে বসে সাংবাদিক, লেখক শাব্বীর আহমদ যখন এ কথাগুলো বলছিলেন তখন যেন একটির পর একটি শেল বিদ্ধ হচ্ছিলো মনের মধ্যে। বললাম কালই যাব বকুলের বাড়ী। রিপোর্ট করব আমি। পরদিন সকালবেলা রওয়ানা হলাম ওসমানীনগর উপজেলার শশারকান্দি গ্রামের উদ্দেশ্যে। দীর্ঘ দিন অন্যের ট্রাক চালিয়েছেন। মাস ছয়েক আগে স্বপন দেবনাথ নামের আরো একজনের সাথে মিলে একটি ট্রাক কিনেছিলেন। সে ট্রাক নিজেই চালাতেন বকুল। প্রতিমাসে ট্রাক এর কিস্তি পরিশোধ করেও ভালোই চলছিলো সংসার। হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পর কেবল সুখের মুখ দেখতে শুরু করেছিলেন বকুল। এমন সময় এ দুর্ঘটনা পুরো পরিবারটিকে ফেলে দেয় এক গভীর অনিশ্চয়তায়। বাড়ির ফুটেজ এবং পরিবারের সদস্যদের ইন্টারভিউ করে সিলেট ফিরলাম। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে সাহায্যের ব্যাপারে জেলা প্রশাসকের ইন্টারভিউ করলাম। জেলা প্রশাসক শহিদুল ইসলামের বদলির আদেশ হয়ে গেছে। এক সপ্তাহের মধ্যে তিনি নতুন কর্মস্থলে যোগ দেবেন। আমাকে তিনি আশ্বস্থ করলেন যাওয়ার বেলায় একটি ভালো কাজ তিনি করে যেতে চান। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বকুল দেবনাথ এর পরিবারের অনুদান প্রাপ্তি নিশ্চিত করবেন। অফিসে ফিরে রিপোর্ট করে ঢাকায় পাঠালাম। পরদিন একাত্তর টেলিভিশনে প্রতি ঘন্টার সংবাদ সংযোগে রিপোর্টটি প্রচার হতে থাকলো। চারিদিকে তোলপাড় হলো। এক সপ্তাহের মধ্যে দশ লাখ টাকা অনুদান পেলেন বকুল দেবনাথ এর পরিবার। বকুলের স্ত্রী আমাকে ফোন করে ধন্যবাদ দিলেন। স্বজন হারানোর বেদনা আর বিপদে টাকা পাওয়ার আনন্দে এক মিশ্র অনুভুতি প্রকাশ পেল তার কথায়। লেখক ইকবাল মাহমুদ সিলেট ব্যুরো প্রধান, একাত্তর টেলিভিশন

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়