মোহাম্মদ সিদ্দিকুর রহমান:
এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা.) এর কাছে এসে বলল, 'হে আল্লাহর রাসূল, যদি কোনো লোক আমার ধনসম্পদ ছিনিয়ে নিতে আসে, তাহলে সে ব্যাপারে আপনি কী বলেন? রাসূল (সা.) জবাব দিলেন, তোমার ধনসম্পদ তাকে দিও না। ওই ব্যক্তি আবার বলল, আপনি কী বলেন, যদি সে আমাকে সশস্ত্র আক্রমণ করে? তিনি জবাব দিলেন, তুমিও তাকে আক্রমণ করো। লোকটি বলল, আপনি কী বলেন, সে যদি আমাকে হত্যা করে? তিনি বললেন, তাহলে তুমি শহীদ।' ওই ব্যক্তি আবার জিজ্ঞেস করল, 'আর যদি আমি তাকে হত্যা করি, তাহলে সেক্ষেত্রে আপনি কী বলেন? রাসূল (সা.) জবাব দিলেন, তাহলে সে জাহান্নামে যাবে।' (মুসলিম)।
এ হাদিসে রাসূল (সা.) নিজের ধনসম্পদ রক্ষার চেষ্টা করা, ধনসম্পদ ছিনিয়ে নিতে চাইলে তা প্রতিরোধ করা, প্রয়োজনে সশস্ত্র সংগ্রাম করা, এমনকি আক্রমণকারীকে হত্যা করাও বৈধ বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। অন্যদিকে আক্রমণকারীর আক্রমণে যদি নিজ ধনসম্পদ রক্ষাকারী মৃত্যুবরণ করে, তবে তার শহীদের মর্যাদা লাভ হবে বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। শহীদের মর্যাদা ইসলামে সবচেয়ে বেশি। আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেছেন, 'আর যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয় তাদের মৃত বলবে না। বরং তারা জীবিত, কিন্তু তোমরা তা বোঝ না।' (সূরা বাকারা : ১৫০)।
আবুল আওয়ার সাঈদ ইবনে আমর ইবনে নুফাইল (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, 'আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি নিজের ধনসম্পদ হেফাজত করতে গিয়ে নিহত হয়, সে শহীদ। যে ব্যক্তি আত্মরক্ষা করতে গিয়ে নিহত হয়, সে শহীদ। যে ব্যক্তি নিজের দ্বীনের হেফাজত করতে গিয়ে নিহত হয়, সে শহীদ। যে ব্যক্তি নিজ পরিবারের জন্য নিহত হয় সে শহীদ।' (তিরমিজি)।
যেসব লোক আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয় তাদের শহীদ বলা হয়। সাধারণভাবে অবশ্য তাদের মৃত বলাও জায়েজ। তবে তাদের মৃত্যুকে অন্যদের মৃত্যুর সমপর্যায়ভুক্ত মনে করতে নিষেধ করা হয়েছে। কেননা, মৃত্যুর পর প্রত্যেকেই বরজখের (কবরের) জীবন লাভ করে থাকে এবং সে জীবনের পুরস্কার অথবা শাস্তি ভোগ করতে থাকে। কিন্তু শহীদদের সে জীবনে অন্যান্য মৃতের তুলনায় একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ মর্যাদা দান করা হয়, তা হলো অনুভূতির বৈশিষ্ট্য। অন্যান্য মৃতের তুলনায় তাদের বেশি অনুভূতি দেয়া হয়। সাধারণ মৃতের তুলনায় শহীদরা বরজখের জীবনে বহুগুণ বেশি অনুভূতিপ্রাপ্ত হয়ে থাকেন। এমনকি শহীদের এ জীবনাভূতি অনেক ক্ষেত্রে তাদের জড় দেহেও এসে পৌঁছে। অনেক সময় তাদের হাড়-মাংস-দেহ পর্যন্ত মাটিতে বিনষ্ট হয় না। জীবিত মানুষের দেহের মতোই অবিকৃত থাকতে দেখা যায়। হাদিসের বর্ণনায় তার উল্লেখ আছে। এ কারণেই শহীদদের জীবিত বলা হয়েছে। বরজখের জীবনে সর্বাপেক্ষা শক্তিসম্পন্ন হচ্ছেন নবী-রাসূল, অতঃপর শহীদ, তারপর সাধারণ মৃত ব্যক্তিরা। কোনো কোনো হাদিস দ্বারা জানা যায়, নেককার বান্দাদের অনেকেই বরজখের জীবনে শহীদদের কাছাকাছি পর্যায়ে হয়ে থাকেন। কেননা আত্মশুদ্ধির সাধনারত অবস্থায় যারা মৃত্যুবরণ করেন, তাদের মৃত্যুকেও শহীদের মৃত্যু বলা যায়। তবে নিঃসন্দেহে অন্য নেককার সালেহদের তুলনায় শহীদদের মর্যাদা বেশি। (তফসিরে মাআরেফুল কোরআন, অখ-, পৃষ্ঠা ৭৯-৮০)।
কোনো বস্তু বা বিষয় যখন আর্থিক মূল্যমান বহন করে, তখন তা সম্পদ হিসেবে অর্থনীতিতে বিবেচ্য হয়। ভূমি আর্থিক মূল্যমান বহন করে বিধায় তা সম্পদ হিসেবে স্বীকৃত। তাই কারও কোনো ভূসম্পদ কেউ জোর করে দখল করতে চাইলে তার জন্য প্রতিরোধ করা, অস্ত্র ধারণ করা এবং পরিণামে জীবনপাত করা শহীদের মর্যাদায় পর্যবসিত হয়। মাতৃভূমি নিজের ভূমির মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত। তাই নিজের মাতৃভূমি রক্ষার জন্য জীবনপাত করলে তাকেও শহীদের মর্যাদা না দেয়ার কোনো কারণ নেই। কোনো দেশের স্বাধীনতার সঙ্গে দেশের ভূমির সম্পর্ক জড়িত। দেশ পরের অধীনে চলে যাওয়ার অর্থ দেশের স্বাধীনতা ভূলুণ্ঠিত হওয়া। ফলে দেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য জীবন বিসর্জন দিলেও তাতে শহীদের মর্যাদা অর্জিত হয়।
দেশের স্বাধীনতা রক্ষার মর্যাদাকে ইসলামে সবসময়ই গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। 'আল্লাহর পথে একদিন সীমান্ত পাহারা দেয়া দুনিয়া ও দুনিয়ার উপরস্থ সবকিছু থেকে উত্তম। আর জান্নাতে তোমাদের কারও এক চাবুক পরিমাণ জায়গা দুনিয়া ও তার উপরস্থ সবকিছু থেকে উত্তম। আর সাঁঝে আল্লাহর পথে বের হওয়া অথবা সকালে বের হওয়া দুনিয়া ও তার উপরস্থ সবকিছু থেকে উত্তম।' (বোখারি)। এ হাদিস থেকে মনে করা যায়, আল্লাহর পথে দেশ বা স্বাধীনতা রক্ষার জন্য বের হওয়া অর্থাৎ যুদ্ধ করা দুনিয়ার যে কোনো কিছু থেকে উত্তম। অন্যদিকে দেশ বা স্বাধীনতা রক্ষাকল্পে সীমান্ত পাহারা দেয়াও তেমনি মর্যাদাকর। আর মর্যাদার প্রতিদান যে বেহেশত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ হাদিসেই এক চাবুক বেহেশতের জায়গার মূল্যমান পৃথিবীর যে কোনো কিছুর চেয়ে শ্রেষ্ঠতর, তা বলে দেয়া হয়েছে অর্থাৎ এসব কাজের জন্য বেহেশতে স্থান নির্দিষ্ট করা হয়ে যায়।
আল্লাহর পথে জীবন পরিচালনাকারী বেহেশতি। আবু আবস আবদুর রহমান ইবনে জাবর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন, 'আল্লাহর পথে যে বান্দার দুইটি পা ধূলিধূসরিত হবে এবং আবার তাকে জাহান্নামের আগুনও স্পর্শ করবে, এমনটি কখনও হবে না।' (বোখারি)। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে গেলে আল্লাহর বান্দার পা ধূলিধূসরিত হবে। ফলে তার জন্য জাহান্নামের আগুন কাছে আসবে না। রাসূল (সা.) বলেছেন, 'শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার আকাঙ্ক্ষা করো না। আর যখন তোমাদের শত্রুর সঙ্গে মোকাবিলা হয়েই যায়, তখন দৃঢ়ভাবে মোকাবিলা করতে থাক। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) এ হাদিসটি বর্ণনা করেছেন।' (মুসলিম)।
দেশের ভূমি, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব দেশবাসী সবার কাছেই বড় নেয়ামত এবং আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে দেয়া এক বিরাট আমানত। স্বাধীন দেশে স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করা যায়, ধর্মকর্ম পালন সহজতর হয়। স্বাধীন দেশের স্বাধীনতা রক্ষা করা প্রতিটি অধিবাসীর জন্যই অবশ্য কর্তব্য। এক্ষেত্রে মুসলমানদের ওপর ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আর দেশের ভূমি, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে গিয়ে কেউ যদি নিহত হয়, তবে তাকে শহীদের মর্যাদা দেয়া হবে। প্রতিটি মুসলমানের জন্য শাহাদাতের মর্যাদা এক কাম্য বিষয়, কেননা এর জন্য বিনা হিসাবে বেহেশত নির্ধারণ করে রাখা হয়েছে এবং সে বেহেশত হবে সর্বোচ্চ মর্যাদার বেহেশত। কেউ যদি দেশের সব পাহারা দিয়ে দেশকে শত্রুমুক্ত রাখে, তার জন্যও ইসলামে গুরুত্বপূর্ণ মর্যাদা রয়েছে। আর দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় কেউ যখন মৃত্যুবরণ না করে জীবিত ফিরে আসে, তখন সে হয় গাজী, ইহকালেও তার মর্যাদা এবং পরকালেও।
Saturday, March 28
এ সম্পর্কিত আরও খবর
শিশুদেরকে মসজিদে নেওয়া যাবে কি? ইসলামে ইমানের পর নামাজ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে ৮২ বার সরাসরি না
জেনে নিন নেটওয়ার্কিং এর আদ্যোপান্ত বর্তমান পৃথিবীতে যে পেশাগুলো মানুষের পছন্দের তালিকার শীর্ষস্থান দখল করে রয়েছে সেগুলোর মধ্যে নেট
ইন্টারনেটে ধীরগতির সমস্যা দূর করবেন যেভাবে মোবাইলে ইন্টারনেটে সমস্যা? বা নেটওয়ার্কই পাচ্ছেন না ফোন করার জন্য? তবে হতে পারে নেটওয়ার্কের ঝ
আজ পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.) আজ (১২ রবিউল আউয়াল) পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.)। প্রায় দেড় হাজার বছর আগে এই দিনে মানব জাতির জ
সূরা আরাফে শয়তানের অভিশপ্ত হওয়ার বর্ণনা শয়তানের সঙ্গে মানুষের শত্রুতার সূচনা সৃষ্টির শুরু থেকে। আল্লাহ তায়ালা যখন মানুষ অর্থাৎ আদিপিত
জুমার দিনের ফজিলত বর্ণিত হয়েছে যে ৪ হাদিসেকানাইঘাট নিউজ ডেস্ক:মুসলমানদের কাছে জুমাবার অপরিসীম ফজিলতের। সপ্তাহের শ্রেষ্ঠ দিন। এদিনের সওয়াব-মর্
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়