কানাইঘাট নিউজ ডেস্ক : স্বর্গরাজ্য বান্দরবান। সবুজ ঘেরা পাহাড় আর নদীর মিলনস্থল। মেঘের ভেতর দিয়ে পাহাড় থেকে পাহাড় ঘুরে বেড়ানোর জন্য বান্দরবান ঘুরতে আসেন অনেকেই। পাহাড় ঘেরা ছোট্ট বান্দরবান শহরে নামলেই একটা নীরব শীতল পরশ হৃদয় ছুঁয়ে যায়। ভাললাগায় ভরে থাকে মন, ছটফট করতে থাকে; কখন ছুটে যাব ঐ দূর পাহাড়ের চূড়ায়। সবাই ঘুরতে যেতে চায় নীলাচল, মেঘলা, চিম্বুক পাহাড় আর নীলগিরিতে। নীলাচল আর নীলগিরিতে গেলে মেঘের উপড়ে উঠে চারদিকের সবুজ পাহাড়ের মাঝে চিরসুন্দর সরু শঙ্খ নদীর সৌন্দর্য দেখে অনেকে মুগ্ধ হয়ে যান। অনেকের কাছে ওটাই যেন স্বর্গ! অনেকে আবার মেঘলা পর্যটন কমপ্লেক্সে গিয়ে লেকে নৌকায় আর আকাশে ক্যাবল কারে ভ্রমণ করে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যান। আর এ সকল ভ্রমণে যদি প্রিয়জন, বন্ধু কিংবা স্বজনরা থাকেন তাহলে তো সেই আনন্দ কয়েকগুণ হয়ে যায়। আর ফিরে যেতে ইচ্ছে করে না কংক্রিট ঘেরা ঐ শহুরে জীবনে। অনেক তরুণ যারা ভ্রমণ পিপাসু, ভালবাসেন প্রকৃতিকে আবিষ্কার করতে তাদের কাছে বগা লেক ভ্রমণের তো বিকল্পই নেই। আর যারা ট্রেকিং করতে ভালবাসেন, পাহাড়ের চূড়ায় উঠে চিৎকার করতে চান, তাদের জন্য কেওকারাডং আর তাজিং ডং ট্রেকিং অনেক অ্যাডভেঞ্চারাস। কিন্তু, পর্যটন মানে কি শুধুই আনন্দ? শুধুই প্রকৃতিকে আবিষ্কার করা? প্রত্যাহিক ব্যস্ত জীবনকে ভুলে গিয়ে কয়েকদিনের জন্য হারানো মাত্র? নাকি প্রাণী আর পাখি দেখা?
না, তা নয়। আমরা কোনো জায়গায় বেড়াতে যাবার আগে ভাবি জায়গাটা কতো সুন্দর হবে, আশেপাশে দেখার মতো কী কী আছে, কে কে যাবে, কত খরচ হতে পারে ইত্যাদি। কিন্তু, আমরা কি কখনও ভেবেছি, আমরা কীসের টানে ছুটে যাই বেড়াতে?
একটু চিন্তা করলেই উত্তরটা সহজ হবার কথা। আমাদের সবচেয়ে আগ্রহের জায়গা হচ্ছে মানুষের জীবন ও জীবিকা, প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের জীবনের নিবিঢ় সম্পর্ক। প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে কীভাবে মানুষ বেঁচে থাকে তা আমাদের জানতে ইচ্ছে করে। কোন নতুন জায়গায় ঘুরতে গেলে সেখানকার মানুষের কোন বিশেষ উৎসব আছে কি না, তাদের সুখ দুঃখ, তাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য, ভাষা সবকিছুই আমাদের আগ্রহের বিষয়। মোট কথা, একটি সংস্কৃতিকে জানাই আমাদের মূল আগ্রহ। তাই, পর্যটন শুধুমাত্র আনন্দ নয়, বেড়ানো নয়; পাশাপাশি এক সংস্কৃতির সঙ্গে অন্য সংস্কৃতির মেলবন্ধন। অজানাকে জানা, অদেখাকে দেখা আর বোঝা।
উপরের বিষয়গুলোকে উপজীব্য রেখে আজ একটি জায়গার সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেবো। জায়গাটির নাম রেমাক্রী। বান্দরবান জেলার থানচি উপজেলার একটি ইউনিয়ন। মায়ানমার সীমান্তের কাছেই অবস্থিত এ স্থান ভ্রমণ করলে আপনার পর্যটক মনের পিপাসা মিটবে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। ভ্রমণ, অবস্থান, আর রেমাক্রী আবিষ্কার সবই হবে আপনার জন্য অভূতপূর্ব।
BB1
প্রথমেই যে প্রশ্ন আসে, কীভাবে যাবো রেমাক্রী? রেমাক্রী যেতে হলে আপনাকে প্রথমেই আসতে হবে বান্দরবান শহরে। আপনি ঢাকা থেকে আসলে প্লেনে চট্টগ্রাম এসে বাসে বান্দরবান অথবা, সরাসরি বাসে বান্দরবান আসতে পারেন। বান্দরবান থেকে সকাল সকাল যেতে হবে আশি কিলো দূর থানচি বাজার। সরাসরি বাসে যেতে পারেন; অথবা মেঘের শীতল পরশের সাথে পাহাড়ের বোঝাপড়া উপভোগ করতে করতে খোলা ছাদের চান্দের গাড়িতেও ভ্রমণ করতে পারেন। তবে ঘুমকে বিসর্জন দিয়ে তিন ঘণ্টার এ যাত্রা ভোরবেলা শুরু করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। সূর্যোদয়ের সময় যখন মেঘেরা পাহাড়ের উপত্যকায় লুকিয়ে থাকে তখন রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে উদীয়মান সূর্যের সঙ্গে একটি ক্লিক আপনার গোটা জীবনের সম্বল হতে পারে। সেটা মিস করবেন না আশা করি।
থানচি বাজারে পাহাড়ি কোন খাবার হোটেলে সকালের নাস্তা সেরে নিতে পারেন। পাহাড়িদের একটু ঝাল মুগ ডালের সঙ্গে রুটি কিংবা পরোটা আপনার ভ্রমণ ক্লান্তি দূর করবে। সঙ্গ এক কাপ চা মন্দ হবে না। থানচি বাজারটি একটি মাঝারি আকারের বৈচিত্র্যময় বাজার। এখানে আপনার প্রয়োজনীয় সব কিছুই কিনতে পাবেন, মোটামুটি সুলভ মূল্যেই। বার্মিজ স্যান্ডেল থেকে শুরু করে কাউবয় হ্যাট সবই পাবেন। শীতকালে ভ্রমণ করলে শীতের কাপড় কিনে নেয়াটা অপচয় হবে না। এ বাজারেই পাহাড়ি বাঙালীর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান খুব সহজেই চোখে পড়বে। পাহাড়ি মানুষের জীবিকা সম্পর্কে কিছুটা আঁচও করা যাবে।
থানচি বাজারের নিচেই শঙ্খ নদী। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামলেই সারি সারি নৌকা বাঁধা নদীর ঘাট সহজেই চোখে পড়বে। থানচি ঘাট থেকে নৌকায় ভ্রমণ করতে হবে। ছয় সাত জন হলে একটি পুরো নৌকা ভাড়া করতে পারেন; সংখ্যায় কম হলে শেয়ারে যেতে পারবেন। নৌকা ভ্রমণ শুরু হলেই দুটি বিষয় চোখে পড়বে। এক, যে নৌকায় ভ্রমণ করছেন সেটি সাধারণ কোনো নৌকা নয়। শীতকালে শঙ্খ নদীতে বেশি পানি থাকে না। অল্প পানিতে দ্রুত চলার জন্য বিশেষ কারুকার্যে তৈরি করা হয়েছে এ নৌকা। দুই, শঙ্খ নদীটি ঘিরেই মূলত গড়ে উঠেছে পাহাড়িদের বসতি। নদীর দু’ধারে মাঝে মাঝেই দেখা যাবে পাহাড়ি নৃ গোষ্ঠীর ঘর বাড়ি।
BB2
শঙ্খ নদীর স্রোত অনেক প্রবল। পাহাড়ি ঝর্ণার এ নদীর স্রোতের প্রতিকূলে নৌকা ভ্রমণ শুধু মহা আনন্দদায়কই নয়, অভূতপূর্বও বটে। অজান্তেই আপনার মুখে ভাললাগার ছাপ থাকবে, থাকবে মৃদু হাসি। মাঝে মাঝে আনন্দে গান ধরতে পারেন অনেকেই। এ সময় আপনার ক্যামেরাটি হাতে রাখলে নদীর দু’পাশের অপরূপ দৃশ্য উপভোগ করার পাশাপাশি ক্যামেরায় ধারণ করাটা দারুণ হবে। সহসাই চোখে পড়বে পাহাড়ের বুক চিড়ে নেমে আসা জলের ধারা, আর ছোট বড় অনেক পাথর। এসব পাথরের মাঝ দিয়ে চলার সময় একটু সাবধানতা অবলম্বন না করলে দূর্ঘটনায় আনন্দ মাটি হয়ে যেতে পারে।
তবে, সব কিছু ছাপিয়ে শঙ্খ নদীর দু ঘণ্টা ভ্রমণেই পাহাড়িদের জীবন জীবিকা সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা মিলবে। সহজেই বোঝা যাবে কীভাবে পাহাড়ের ঢালুতে জুম চাষ হয়, কীভাবে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর নারীরা কঠোর পরিশ্রম করে পাহাড় বেয়ে জঙ্গল ঘুরে খাবার সংগ্রহ করে, কীভাবে নদীতে বড়শি ফেলে মাছ ধরে, কীভাবে শিশু কিশোররা নদীর পানিতে সাঁতার কাটে, বড়রা নদীতে গোসল করে, জল ভরে নিয়ে যায়; সবকিছু। পাহাড়ের সঙ্গে, নদীর সঙ্গে মিশে আছে ওদের জীবন।
BB
খানেক ভ্রমণের পরেই পৌঁছবেন বড় পাথর নামের একটি অপূর্ব সুন্দর জায়গায়। সেখানে অনেক পুরনো বড় বড় পাথর নদীর মাঝখানে পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছে। পাশে সুউচ্চ পাহাড়ের ঢাল আর সবুজ গাছ দেখে মনে হবে আপনি কোন স্বপ্নরাজ্যে আছেন। সাদা মেঘের দল আছড়ে পড়ছে সবুজের কোলে। দূরে সবুজ আর নীল দিগন্ত মিলে মিশে একাকার। এখানে নেমে ক্যামেরায় নিজেকে আর প্রকৃতিকে রেকর্ড না করা বোকামি বৈ কিছু হবে না। পাহাড়িদের স্থানীয় ভাষার বৈচিত্র্য আপনাকে মুগ্ধ করবে। নৌকার মাঝির কাছে এই সুযোগে দু একটি শব্দ বা বাক্য শিখলে তা হবে অমূল্য। জানেনই তো, ভাষাই মানুষকে কাছে টানে। ওদের ভাষায় একটু যোগাযোগ করতে পারলেই, ওরা আপন করে নিবে, ভালও বাসবে।
বড়পাথর থেকে ঘণ্টা খানেক ভ্রমণের আগেই রেমাক্রী পৌঁছে যাবেন। সেখানে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে প্রশস্থ ঝর্ণাধারা। কিন্তু, পানিতে ভেজার পূর্বেই রেমাক্রী বাজারে গিয়ে দুপুরের খাবারটা সেরে নিতে পারেন। এক্ষেত্রে, পাহাড়িদের চালের ভাত সঙ্গে বনমোরগের মাংস খাওয়া যেতে পারে। তবে আগে থেকেই ঝালটা কম দেয়ার জন্য না বললে হিতে বিপরীত হতে পারে। সঙ্গে পাহাড়িদের বিশেষ কোন রান্না বা পিঠা চেষ্ঠা করাটা বোকামি হবে না। খাবার পর একটু বিশ্রাম নিয়ে ঝর্ণার পানিতে গা এলিয়ে দিতে পারেন। রেমাক্রীতে কোন পাহাড়ি বাসায় রাতও কাটাতে পারেন, নতুবা, ওখান থেকে ঘণ্টা দুয়েক হেঁটে মায়ানমার সীমান্তের কাছাকাছি অপরূপ ‘নাফাকুম’ ঝর্ণাও দেখতে যেতে পারেন। তবে, নাফাকুম পর্যন্ত যেতে হলে কয়েকজন দলবদ্ধ হয়ে সাবধানতার সঙ্গে যাওয়াটাই উত্তম।
রেমাক্রীর এই ভ্রমণ আপনার জীবনের একটি স্মরণীয় আনন্দের দিন হয়ে থাকবে সন্দেহ নেই। আকাশপথে চট্টগ্রাম আসলে তো এক ভ্রমণে আকাশ, স্থল আর নৌ সবই হয়ে যাবে। উপভোগ করা হবে নীল, সবুজ আর জলের লুকোচুরি আর ভালবাসার খেলা। সেই সঙ্গে স্থানীয় পাহাড়িদের জীবন জীবিকা আর ভাষার জ্ঞান আপনার জীবনের পাথেয় হবে। সব মিলে, রেমাক্রী ভ্রমণ হবে মনে রাখার, ভালবাসার।
BB3
খবর বিভাগঃ
দর্শনীয় স্থান
ফিচার
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়