Monday, October 20

আজান : ইতিহাস থেকে


মুফতি আবু বকর সিরাজী আজান প্রবর্তিত হওয়ার ইতিহাস ও তারিখ নিয়ে ঐতিহাসিক ও হাদিসবিশারদদের মধ্যে কিছুটা মতভেদ রয়েছে। এ ব্যাপারে মোট চারটি মতামত পাওয়া যায়। যথা_ * একদল আলেমের মতে, আজানের প্রবর্তন ঘটেছে মদিনায় হিজরতের আগে, মক্কায় থাকা অবস্থায়। তারা এ মতের সমর্থনে ওই হাদিস উল্লেখ করেন, যে হাদিসে বলা হয়েছে, 'জিবরাঈল (আ.) আজান শিখিয়েছিলেন তখনই, যখন নামাজ ফরজ হয়েছিল।' যেহেতু নামাজ ফরজ হয়েছে মক্কায় থাকতেই, তাই আজানও প্রবর্তিত হয়েছে মক্কায় থাকতেই। * কারও কারও অভিমত হচ্ছে, রাসূল (সা.) কে মেরাজের রাতে আজান শেখানো হয়েছিল। * কেউ কেউ বলেছেন, দ্বিতীয় হিজরিতে আজান প্রবর্তিত হয়েছে। * অধিকাংশ ওলামায়ে কেরাম, ঐতিহাসিক ও ফকিহদের মতে, আজান প্রবর্তিত হয়েছে প্রথম হিজরিতে মদিনায়। মক্কায় আজান প্রবর্তিত হওয়ার মতের স্বপক্ষে আরেকটি প্রমাণ হজরত ওমর (রা.) এর বর্ণিত হাদিস। তিনি বলেন, 'যখন রাসূল (সা.) কে ইসরা ও মেরাজ করানো হয় তখন আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রতি আজানের হুকুম অবতীর্ণ করেন এবং তিনি সেই আজানের আদেশ নিয়ে অবতরণ করেন এবং বেলালকে তা শিক্ষা দেন।' (সুনানে তাবরানি)। বিখ্যাত হাদিসবিশারদ ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.) ঐতিহাসিক এ বিতর্ক ও মতভেদের সমাধানকল্পে বলেন, যদিও একাধিক হাদিস প্রমাণ বহন করে, আজান প্রবর্তিত হয়েছে হিজরতের আগে মক্কায়। কিন্তু নির্ভরযোগ্য অভিমত হচ্ছে, আজান মদিনাতেই প্রবর্তিত হয়েছে। ইমাম কুরতুবী (রহ.), আল্লামা সুহায়লী (রহ.) প্রমুখ হাদিসবিশারদ ও মুফাসসির মক্কা এবং মদিনায় আজান প্রবর্তিত হওয়া সংক্রান্ত মতভেদের মধ্যে সামাঞ্জস্য সাধনকল্পে উল্লেখ করেন, যেসব হাদিসে মক্কায় থাকা অবস্থায় আজান শিক্ষা দেয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে সেখানে শুধু তাঁকে আজান শোনানো হয়েছে। তখনও তা তাঁর ওপর শরিয়ত হিসেবে প্রবর্তিত হয়নি। শরিয়ত হিসেবে প্রবর্তিত হয়েছে মদিনায় গমনের পর। ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.) এসব মতভেদকে অপ্রয়োজনীয় প্রয়াস বলে অভিহিত করেছেন এবং বলেছেন সহিহ হাদিস বিদ্যমান থাকতে সেটাই মেনে নেয়া উত্তম ও নিরাপদ। আর তা হচ্ছে, আজান প্রবর্তিত হয়েছে মদিনায় হিজরতের পর। (ফাতহুল বারি, ফাতহুল মুলহিম : ২/২)। তবে হিজরতের ঠিক কত বছর পর প্রবর্তিত হয়েছে তাতে মতবিরোধ রয়েছে। ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.) এর মতে, আজান প্রবর্তিত হওয়ার ঘটনা হিজরতের দ্বিতীয়বর্ষে সংঘটিত হয়েছে। পক্ষান্তরে আল্লামা আইনীর (রহ.) মতে, এটি ছিল হিজরতের প্রথমবর্ষের ঘটনা। ইমাম বোখারি (রহ.) এর বর্ণনাভঙ্গি দ্বারাও বোঝা যায়, আজানের প্রবর্তিত হয়েছে হিজরতের পর খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে। আজান প্রবর্তিত হওয়ার ঘটনা শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহাদ্দেসে দেহলভী (রহ.) বলেন, সাহাবায়ে কেরাম দেখলেন জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায় করা সুন্নতে মোয়াক্কাদা আর একই স্থানে একই সময়ে কোনোরূপ ঘোষণা বা আহ্বান ছাড়া সমবেত হয়ে জামাতে নামাজ আদায় করা সহজ নয়। তাই তারা একই সময়ে সমবেত করার উপায় হিসেবে ঘোষণা বা নামাজে আহ্বান করার পদ্ধতি নিয়ে পরামর্শ করতে লাগলেন। কিন্তু সে সময় সবাইকে একত্রিত করার সর্বজন গ্রহণযোগ্য কোনো মাধ্যম ছিল না। এজন্য রাসূল (সা.) তাদের নিয়ে পরামর্শ সভা করলেন। পরামর্শ সভায় চারটি প্রস্তাব এলো। * নামাজের সময় পতাকা উড়িয়ে দেয়া। * আগুন জ্বালানো। * নামাজের সময় শিঙ্গায় ফুঁক এবং * নামাজের সময় ঢোল বাজানো। উলি্লখিত প্রস্তাবগুলোর কোনো একটি প্রস্তাবও রাসূল (সা.) এর মনঃপূত হলো না। প্রথম প্রস্তাব এজন্য নয় যে, যারা কাজকর্মে ব্যস্ত থাকবে কিংবা দূরে অবস্থান করবে তারা পতাকা দেখতে পাবে না। দ্বিতীয় প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হলো আগুন জ্বালানো অগি্নপূজকদের কাজ বলে। তাই মুসলমানরা নিজেদের ইবাদত পালনের জন্য অগি্নপূজকদের কাজের অনুসরণ করতে পারে না। অপরদিকে শিঙ্গা ফুঁকানো খ্রিস্টানদের কাজ এবং ঢোল বাজানো ইহুদিদের কাজ। এ কারণে এ দুটি প্রস্তাবও গ্রহণযোগ্য হলো না। ফলে কোনোরূপ সিদ্ধান্ত ছাড়াই সেদিনের পরামর্শ সভা মুলতবি হয়ে গেল। রাসূল (সা.) এর মতো সাহাবারাও এ নিয়ে চিন্তামগ্ন ছিলেন। এ চিন্তামগ্ন সাহাবিদের অন্যতম হলেন আবদুল্লাহ ইবনে জায়েদ (রা.)। ওই রাতে তিনি স্বপ্নে দেখলেন, 'এক ব্যক্তি শিঙ্গা নিয়ে যাচ্ছে। তিনি ওই লোককে বললেন এটি আমার কাছে বিক্রি করে দিন। এর সাহায্যে আমি মানুষকে নামাজের দিকে ডাকব। লোকটি বললেন, আমি আপনাকে নামাজের জন্য ডাকার উত্তম একটি পদ্ধতি শিক্ষা দেব কি? এ কথা বলে তিনি তাকে আজানের বাক্যগুলো শিখিয়ে দিলেন।' রাত পোহালে আবদুল্লাহ ইবনে জায়েদ (রা.) রাসূল (সা.) এর কাছে স্বপ্নটি প্রকাশ করলেন। স্বপ্নের বিবরণ শুনে রাসূল (সা.) বললেন_ নিশ্চয় এটি একটি সত্য স্বপ্ন। এরপর তিনি বেলাল (রা.) কে বললেন, হে বেলাল! ওঠো আবদুল্লাহ যা বলতে বলে তা শেখো এবং আজান দাও। আদিষ্ট হয়ে হজরত বেলাল (রা.) জোহরের আজান দেন। আজান শুনে হজরত ওমর (রা.) ছুটে আসেন এবং বলেন_ 'আমিও সেরূপ দেখেছি, যেরূপ দেখেছেন আবদুল্লাহ ইবনে জায়েদ।' তার কথা শুনে রাসূল (সা.) বললেন, তাহলে তুমি তা প্রকাশ করলে না কেন? উত্তরে তিনি বললেন, আবদুল্লাহ আমার চেয়ে অগ্রগামী হয়েছেন তাই লজ্জায় তা প্রকাশ করিনি। মুজামে আওসাতের এক রেওয়ায়েতে আছে, আবু বকর সিদ্দিক (রা.) কেও স্বপ্নে আজান শেখানো হয়েছিল। ইমাম গাজ্জালী (রহ.) 'আল-ওয়াসিত' গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, সে রাতে ১০ জনেরও বেশি সাহাবি একই রকমের স্বপ্ন দেখেছেন। (ফাতহুল বারি : ২/৬৩)। বস্তুত আজান প্রবর্তিত হওয়ার ঘটনায় রয়েছে ঐতিহাসিক শিক্ষা। এ ঘটনা দ্বারা পরিষ্কার হয়ে যায়, ইসলাম বিধর্মীদের কোনোরূপ ধর্মীয় প্রতীক গ্রহণ করার পক্ষে সায় দেয় না; বরং নিজস্ব প্রতীক ধারণ ও তা বুলন্দ করার নির্দেশ দেয়। এ কারণেই নামাজের জন্য সমবেত করার উদ্দেশ্য আগুন জ্বালানো, ঢোল পেটানো, কিংবা শিঙ্গা ফুঁকানো প্রভৃতি বিধর্মীদের আচরণ দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে এবং নিজস্ব শিআর বা ইসলাম ধর্মের অন্যতম প্রতীকস্বরূপ আজান প্রবর্তিত হয়েছে। আসলে আজান শুধু ইসলামী প্রতীকই নয়। এ অল্প কয়েকটি বাক্যের মধ্যে নিহিত রয়েছে তাওহিদ, রেসালাত, আখেরাতের বিশ্বাসসহ ইসলামের বুনিয়াদি বিষয়ের সুস্পষ্ট ঘোষণা। এ কারণেই ইমাম কুরতুবী (রহ.) বলেন, আজানের অল্প কয়েকটি বাক্যের মধ্যেই সনি্নহিত রয়েছে আকিদা সংক্রান্ত একাধিক বিষয়। কেননা, এর সূচনা হয় আল্লাহর বড়ত্বের বর্ণনার মধ্য দিয়ে। আর এতে স্বীকারোক্তি রয়েছে আল্লাহর একত্ববাদের, তাঁর পরিপূর্ণতার এবং সেইসঙ্গে তাঁর শরিকের অস্তিত্বহীনতা। এরপর রয়েছে রাসূল (সা.) এর রেসালাতের স্বীকারোক্তি। আরও আছে ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত নামাজের প্রতি আহ্বান এবং তার ফলে পরকালীন সফলতার ঘোষণা। আজানের মাধ্যমে যুগপৎভাবে অর্জিত হয় নামাজের সময়ের ঘোষণা, জামাতের প্রতি আহ্বান এবং ইসলামের প্রতীকের প্রচার। (ফাতহুল বারি : ২/৯৬)।

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়