Wednesday, October 1

হজের আদব ও বৈশিষ্ট্য


শায়খ ড. আলী আবদুর রহমান হুজাইফি: হজ শ্রেষ্ঠতম ইবাদত, চাই তা ফরজ হোক বা নফল। এর অশেষ সওয়াব ও প্রতিদান উভয় জগতে পাওয়া যায়। তবে হজের অসংখ্য কল্যাণ ও উপকারিতা সে-ই লাভ করবে, যে একমাত্র আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির জন্য তা পালন করবে এবং হজের কাজগুলো প্রিয় নবী (সা.) এর সুন্নত ও তরিকা মোতাবেক আদায় করবে। হজের কিছু রুকন, শর্ত, ওয়াজিব ও আদব রয়েছে। যে হজের কাজগুলো সুষ্ঠুভাবে আদায় করবে তার পাপরাশি মোচন হবে, অশেষ নেকি পাবে এবং জান্নাতে তার মর্তবা বুলন্দ হবে। রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, 'যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হজ করল এবং কোনো অশ্লীল ও অন্যায় কাজে লিপ্ত হলো না, সে এমনভাবে গোনাহমুক্ত হয়ে বাড়ি ফিরবে, যেভাবে শিশু মাতৃগর্ভ থেকে জন্ম লাভ করে।' (বোখারি ও মুসলিম)। তিনি আরও বলেন, মাবরুর হজের বিনিময় জান্নাত ব্যতীত আর কিছু নয়। (বোখারি, মুসলিম)। হজরত আমর ইবনুল আস (রা.) কে নবীজি (সা.) বললেন, 'হে আমর! তুমি কি জান না! ইসলাম গ্রহণ পূর্ববতী যাবতীয় পাপ ধ্বংস করে দেয়। আর হিজরত আগের গোনাহগুলো ক্ষমা করে দেয়। আর হজ পেছনের সব অন্যায়-অপরাধ নির্মূল করে দেয়।' (মুসলিম)। হজ বিশ্বের মুসলমানদের সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক সম্মিলন। এখানে শিক্ষিত-অশিক্ষিত, রাজা-প্রজা, পুরুষ-মহিলা, ছোট-বড়, সুস্থ-অসুস্থ, ধনী-দরিদ্র সর্ব শ্রেণীর মানুষের সম্মিলন ঘটে। গোত্র, বর্ণ, ভাষার ব্যবধান ভুলে তারা এখানে ইসলামী ভ্রাতৃত্বের ঐক্য ও সাম্যের প্রকাশ ঘটায়। হজের সময়ে বিভিন্ন দেশের মুসলমানরা নিজেদের মধ্যে মতবিনিময় করেন। পরস্পরে সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও হৃদ্যতার পরিচয় দেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, নিশ্চয়ই মোমিনরা পরস্পর ভাই ভাই।' (সূরা হুজরাত : ১০)। হজরত নোমান বিন বশির (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন, 'পারস্পরিক সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও ভালোবাসার ক্ষেত্রে মোমিনরা এক দেহের মতো। দেহের কোনো অঙ্গ ব্যথিত হলে সে ব্যথা পুরো দেহ অনুভব করে।' (বোখারি ও মুসলিম)। পবিত্র ইসলাম মোমিনদের উত্তম আদব, শিষ্টাচার ও অনুপম চরিত্র অর্জনের নির্দেশ দিয়েছে। হজের মৌসুমে যেহেতু নানা দেশের, নানা স্বভাবের ও মেজাজের মানুষের সমাবেশ ঘটে, তাই বিশেষ করে সে সময় তর্ক-বিতর্কে জড়ানো এবং ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হতে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'হজের মাস নির্ধারিত। যে ব্যক্তি এ মাসে হজ পরিপূর্ণ করার ইচ্ছা করে, তার জন্য অন্যায়, অশোভন উক্তি ও কাজ এবং ঝগড়া-বিবাদে জড়ানো জায়েজ নেই। তোমরা যা কিছু পুণ্য কাজ কর, আল্লাহ তা জানেন।' (সূরা বাকারা : ১৯৭)। হজের গুরুত্বপূর্ণ আদব হচ্ছে_ নিষিদ্ধ কাজ ও অশোভন উক্তি থেকে বিরত থাকা। বেশি করে জিকির, তালবিয়া ও কোরআন তেলাওয়াত করা। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, 'বায়তুল্লাহর তাওয়াফ, সাফা-মারওয়ার মাঝে সাঈ, জামারায় পাথর নিক্ষেপ_ প্রবর্তন করা হয়েছে আল্লাহর জিকির প্রতিষ্ঠার জন্য।' (মুসনাদ আহমাদ)। হজের সময়ে বিনম্রভাবে কথা বলা, সালামের প্রসার ঘটানো, সদকা করা এবং মেহমানদারি পুণ্যময় হজের বৈশিষ্ট্য। এমনিভাবে অন্তরকে স্বচ্ছ-পরিচ্ছন্ন রাখা এবং সব মুসলমানের জন্য দোয়া ও হিত কামনা করা হজের অন্যতম আদব। আল্লাহ তায়ালা বলেন, '(মুহাজির ও আনসারি সাহাবাদের) পরে যারা আগমন করেছে, তারা বলে_ হে আমাদের প্রভু! আমাদের এবং ঈমানে অগ্রণী আমাদের ভাইদের ক্ষমা করো এবং ঈমানদারদের বিরুদ্ধে আমাদের অন্তরে কোনো বিদ্বেষ রেখো না। হে প্রভু! নিশ্চয়ই তুমি দয়ালু, পরম করুণাময়।' (সূরা হাশর : ১০)। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, প্রিয় নবী (সা.) বলেন, 'যার মধ্যে তিনটি জিনিসের সমন্বয় হবে, তার প্রতি কোনো মুসলিমের অন্তরে হিংসা, বিদ্বেষ জন্মাবে না। তা হচ্ছে_ ১. আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমল করা। ২. মুসলিম নেতৃত্ব ও দায়িত্বশীলদের কল্যাণ কামনা করা। ৩. মুসলমানদের সঙ্গে জামাতবদ্ধ থাকা।' (তিরমিজি ও ইবনে মাজাহ)। এ গুণ তিনটির কারণে সে মুসলমানদের দোয়ায় শামিল হবে এবং ইসলামের সুদৃঢ় দুর্গে হেফাজতে থাকবে। এ কথা স্পষ্ট, হজ পালনে এসে প্রতিটি মুসলমান আনন্দবোধ করেন। কেননা বিভিন্ন দেশের মানুষের সঙ্গে তার দেখা-সাক্ষাৎ হয়। সুতরাং যে ব্যক্তি হজের কাজগুলো সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করে, সে নিজের ও সব মুসলমানের প্রতি অনুগ্রহ করে। আর যার হজ সুষ্ঠু ও সুন্দর হবে, তার জীবন সুন্দর হবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি মুসলমানদের কষ্ট দেয়ার জন্য কিংবা অন্যায় কাজের জন্য অথবা অসৎ কোনো উদ্দেশ্য সাধনের নিমিত্তে বা হজের শিক্ষাকে ভূলুণ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে মক্কায় আগমন করে, সে আল্লাহর সম্মানিত শহরে ধর্মদ্রোহী কাজ করল। আর যে সম্মানিত শহরে ধর্মবিরোধী কাজ করবে আল্লাহ তায়ালা তাকে অবশ্যই শাস্তি দেবেন। তিনি বলেন, 'যে ব্যক্তি মসজিদে হারামে অন্যায়ভাবে ধর্মদ্রোহী কাজ করার ইচ্ছা করে, আমি তাকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি আস্বাদন করাবো।' (সূরা হজ : ২৫)। মুসলমানদের এ বার্ষিক মহাসম্মিলন বিভিন্ন ধর্ম বিশ্বাসীদের মধ্যে বিরাট প্রভাব সৃষ্টি করতে সক্ষম। এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, হজ বিশ্বময় তাওহিদের শ্রেষ্ঠতম শিক্ষালয়। ইসলামের প্রচার-প্রসারে এবং তাবলিগের ক্ষেত্রে হজের ভূমিকা অনস্বীকার্য। শুধু ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রেও হজের রয়েছে বিরাট প্রভাব এবং উপকারিতা। কেননা হজের সময়ে মুসলমানরা পরস্পরে নিজেদের সমস্যাগুলো আলোচনা করে থাকেন। তখন তাদের জ্ঞানের প্রসার ঘটে এবং নিজ নিজ এলাকায় গিয়ে সেগুলো প্রসার করতে পারে। সুতরাং মুসলমানদের এ সম্মেলন একে অন্যের পরিপূরক। আর মুসলমানদের বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও ঐক্য স্থাপনের ক্ষেত্রে এ মহাসম্মিলনের প্রভাব সম্পর্কে যতই বলা হবে, তা কমই বলা হবে। ২ জিলহজ মদিনার মসজিদে নববিতে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষিপ্ত অনুবাদ করেছেন মাহবুবুর রহমান নোমানি

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়