Saturday, September 14

চা-বিক্রেতা থেকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী

ঢাকা : বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নির্বাচিত হওয়ার পর দলীয় সভাপতি রাজনাথ সিংয়ের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদি। ভারতের গুজরাট রাজ্যের এক রেলস্টেশনে চা বিক্রি করতেন বালক নরেন্দ্র মোদি। তারপর একসময় নাম লেখালেন রাজনীতিতে। গুজরাটের তিনবারের মুখ্যমন্ত্রী মোদিকে ২০১৪ সালে ভারতের লোকসভা নির্বাচনে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী করা হয়েছে।
টাইমস অব ইন্ডিয়া অনলাইনে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, গতকাল শুক্রবার দলীয় সভাপতি রাজনাথ সিং প্রধানমন্ত্রী পদে মোদির নাম ঘোষণা করেন।
২০০১ সালে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে অভিষেক হয়েছিল অনভিজ্ঞ মোদির। তারপর মাত্র ১২ বছরের মাথায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী পদে প্রার্থী। তাঁর সহকর্মীদের মতে, যৌবনের শুরু থেকেই লক্ষ্য অর্জনে আপসহীন ছিলেন হিন্দু জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ৬২ বছর বয়সী এই রাজনীতিক।
ভারতের ডানপন্থী হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিতে মোদিই প্রথম ‘প্রচারক’, যিনি মাত্র ১৩ বছরের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় দেশটির সবচেয়ে উন্নত গুজরাট রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হন। অথচ এর আগে প্রশাসন চালানোর কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না তাঁর।
তবে মোদির সমালোচকদের অভিযোগ, রাজনৈতিক জীবনে তাঁর উত্থানের পথে সহায়তাকারীদের ছুড়ে ফেলেছেন তিনি। এই তালিকার সর্বশেষ সংযোজন বিজেপির অন্যতম তারকা রাজনীতিক লালকৃষ্ণ আদভানি। প্রায় অচেনা মোদিকে তিনিই আজকের অবস্থানে এনেছেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক নরসিমা রাও বলেন, ‘মোদি দৃঢ়প্রত্যয়ী। তিনি একেবারেই সত্। আর ভীষণ পরিশ্রমী। পরিণতির কথা ভেবে কোনো কিছুতেই ছাড় দেননি তিনি। সাময়িক জয়ের মোহে কখনোই মোদিকে বাঁধা যায়নি।’

শৈশব
গুজরাটের সিংহাসনে বসা মোদির বর্তমান জীবনের বিপরীতে অতীতটা নিতান্তই জলুসহীন। গুজরাটের মেহসানা জেলার এক নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে ১৯৫০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর জন্ম তাঁর। চা-বিক্রেতা বাবার চার সন্তানের মধ্যে মোদি ছিলেন তৃতীয়। শৈশবে বাবাকে সাহায্য করতেন বেদনগর রেলস্টেশনে; যাত্রীদের কাছে হেঁটে হেঁটে চা বেচতেন মোদি।
ক্ষীণ আলো-বাতাস প্রবেশে সক্ষম, এমন এক বাড়িতে বাস ছিল মোদি পরিবারের। সেখানে জ্বলতে থাকা একমাত্র বাতিটি নিরন্তর জোগান দিত ধোঁয়া আর কালি।
পরিচিতজনদের ভাষ্য অনুযায়ী, স্কুলে মোদি ছিলেন আর দশটা ছাত্রের মতোই। কিন্তু ওই বয়স থেকেই তিনি ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ হিন্দু। তাঁর স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, টানা চার দশক ধরে ‘নবরাত্রি’র (উত্তর ভারতে পালিত হিন্দুদের একটি উত্সব) সময় উপবাস করছেন তিনি।
জীবনীগ্রন্থ রচয়িতা নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের মতে, কম বয়সে বিয়ে করেন মোদি। তবে শারীরিক সংসর্গে লিপ্ত হননি তিনি। বিয়ে করার বিষয়টি প্রকাশও করেননি তিনি। এর পেছনে একটি বড় কারণ ছিল হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠনগুলোর সম্মিলিত মোর্চা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) ‘প্রচারক’ পদ। গোপনীয়তা বজায় না রাখলে হয়তো ওই পদে আসীন হতে পারতেন না তিনি।
স্কুলে পড়ার সময়ই মোদির অর্চনার বিষয়টি অনেকের নজরে আসে। তিনি প্রায়ই পরিবার থেকে বেরিয়ে দূরে নির্জন স্থানে গিয়ে উপাসনা করতেন। কখনো তাঁকে দেখা যেত হিমালয়ে গিয়ে উপাসনা করতে।
১৯৬৭ সালে চূড়ান্তভাবে পরিবারের সঙ্গ ত্যাগ করেন তিনি।

 

আরএসএস ও অন্যান্য
১৯৭১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে আরএসএসে যোগ দেন মোদি। কিছুদিন পরই সংগঠনটির দিল্লির কার্যালয়ে যান তিনি। সেখানে তাঁর অনেকগুলো কাজের মধ্যে ছিল ভোর চারটায় ঘুম থেকে ওঠা, নাশতার জন্য চা তৈরি এবং কোনো কোনো সময় জ্যেষ্ঠ সতীর্থদের জন্য হালকা নাশতা তৈরি। ওই সময় আরএসএসে আসা বিভিন্ন চিঠির উত্তরও দিতেন তিনি। বাসন-কোসন মাজা, ঝাড়ু দেওয়া ছাড়াও সমগ্র ভবন পরিষ্কার করতেন মোদি। এর পাশাপাশি নিজের পোশাক-আশাকও তাঁকেই ধুতে হতো।

রাজনৈতিক জীবনের সূচনালগ্ন এবং অতঃপর
ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থা করার জারির পর রাজনৈতিক বিরোধীদের জেলে ভরতে থাকেন। সে সময় দিল্লি থেকে গুজরাটে ফেরেন মোদি। একটি স্কুটারে চড়ে গুজরাটের এখানে-সেখানে যান তিনি। মাঝে মাঝে আবার লাপাত্তাও হয়ে যেতেন। তবে সুযোগ পেলেই ইন্দিরা সরকারের বিরুদ্ধে প্রচার করতেন বিভিন্ন পুস্তিকা।
রাজনীতিতে জড়ানোর পরও দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক সম্পন্ন করেন মোদি। পরে গুজরাট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি।
কঠোর পরিশ্রম ও দক্ষতার জন্য বড়দের কাছ থেকে প্রশংসা কুড়ান মোদি। ১৯৮৭-৮৮ সময়ে তিনি বিজেপির গুজরাট ইউনিটের সাংগঠনিক সম্পাদক মনোনীত হন। মূলত, এর মধ্য দিয়েই মূলধারার রাজনীতিতে প্রবেশ করেন তিনি।
দলীয় কর্মীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের জেরে ধীরে ধীরে বিজেপিতে নিজের অবস্থান পোক্ত করেন মোদি। ১৯৯০ সালে তিনি আদভানির নেতৃত্বে সোমনাথ থেকে অযোধ্যা পর্যন্ত রথযাত্রায় বড় ভূমিকায় ছিলেন।
১৯৯১ সালে তত্কালীন দলীয় প্রধান মুরলি মনোহর যোশির নেতৃত্বে কন্যাকুমারী-শ্রীনগর একতা যাত্রারও অন্যতম সংগঠক ছিলেন মোদি।
১৯৯২ সালে গুজরাট বিজেপিতে কিছুটা একঘরে হয়ে পড়েন মোদি। কেশুবাই প্যাটেল, শংকরসিংহ বাঘেলা কিংবা কাশীরাম রানার মতো নেতারা মোদির উত্থানে ক্ষুব্ধ হন। এ সময়ে জ্যেষ্ঠদের ডিঙিয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির অভিযোগও ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। এমনকি তাঁর বিরুদ্ধে সাবেক মুখ্যমন্ত্রী কেশুবাই প্যাটেলের সঙ্গে বিশ্বস্ততা ভঙ্গের অভিযোগ ওঠে।
২০০২ সালের হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার সময়টা ছিল মোদির উত্থানের সবচেয়ে বড় অনুঘটক। সে সময়ে হিন্দু দাঙ্গাবাজদের উসকে দিয়ে তিন হাজার মুসলমানকে হত্যা ষড়যন্ত্রে মোদিকে জড়িয়ে অভিযোগ থাকলেও তাঁকে বাঁচিয়ে দেন আদভানি। তবু বিভিন্ন মহল থেকে মোদির পদত্যাগের দাবি ওঠে। কিন্তু ২০০২ সালে গুজরাটের নির্বাচনে মোদির জয় তাঁকে আবারও আলোচনায় আনে। মোদির রাজনৈতিক জীবনের মোড় ঘোরে তখন থেকেই।
বর্তমানে সেই মোদিই উন্নয়ন ও সুশাসনে দলীয় সামর্থ্যের প্রতীক বনেছেন। বিপুল মধ্যবিত্ত তাঁকে সমর্থন জোগাচ্ছে। তাঁর ‘আমিও পারি’ নীতি অনেকের মধ্যেই আশার সঞ্চার করেছে। আর এরই ফল হিসেবে এক দশক ক্ষমতার বাইরে থাকা বিজেপি তাঁকে প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য মনোনয়ন দিয়েছে। হয়তো মোদির ওপর ভর করেই ভারত শাসনের স্বপ্ন দেখছে দলটি।---ডিনিউজ

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়