Tuesday, October 22

সমুদ্রের বুকে পথপ্রদর্শক আলোকসজ্জার ঘর

শাহিদা আফরিন মিথিলা  ::

বাতিঘর নামটি শুনেই বোঝা যাচ্ছে যে একটি ঘরের কথা বলা হচ্ছে যেখানে বাতি জ্বলে। এটি লাইট হাউজ নামেও পরিচিত। বাতিঘর বা লাইট হাউজ হচ্ছে এক ধরনের সুউচ্চ মিনার আকৃতির দালান যেখান থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় আলো ফেলে সমুদ্রে নাবিকদের দিক নির্দেশনা দেয়া হয়। সমুদ্রের অগভীর অঞ্চল সম্পর্কে নাবিককে সতর্ক করতে বাতিঘর ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও সমুদ্র সৈকতের যেসব এলাকায় বেশি প্রবাল রয়েছে এবং যেসব প্রবালগঠন জাহাজের ক্ষতিসাধন করতে পারে এমন সব জায়গা চিহ্নিত করতেই বাতিঘর ব্যবহৃত হয়। বহুযুগ ধরে এই বাতিঘর সমুদ্রে নাবিকদের পথ চলতে সহায়তা করে আসছে। 

প্রাচীনকালের বাতিঘর
প্রাচীনকালে মানুষ সমুদ্রের অগভীর সৈকত আর প্রবাহ সৈকত চিহ্নিত করতে পাহাড়ের ওপরে আগুনের কুন্ডলি জ্বালিয়ে রাখতো। পরবর্তীতে কাঠ জ্বালিয়ে দূর সমুদ্রের নাবিককে সতর্কবার্তা দেয়া হত।
একপর্যায়ে মানুষ বাতিঘর বানানোর ব্যাপারে চিন্তা করে এবং বানায়। পৃথিবীর সবথেকে বিখ্যাত ঐতিহাসিক লাইট হাউজ বা বাতিঘর হচ্ছে আলেকজান্দ্রিয়ার বাতিঘর। 
আলেকজান্দিয়ার বাতিঘর খ্রিষ্টপূর্ব ৩য় শতাব্দীতে মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ায় তৈরি করা হয়। ধারণা করা হয় এটি সম্রাট আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর টলেমীয় রাজবংশের সময়ে নির্মাণ করা হয়েছে। প্রথমে বন্দরের পরিচিতি চিহ্ন হিসেবে তৈরি করা হলেও পরবর্তীতে এটি বাতিঘর হিসেবে কাজ করে। 

বাতিঘরটির মূল ভিত্তিভূমির আয়তন ছিল ১১০ বর্গফুট উচ্চতা ৪৫০ ফুট। নির্মাণের পর প্রায় শত বর্ষ ধরে এটি পৃথিবীর অন্যতম উঁচু দালান হিসেবে পরিচিত ছিল। এটি হালিকারনেসাসের মুসলিয়ম এবং গিজার মহাপিরামিডের পর তৃতীয় মানব নির্মিত প্রাচীন কোনো দালান যা পৃথিবীর বুকে টিকে ছিল। এই বাতিঘরটি প্রাচীন পৃথিবীর অন্যতম সপ্তাশ্চর্য। ৯৫৬ থেকে ১৩২৩ খ্রিষ্টাব্দে যে কয়টি ভূমিকম্প হয়েছিল তাতে এটি ভেঙে পড়ে। ভেঙে যাওয়ার পরে এর ইট দিয়ে সিটাডেল অব কোয়েটবি দূর্গ নির্মাণ করা হয়েছিল। ১৯৯৪ সালে একজন ফরাসী নৃ-বিজ্ঞানী আলেকজান্দ্রিয়ায় যে জায়গায় এটি নির্মাণ করা হয়েছিল সেখানকার সমুদ্রের নিচে এর কিছু অংশ খুঁজে পান। 
প্রাচীনকালে নির্মিত বেশ কিছু বাতিঘর এখনো পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তার মধ্যে ‘টাওয়ার অব হারকিউলিস’ এবং রোমানদের সময়ে নির্মিত ইংল্যান্ডের কেন্টে অবস্থিত ডোবার দুর্গের রোমান লাইট হাউজ অন্যতম।
আধুনিক বাতিঘর
বাতিঘরের আধুনিকায়ন শুরু হয় মূলত ১৮শ’ শতাব্দী থেকে। তবে ১৬শ’ শতাব্দীর দিকে ইংল্যান্ডের 'Eddystone Rocks' লাইট হাউজ ছিল খোলা সমুদ্রের প্রথম বাতিঘর। এটি প্রথমে কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল।পরবর্তীতে এটি ভেঙে গেলে এর পুনর্নির্মাণ করা হয়। 
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক 'Lighthouse Directory' এর তথ্যমতে,বর্তমানে পৃথিবীতে ১৯ হাজার ৫০০টি বাতিঘর রয়েছে।
বাংলাদেশের মোট সাতটি বাতিঘর আছে। 
কুতুবদিয়া বাতিঘর
প্রাচীনকাল থেকে চট্টগ্রাম একটি সমুদ্রবন্দর। খ্রিষ্টীয় নয় শতক থেকে আরবের বণিকরা চট্টগ্রামের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে। সেকালে সামুদ্রিক জাহাজে উন্নত প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি ছিল না। অভিজ্ঞ নাবিকরা প্রাচীন প্রচলিত পদ্ধতিতে সাগর মহাসাগর পাড়ি দিতেন। ১৮২২ সালে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছাস উপকূলভাগ বিধ্বস্ত করে দেয়। বিস্তীর্ণ এলাকায় নতুন নতুন চর জেগে ওঠার ফলে চট্টগ্রাম বন্দরে দেশি-বিদেশি জাহাজ চলাচলে সমস্যা দেখা যায়। জাহাজ নির্বিঘ্নে চলাচল করার সুবিধার্থে ব্রিটিশ সরকার বাতিঘর স্থাপনের জন্য জরিপ চালায়। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ২৫ মাইল দক্ষিণে তিনদিকে বঙ্গোপসাগর পরিবেষ্টিত কুতুবদিয়ায় একটি সুউচ্চ বাতিঘর স্থাপন করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। কুতুবদিয়া বাতিঘর বাংলাদেশে সর্বপ্রাচীন বাতিঘর। 

বাতিঘরটির নির্মাণকাল ১৮৪৬ সাল এবং ঘূর্ণায়মান বাতি স্থাপিত হয় ১৮৯২ সালে। বাতিঘরটির বিচ্ছুরিত আলো ২৫-৩৫ কিলোমিটার গভীর সমুদ্র থেকে দেখা যায়। পাথরের ভিতের ওপর নির্মিত কুতুবদিয়া বাতিঘরটির উচ্চতা প্রায় ৪০ মিটার। এর ছয়টি কামড়ায় পাটাতন ও সিঁড়ি কাঠের তৈরি। সর্বোচ্চ কামড়ায় আট ফিতার ল্যাম্প বসানো হয়েছিল। ল্যাম্পের জ্বালানি হিসেবে ব্যাবহৃত হত নারিকেল তেল। বাতিঘরটির নিচতলা ছিল মাটির নিচে এবং এর দেয়াল ছিল খুবই পুরু। এই বাতিঘর নির্মাণ করতে তৎকালীন ৪ হাজার ৪২৮ টাকা ব্যয় হয়েছিল। আট তলা বাতিঘরটির প্রতি তলায় উচ্চতা ছিল পাঁচ মিটার। প্রতি কক্ষে ছিল কাঁচের জানালা। সর্বোচ্চ কক্ষে বাতি জ্বালানো হত। একটি কাঠের ফ্রেমে রাখা বাতিটি প্রতিদিন সূর্যাস্তের আগে জ্বালানো হত। ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন হেয়ারের তত্ত্বাবধায়নে ও ইঞ্জিনিয়ার জে এইচ টুগুডের নির্দেশনায় কুতুবদিয়ার বাতিঘরটি নির্মিত হয়। 
সেন্টমার্টিন বাতিঘর
এই বাতিঘরের প্রতি ১৫ সেকেন্ডে বিচ্ছুরিত আলো ১৭ মাইল পর্যন্ত দেখা যায়। 

কক্সবাজার বাতিঘর
এই বাতিঘরের প্রতি ১৫ সেকেন্ডে বিচ্ছুরিত আলো ২১,৫ মাইল পর্যন্ত দেখা যায়।

নরম্যানস পয়েন্ট বাতিঘর
এই বাতিঘরের প্রতি ১৫ সেকেন্ডে বিচ্ছুরিত আলো ১১ মাইল পর্যন্ত দেখা যায়।
 
পতেঙ্গা বাতিঘর
এই বাতিঘরের প্রতি ১৫ সেকেন্ডে বিচ্ছুরিত সবুজ আলো ১৫ মাইল পর্যন্ত দেখা যায়।

হিরোন পয়েন্ট বাতিঘর
চিটাগাং আউটার বার রেঞ্জ রেয়ার বাতিঘর 

পৃথিবীর অন্যতম কয়েকটি বাতিঘর 
টুরলিটিস বাতিঘর, গ্রীস
গ্রীসের দৃষ্টিনন্দন এই বাতিঘরটি ১৮৮৭ ( কোথাও কোথাও ১৮৯৭ সাল উল্লেখ আছে) সালে তৈরি করা হয়েছিল। এটি তৈরি করা হয়েছে সহস্র বছরের প্রাকৃতিক উপায়ে ক্ষয়প্রাপ্ত একটি পাথর স্তম্ভের ওপর। সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে সাত মিটার ওপরে এর উচ্চতা প্রায় ৩৬ মিটার।
পোর্টল্যান্ড হেড লাইট, যুক্তরাষ্ট্র
ভূমি থেকে ৮০ ফুট ওপরে অবস্থিত এই বাতিঘরটি যুক্তরাষ্ট্রের শত পোতাশ্রয়ের স্টেট হিসেবে পরিচিত মেইনের কেপ এলিজাবেথ শহরে অবস্থিত। প্রায় সোয়া দুইশ বছরের পুরাতন এই বাতিঘরটিতে সর্বপ্রথম ১৭৯১ সালের ১০ জানুয়ারি আলো জ্বালানো হয়। মেইন স্টেটের সবচেয়ে পুরোনো প্রায় ৭২ ফুট উচ্চতার এই বাতিঘরটিতে ১৬টি বাতি ছিল যেগুলো তিমি মাছের তেল দিয়ে জ্বালানো হত। ১৮৬৫ সালের দিকে এর উচ্চতা আরো ২০ ফুট বাড়ানো হয়। বাতিঘরটির পাশে একটি জাদুঘর আছে যেখানে শতাব্দী পুরোনো এই স্থাপনাটির জিনিসপত্র স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে রাখা হয়। 
টাওয়ার অব হারকিউলিস, স্পেন
প্রাচীন রোমান সভ্যতার সবচেয়ে প্রাচীন এবং কার্যকর বাতিঘর। প্রথম শতকের শেষভাগে স্পেনের লা করুনিয়া পোতাশ্রয়ের প্রবেশমুখে অবস্থিত ৩৪ মিটার উচ্চতার এই বাতিঘরটি রোমানদের কাছে ব্রিগানশিয়া বাতিঘর নামে পরিচিত ছিল। আঠারো শতকের স্থপতি ইউস্তাকিও জিয়ান্নিনি ৫৭ মিটার উঁচু পাথরের ওপর নির্মিত হাজার বছরের পুরোনো এই রোমান স্থাপনার ওপরে আরো ২১ মিটার যোগ করেন। ২০০৯ সালের ২৭ জুন বাতিঘরটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের মর্যাদা পায়। বাতিঘরটিকে ঘিরে অনেক উপকথা, রূপকথা প্রচলিত আছে। অনেকে বলে, গ্রীক দেবতা জিউসের পুত্র হারকিউলিস তিন দিন ও তিন রাত যুদ্ধের পর অত্যাচারী গেরিয়নকে হত্যা করে। এরপর অস্ত্রসহ তাকে বাতিঘরের স্থানটিতে পুঁতে রাখে।পরবর্তীতে সেখানেই বাতিঘর নির্মাণ করা হয়। 
পিজিয়ন পয়েন্ট বাতিঘর, যুক্তরাষ্ট্র
সান ফ্রান্সিস্কোর ৫০ মাইল দক্ষিণে এক অসাধারণ নিসর্গে অবস্থিত পিজিয়ন পয়েন্ট বাতিঘর। ১৮৭২ সালের ১৫ নভেম্বর সূর্যাস্তে আলো জ্বালিয়ে শুরু হওয়া পিজিয়ন পয়েন্টের  যাত্রা এখন পর্যন্ত চলছে। ১১৫ ফুট লম্বা এই বাতিঘরটিতে শুকরের তেল দিয়ে বাতি জ্বালানো হত সঙ্গে ব্যবহৃত হত ফার্স্ট-অর্ডার ফ্রেসনেল লেন্স। পরবর্তীতে ১৮৮৮ সাল থেকে শুকরের তেলের পরিবর্তে কেরোসিন তেল ব্যবহার করা শুরু হয়। এই বাতিঘরটির আলোর রেঞ্জ প্রায় ৪৪ কিলোমিটার। ১৯৮০ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার হিস্টোরিক্যাল ল্যান্ডমার্ক হিসেবে এই পিজিয়ন পয়েন্ট বাতিঘরকে উল্লেখ করা হয়।
হুকহেড বাতিঘর, আয়ারল্যান্ড
আয়ারল্যান্ডের ওয়েক্সফোর্ড কাউন্টির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে অবস্থিত হুকহেড বাতিঘরটি পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন একটি বাতিঘর। অনেকের মতে, পঞ্চম শতকে ডুবহান নামের এক সন্ন্যাসী প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার এই উপদ্বীপে একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানকার সন্ন্যাসীরা এই আশ্রমে রাতের বেলা আগুন জ্বালিয়ে সমুদ্রে চলাচলকারী নাবিকদের তীরের কঠিন পাথরের উপস্থিতির ব্যাপারে সতর্ক করে দিতেন। এরপর ১২০৭ সালের দিকে লর্ড অব লেইন্সটার উইলিয়াম মার্শাল বর্তমানের হুকহেড বাতিঘর নির্মাণের নির্দেশ দেন। মূলত এই বাতিঘরটি রাতের বেলা ব্যারো নদীর তীরে অবস্থিত নিউ রস শহরের নৌ-বন্দরে আসা জাহাজগুলোকে আলো দেখানোর উদ্দেশ্যে নির্মাণ করা হয়। প্রায় ৮০০ বছর পুরোনো এই বাতিঘরটি নির্মাণের পর থেকে সতেরো শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত সেখানে বসবাসকারী সন্ন্যাসীরাই দেখাশোনা করতো। ২০১১ সালের জুন মাসে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ট্রাভেল গাইড বুক হিসেবে বিখ্যাত লোনলি প্লানেট  ৩৬ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট এই বাতিঘরটিকে ‘দ্যা গ্রেট গ্রান্ডড্যাডি অব লাইটহাউজ’ হিসেবে উল্লেখ করেছে।
গিবস হিল বাতিঘর, বারমুডা
ঢালাই লোহার তৈরি পৃথিবীর সর্বপ্রথম এই বাতিঘরের উপর থেকে বারমুডার পুরো দ্বীপটির উপর চোখ বুলিয়ে নেয়া যাবে। ১৮৪৬ সাল থেকে পথনির্দেশক আলো বিচ্ছুরিত করে যাওয়া সাউদাম্পটন প্যারিশের এই বাতিঘরটির উচ্চতা ১১৭ ফুট এবং এর  ১৮৫টি সর্পিলাকার সিঁড়ি আছে।গিবস হিলের শক্তিশালী আলোকচ্ছটা সমুদ্রের প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূর থেকেও দেখা যায়। আকাশ দিয়ে উড়ে যাওয়া বিমান প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূর থেকেও দেখতে পায় এর আলোর রেখা। গিবস হিলের বাতিঘর আগে কেরোসিন নির্ভর ছিল। বর্তমানে ২.৭৫ টন ভরের ১, ০০০ ওয়াটের বাল্ব দিয়ে আলো সরবরাহ করা হয়। ব্রিটিশ রাজসিংহাসনে আরোহণের পর ১৯৫৩ সালের ২৪ নভেম্বর রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ এই বাতিঘরটি পরিদর্শন করতে যান। রানীর মুগ্ধতাকে একটি স্মারকে লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়েছে।
বাতিঘরের নির্মাতারা
পৃথিবীর অন্যতম কয়েকজন বাতিঘর নির্মাতার মধ্যে জন স্মেটন এর প্রায় সকলের কাছে পরিচিত। তিনি এডিস্টন রকস ( Eddystone Rocks) লাইট হাউজের তৃতীয় সংস্করণের নির্মাতা। এছাড়া আরো অনেকে একাধিক লাইট নির্মাণের জন্য বিখ্যাত। তার মধ্যে রবার্ট, এলেন, ডেভিড, থমাস, ডেভিড এলেন, চার্লস একই পরিবারের সদস্য ছিলেন যারা বংশানুক্রমে বাতিঘর নির্মাতা ছিলেন।
 সূত্র: ডেইলি বাংলাদেশ

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়