Monday, July 29

সারা বিশ্বে একই সময়ে কী ঈদ করা সম্ভব?

প্রিয়ম হাসান  ::

চাঁদ পৃথিবীর একটি উপগ্রহ হলেও সব দেশের অধিবাসীরা একই সময়ে চাঁদ দেখতে পায় না। কোনো দেশ থেকে আগে, কোনো দেশ থেকে পরে দেখা যায়। জ্যোতির্বিদদের মতে, পশ্চিমে যে চাঁদ আগে দেখা যায়, পূর্বে দেখা তা পরে যায়।

ফলে চাঁদ দেখার ওপর নির্ভরশীল যেসব অনুষ্ঠান বা উৎসব (রোজা, ঈদ ইত্যাদি) তা কোথাও আগে বা কোথাও পরে শুরু হয়।

ইসলামের চাঁদ দেখার ওপর নির্ভরশীল অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিধানাবলী। রোজা, ঈদ, কোরবানীসহ হজের মত ইসলামের মৌলিক বিষয়াবলী। সুতরাং চাঁদ দেখার ক্ষেত্রে পরিস্কার ধারণা না থাকলে এই সকল বিষয়ে সমস্যা হতে বাধ্য। 
সুতরাং প্রতিটি মুসলমানের এ বিষয়ে পরিচ্ছন্ন জ্ঞান থাকা আবশ্যক। ইসলাম একটি সার্বজনীন ধর্ম। গোটা পৃথিবীর সকল অঞ্চলের বিগত-আগত ও অনাগত সকল মানুষের জন্য কার্যকরী ‘স্রষ্টা’ কর্তৃক নির্ধারিত একটি জীবন ব্যবস্থা।
ইসলাম কোনো ভৌগলিক সীমারেখায় সীমাবদ্ধ ধর্ম নয়, ইসলাম ধর্মকে সার্বজনীন আখ্যা দিয়ে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে,   

وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا كَافَّةً لِّلنَّاسِ بَشِيرًا وَنَذِيرًا وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ

অর্থাৎ: ‘আমি (আল্লাহ তায়ালা) তোমাকে (রাসূল (সা.)) সকল মানুষের জন্য সুসংবাদ দাতা ও ভীতি প্রদর্শনকারীরূপে প্রেরণ করেছি, যদিও অধিকাংশ লোক তা জানে না।’ (সূরা: সাবা, আয়াত: ২৮)। 

অন্য আয়াতে স্পষ্ট ঘোষণা হয়েছে,

إِنَّ الدِّينَ عِندَ اللّهِ الإِسْلاَمُ وَمَا اخْتَلَفَ الَّذِينَ أُوْتُواْ الْكِتَابَ إِلاَّ مِن بَعْدِ مَا جَاءهُمُ الْعِلْمُ بَغْيًا بَيْنَهُمْ وَمَن يَكْفُرْ بِآيَاتِ اللّهِ فَإِنَّ اللّهِ سَرِيعُ الْحِسَابِ

অর্থাৎ: ‘নিঃসন্দেহে আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য দ্বীন একমাত্র ইসলাম। এবং যাদের প্রতি কিতাব দেয়া হয়েছে তাদের নিকট প্রকৃত জ্ঞান আসার পরও ওরা মতবিরোধে লিপ্ত হয়েছে, শুধুমাত্র পরস্পর বিদ্বেষবশতঃ, যারা আল্লাহর নিদর্শনসমূহের প্রতি কুফরী করে তাদের জানা উচিত যে, নিশ্চিতরূপে আল্লাহ হিসাব গ্রহণে অত্যন্ত দ্রুত।’ (সূরা: আলে-ইমরান, আয়াত: ১৯)।

যেমন পবিত্র কোরআনে আরো ইরশাদ হচ্ছে,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ ادْخُلُواْ فِي السِّلْمِ كَآفَّةً وَلاَ تَتَّبِعُواْ خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُّبِينٌ

অর্থাৎ: ‘হে ঈমানদার গন! তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও এবং শয়তানের পদাংক অনুসরণ কর না। নিশ্চিত রূপে সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।’ (সূরা: বাকারা, আয়াত:২০৮)।

উল্লেখিত আয়াতে কারীমার মাধ্যমে বুঝা যাচ্ছে, সকল মানুষের জন্য আল্লাহ তায়ালার মনোনিত দ্বীন হলো ইসলাম, আর রাসূল (সা.)-কে সকল মানুষের জন্য পথ প্রদর্শক হিসেবে পাঠানো হয়েছে, কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলের জন্য বা নির্দিষ্ট মানুষের জন্য নয়। তাই স্বাভাবিকভাবেই এর বিধানাবলী ও সার্বজনীন হবে, কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চল বা নির্দিষ্ট মানুষের নির্ধারিত সময় ভিত্তিক হবে না এটাই যৌক্তিক। আর একারণেই ইসলামী শরীয়তের সকল বিধান আমভাবে বর্ণিত হয়েছে। সময়ের সীমা নির্ধারিত করে দিয়েছে, কিন্তু প্রচলিত নির্ধারিত সময় নির্ধারিত করে দেয়নি, কিংবা কোনো অঞ্চলের সময়ের অনুস্বরণ করার কথাও কোরআন ও হাদিসের কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। সময়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল বিধানের প্রতি আমরা দৃষ্টি বুলালেই এর বাস্তবতা আমাদের চোখে ধরা পড়বে। যেমন-আল্লাহ তায়ালা রোজা রাখার বিধানে সময়ের সীমা নির্ধারণ করে দিয়ে ইরশাদ করেন-

أُحِلَّ لَكُمْ لَيْلَةَ الصِّيَامِ الرَّفَثُ إِلَى نِسَآئِكُمْ هُنَّ لِبَاسٌ لَّكُمْ وَأَنتُمْ لِبَاسٌ لَّهُنَّ عَلِمَ اللّهُ أَنَّكُمْ كُنتُمْ تَخْتانُونَ أَنفُسَكُمْ فَتَابَ عَلَيْكُمْ وَعَفَا عَنكُمْ فَالآنَ بَاشِرُوهُنَّ وَابْتَغُواْ مَا كَتَبَ اللّهُ لَكُمْ وَكُلُواْ وَاشْرَبُواْ حَتَّى يَتَبَيَّنَ لَكُمُ الْخَيْطُ الأَبْيَضُ مِنَ الْخَيْطِ الأَسْوَدِ مِنَ الْفَجْرِ ثُمَّ أَتِمُّواْ الصِّيَامَ إِلَى الَّليْلِ وَلاَ تُبَاشِرُوهُنَّ وَأَنتُمْ عَاكِفُونَ فِي الْمَسَاجِدِ تِلْكَ حُدُودُ اللّهِ فَلاَ تَقْرَبُوهَا كَذَلِكَ يُبَيِّنُ اللّهُ آيَاتِهِ لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمْ يَتَّقُونَ

অর্থাৎ: ‘রোজার রাতে তোমাদের স্ত্রীদের সঙ্গে সহবাস করা তোমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে। তারা তোমাদের পরিচ্ছদ এবং তোমরা তাদের পরিচ্ছদ। আল্লাহ অবগত রয়েছেন যে, তোমরা আত্নপ্রতারণা করছিলে, সুতরাং তিনি তোমাদেরকে ক্ষমা করেছেন এবং তোমাদের অব্যাহতি দিয়েছেন। অতঃপর তোমরা নিজেদের স্ত্রীদের সঙ্গে সহবাস কর এবং যা কিছু তোমাদের জন্য আল্লাহ দান করেছেন, তা আহরন কর। আর পানাহার কর যতক্ষণ না কালো রেখা থেকে ভোরের শুভ্র রেখা পরিষ্কার দেখা যায়। অতঃপর রোজা পূর্ণ কর রাত পর্যন্ত। আর যতক্ষণ তোমরা এতেকাফ অবস্থায় মসজিদে অবস্থান কর, ততক্ষণ পর্যন্ত স্ত্রীদের সঙ্গে মিশো না। এই হলো আল্লাহ কর্তৃক বেঁধে দেয়া সীমানা। অতএব, এর কাছেও যেও না। এমনিভাবে বর্ণনা করেন আল্লাহ নিজের আয়াতসমূহ মানুষের জন্য, যাতে তারা বাঁচতে পারে।’ (সূরা: বাকারা, আয়াত: ১৮৭)। 

গোটা পৃথিবীর সকল মানুষের জন্য একই বিধান। এখন প্রশ্ন হলো-আল্লাহ তায়ালার এই বিধান পৃথিবীর সব মানুষ একই সময়ে আদায় করতে সক্ষম হবে? অবশ্যই না, কারণ পৃথিবীর সকল স্থানে এক সময়ে সুবহে সাদিক ও সূর্যাস্ত যাওয়া অসম্ভব, তাই এক সময়ে এ বিধান সবার আদায় করা সম্ভব নয়, কিন্তু একই গুন সম্পন্ন সীমায় এই বিধান পৃথিবীর সকল মুসলমানের জন্য পালন করা সম্ভব। কারণ পৃথিবীর সকল স্থানেই সুবহে সাদিক যেমন আসে, ঠিক সূর্যাস্ত ও যায়, যদিও এক সময়ে নয়। সুতরাং পৃথিবীর সব মুসলমান রোজা রাখার বিধান আল্লাহ তায়ালার বেঁধে দেয়া গুন বিশিষ্ট (সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও সহবাস থেকে বিরত থাকা) সীমার মধ্যে আদায় করতে কোনো অসুবিধা নেই। যদিও এক সময়ে আদায় করা সম্ভব নয়, কারণ পৃথিবীর এক স্থানে যখন সূর্য উঠে অন্য স্থানে তখন অস্ত যায়, বা এক স্থানে যখন দুপুর অন্য স্থানে তখন বিকেল বা রাত। এমনিভাবে নামাজের সময়ের ক্ষেত্রে ও একই পদ্ধতী প্রযোজ্য। অর্থাৎ কোরআন ও হাদিসে আমল আদায়ের যেই গুন বিশিষ্ট সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে তা যে এলাকায় পাওয়া যাবে, সে এলাকার বাসিন্দাদের ওপর সেই আমল তখন আদায় করা আবশ্যক। যে এলাকায় সেই গুন বিশিষ্ট সীমা আসেনি তাদের ওপর আবশ্যক নয়, কারণ তাহলে আল্লাহ তায়ালা আদেশ মানা হবে না বরং তা মনের পূজা বা যেই এলাকার সময় হিসেবে ইবাদাত আদায় করা হচ্ছে সেই এলাকা পূজা ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না।
চাঁদ দেখার ক্ষেত্রে শরয়ী দৃষ্টিকোণ-
মহান রাব্বুল আলামিন পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেন,

هُوَ الَّذِي جَعَلَ الشَّمْسَ ضِيَاء وَالْقَمَرَ نُورًا وَقَدَّرَهُ مَنَازِلَ لِتَعْلَمُواْ عَدَدَ السِّنِينَ وَالْحِسَابَ مَا خَلَقَ اللّهُ ذَلِكَ إِلاَّ بِالْحَقِّ يُفَصِّلُ الآيَاتِ لِقَوْمٍ يَعْلَمُونَ

অর্থাৎ: ‘তিনিই সে মহান সত্তা, যিনি বানিয়েছেন সুর্যকে উজ্জ্বল আলোকময়, আর চন্দ্রকে স্নিগ্ধ আলো বিতরণকারীরূপে এবং অতঃপর নির্ধারিত করেছেন এর জন্য মনযিল সমূহ, যাতে করে তোমরা চিনতে পার বছরগুলোর সংখ্যা ও হিসাব। আল্লাহ এই সমস্ত কিছু এমনিতেই সৃষ্টি করেননি, কিন্তু যথার্থতার সঙ্গে। তিনি প্রকাশ করেন লক্ষণসমূহ সে সমস্ত লোকের জন্য যাদের জ্ঞান আছে।’ (সুরা ইউনুস, আয়াত-৫)।

মুফাসসিরীনে কিরাম উক্ত আয়াতের তাফসীর করতে গিয়ে বলেন-মহান রাব্বুল আলামীন সুর্য দ্বারা দিনের সময় আর চন্দ্র দ্বারা মাস ও বছরের হিসেব নির্ধারণ করেছেন।
উক্ত আয়াত ও তার তাফসীর দ্বারা একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, কোনো মাস শেষ হয়েছে কী না? তা নির্ধারিত হবে চন্দ্রের দ্বারা। অর্থাৎ চাঁদের উদয় ও অস্ত দেখে নিরূপিত হবে মাস শুরু হয়েছে ও শেষ হয়েছে কী না? আর এদিকেই ইংগিত করে আল্লাহর নবী (সা.) বলেন,
(১) হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আল্লাহর নবী (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা (চাঁদ) দেখে রোজা রাখ ও (চাঁদ) দেখে রোজা ভাঙ্গো।’(বুখারী শরীফ-২/৬৭৪)।
(২) নবী (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা (চাঁদ) দেখে রোজা রাখ ও (চাঁদ) দেখে রোজা ভাঙ্গো, আর যদি তোমাদের উপর আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকে তবে তোমরা ৩০ দিন পূর্ণ কর। ( মুসনাদে আহমাদ-১৬ /৯১)।
উক্ত হাদিসে নববীতে আল্লাহর নবী (সা.) আমাদের মূলনীতি নির্ধারিত করে দিলেন যে চাঁদ দেখা গেলে বুঝা যাবে মাস শেষ, নতুন মাস শুরু হয়েছে। তাই রমজানের চাঁদ দেখা গেলে রোজা রাখবে আর শাওয়ালের চাঁদ দেখা গেলে রোজা ভেঙ্গে ফেলবে। আর দ্বিতীয় হাদিসটির দ্বারা বুঝা গেল ২৯ তারিখ চাঁদ দেখা না গেলে ৩০ দিন পূর্ণ হলে মাস শেষ হয়েছে বলে ধর্তব্য হবে। এর কোনো ব্যত্যয় গ্রহণযোগ্য নয়।
সুতরাং যে এলাকায় রোজা বা ঈদের চাঁদ দেখা যাবে সেই এলাকা ও তার পাশের এলাকা যার উদয়াচল এক (তথা উক্ত এলাকার সঙ্গে সময়ের এত পার্থক্য নয় যে, সেখানে কখনো এ এলাকার মাসের হিসেবে কখনো ২৮ বা ৩১ তারিখ হয়ে যায়)তাদের জন্যই কেবল রোজা ও ঈদ আবশ্যক হবে। উদায়াচল ভিন্ন অন্য এলাকার জন্য উক্ত চাঁদ দেখার দ্বারা শরয়ী হুকুমের ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব পড়বে না।
اختلاف مطالع তথা উদায়াচলের ভিন্নতা:
উদায়াচলের ভিন্নতা বলা হয় সুর্যাস্ত ও সুর্যোদয়ের সময়ের ভিন্নতার কারণে এক এলাকা থেকে অন্য এলাকার সময়ের মাঝে একদিন বা তারচে’ বেশি দিনের পার্থক্য হয়ে যাওয়া। অর্থাৎ এক এলাকায় যখন মাসের ৩০ বা ২৯ তারিখ হয়ে চাঁদ উঠছে তথা মাস শেষ হচ্ছে দূরবর্তী অন্য দেশে তখন মাসের ২৮ বা ৩১ দিন হয়ে যাচ্ছে। এরকম যদি কোনো দেশের সঙ্গে অন্য দেশের দূরত্ব হয়, বুঝা যাবে যে, এ দুই দেশের উদয়াচল ভিন্ন, এক নয়। সুতরাং এ দুই দেশের মাঝে এক দেশে চাঁদ উঠলে অন্য দেশেও চাঁদ উঠেছে বলে শরয়ী বিধান কার্যকর হবে না।
যেমন সৌদি আরবের সঙ্গে বাংলাদেশের উদায়াচলের পার্থক্য আছে, অর্থাৎ সৌদির মাস আমাদের একদিন আগে বা পড়ে শেষ হয়, সুতরাং সে দেশে রোজা বা ঈদের চাঁদ উঠলে বাংলাদেশে রোজা বা ঈদ করা যাবে না। বরং বাংলাদেশ বা পার্শবর্তী দেশে যদি চাঁদ উঠে, যাদের সঙ্গে বাংলাদেশের উদায়াচলের পার্থক্য নেই (ভারত, পাকিস্তান, বার্মা ইত্যাদি ) তবে সে দেশের চাঁদ উঠার সংবাদ যদি আমাদের কাছে শরয়ী মানদন্ডে নির্ভরযোগ্য সুত্রে পৌঁছে, তবে আমাদের দেশের হেলাল কমিটি তা গ্রহণ করে সারা দেশে প্রচার করবে। ফিক্বহী কিতাবে উক্ত বক্তব্যের পক্ষে নিম্নের ইবারত পাওয়া যায়-
সারা পৃথিবীতে একই সময়ে ঈদ করার দাবী হাস্যকর:
পৃথিবীর ভৌগলিক অবস্থা সম্পর্কে যার সাধারণ জ্ঞান রয়েছে সে কখনো একথা বলতে পারে না যে, সারা পৃথিবীতে এক সময়ে ঈদ করা সম্ভব। কারণ আমরা জানি পৃথিবীতে রাত দিনের পার্থক্য কেন হয়? পৃথিবী সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘোরে, নিজ অক্ষের ওপর ও আবর্তিত হয়। পৃথিবী তার মেরু রেখার ওপর পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে ঘুরছে। পৃথিবী তার মেরু রেখার চারদিকে এভাবে ঘুরে আসতে প্রায় ২৪ ঘন্টা সময় লাগে। এ চব্বিশ ঘন্টাকে বলা হয় এক দিন। পৃথিবীর এ দৈনিক গতির নাম আহ্নিক গতি। এ আবর্তের সময় পৃথিবীর যে অংশ সূর্যের দিকে থাকে সে অংশে তখন দিন এবং অপর অংশে রাত হয়। আর একারণেই বাংলাদেশে যখন দিন তখন আমেরিকাতে রাত হয়। সুতরাং বাংলাদেশে চাঁদ উঠলে আমেরিকাতে ঈদ করতে হলে ঈদের জামাত গভীর রাতে করা ছাড়া কোনো পথ আছে কী? আর ঈদের নামাজ দিনের বেলা না পড়ে রাতে পড়ার বিধান আল্লাহ প্রদত্ব না নিজে বানানো? সৌদিতে বাংলাদেশে অফিস টাইম হয়েছে বলে যে সকল রাষ্ট্রে এখনো রাত বা অফিসের সময় হয়নি তাদের ও অফিসে যেতে হবে’ এ দাবী যেমন পাগলের প্রলাপ ছাড়া কিছুই নয়, ঠিক তেমনি সৌদিতে বা বাংলাদেশে আল্লাহ তায়ালার নির্দিষ্ট কোনো ইবাদতের সময় হয়েছে বলে তা যে রাষ্ট্রে এর সময় হয়নি তাদের ও তা ‘পালন করতে হবে’ বলার কথা মানসিকভাবে সুস্থ্য মানুষ বলতে পারে? সুতরাং শুধু আবেগ নয় বাস্তবতার নিরিখে চিন্তা করলে এ অদ্ভূত দাবীটি হাস্যকর ছাড়া অন্য কিছু বলে মনে হয় না।
একতার ভূয়া ধোঁয়া:
যারা পৃথিবীতে একই সময়ে ঈদ করার দাবী উত্থাপন করেন, তাদের একটি যুক্তি হলো, ইসলাম একতার ধর্ম, একতার মাঝেই প্রভূত কল্যাণ নিহিত। সকল মুসলমানরা এক সময়ে ঈদ বা অন্যান্য ধর্মীয় বিষয় একসঙ্গে পালন করলে মুসলমানদের মাঝে একতার বন্ধন দৃঢ় হবে, তাই এ হিসেবে হলেও আমাদের এক সময়ে ঈদ বা অন্যান্য ধর্মীয় কাজ করা উচিত, তাছাড়া সারা পৃথিবীতে এক ঈদের চাঁদ একবারই উঠে, একাধিকবার নয় সুতরাং এক অনুষ্ঠানের জন্য উদিত চাঁদ একবারের জন্য উঠে থাকলে সবার একসঙ্গেই অনুষ্ঠান পালন করা উচিত।
যারা এতো সুন্দর করে এ চটকদার যুক্তিটি পেশ করেন, তাদের কাছে আমার প্রশ্ন হলো, একতার অর্থ শুধু এক সময়ে কোনো কাজ করা? নাকি একই কাজ একই গুনে সবাই পালন করলেও একথার অর্থ থাকে? আপনারা কী বলতে চান-বাংলাদেশে মাগরীবের সময় হলেও সৌদিতে এখনো সময় হয়নি বলে আমরা ৪ ঘন্টা অপেক্ষা করব, আর আমেরিকার মুসলমানরা সকালবেলা পড়বে মাগরীবের নামাজ! একসঙ্গে নামাজ পড়ে একতা প্রতিষ্ঠার জন্য?
একটি কথা যদি ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করা হয় তবেই আমরা বুঝতে পারব যে, সারা পৃথিবীর মুসলমান একতাবদ্ধ হয়ে একই আমল করছে, ভিন্নভাবে নয়, এক কথায় সারা পৃথিবীর মুসলমানদের মাঝে ধর্মীয় বিষয় পালন করার ক্ষেত্রে চূড়ান্ত একতা রয়েছে। বিষয়টি আমরা একটি উদাহরণের মাধ্যমে বুঝতে পারি-আমরা জানি হাসনাহেনা আর রজনীগন্ধা ফুল কেবল রাতে ফুটে, সুতরাং একথা নির্ধারিত হলো যে, সারা পৃথিবীর রজনীগন্ধা আর হাসনাহেনা এক নির্ধারিত সময় তথা রাতে ফুটে দিনে নয়, এ হিসেবে তাদের মধ্যে একতা রয়েছে,সৌদিতে রাত বলে এ ফুল ফুটলো, কিন্তু আমেরিকায় দিন বলে এ ফুলটি সেখানে ফুটলোনা, এ ব্যপারে একথা কী বলা যাবে যে, আমেরিকায় হাসনাহেনা ফুল তাদের মূল গুন (রাতে ফুটার ক্ষেত্রে একতা) থেকে বিচ্যুত হয়েছে? নাকি তার অবস্থানস্থল দিন না হওয়ায় সে না ফুটে সে তার স্বমহিমায় একতাবদ্ধ রয়েছে বলা হবে? আশা করি বিজ্ঞ পাঠক সবাই একথা বলবে যে, ফুলটি আমেরিকায় দিনের বেলায় ফুটলে বরং সে তার আদর্শচ্যুত বা একতা ভঙ্গের দোষে দোষি হতো। আমেরিকায় ও একই গুনবাচক সময়ে এই ফুলটি ফুটবে, কিন্তু সৌদির সময় অনুস্বরণ করে নয় বরং তার নিজের এলাকার সময় অনুস্বরণ করে, আর তার একতার নিদর্শন এটাই।
ঠিক তেমনি আল্লাহ তায়ালার নবী (সা.) আদেশ দিয়েছেন ‘চাঁদ দেখে রোজা রাখতে আর চাঁদ দেখে রোজা ভাঙ্গতে’ নতুবা তোমরা ত্রিশ দিন পূর্ণ কর (মুসলিম শরীফ)। সুতরাং এই আদেশ সারা পৃথিবীর মুসলমানদের জন্য এক। সুতরাং যে এলাকায় চাঁদ দেখা যাবে, তারা রোজা রাখবে এবং ঈদ করবে, আর যে এলাকায় তা দেখা না যাবে,তারা তা পালন করবে না। যখন তারা চাঁদ দেখবে তখন তারা রোজা রাখবে ও ঈদ করবে। সেক্ষেত্রে সারা পৃথিবীর মুসলমানরা একই গুন বিশিষ্ট সময়ে আল্লাহর আদেশ পালন করে একতাবদ্ধ রইলো, অর্থাৎ সারা পৃথিবীর মুসলমানরা নবীর (সা.) আদেশ একই ভাবে একই গুন বিশিষ্ট সময়ে পালন করেছে, তাহলো চাঁদ দেখে রোজা রাখলো আর চাঁদ দেখে ঈদ করলো। পক্ষান্তরে এক দেশের চাঁদ দেখার ফলে অন্য দেশে চাঁদ না দেখেও রোজা বা ঈদ করলে তারা বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে। কারণ তখন বলা যাবে যে, কিছু মুসলমান চাঁদ উঠেছে তাই রোজা রাখলো কিছু মুসলমান তাদের দেশে চাঁদ উঠে নাই তারপরও রোজা বা ঈদ করলো। সুতরাং একতা রইলো কোথায়?
আরো সহজভাবে বললে বলা যায় যে, সূর্য উঠলে সবাই অফিসে যাবে, সুতরাং বাংলাদেশে যখন সূর্য উঠে তখন বাংলাদেশীরা অফিসে যায়, আমেরিকায় যখন সূর্য উঠবে তখন তারা অফিসে যাবে, অন্য দেশে যখন সূর্য উঠে তখন তারা অফিসে যায়, সুতরাং একথা কী বলা সঠিক নয় যে, সারা পৃথিবীর সবাই এক গুনবাচক সময়ে অফিসে যাবার ক্ষেত্রে এক। তাদের মধ্যে কোন মতভেদ নেই। নাকি আমেরিকায় রাতে আর বাংলাদেশে দিনের বেলায় অফিস একই সময়ে করলে বলা হবে যে তারা অফিসের সময়ের ক্ষেত্রে এক! নাকি ভিন্ন বলা হবে?
সারকথা:
সৌদি আরবের মত উদয়াচল ভিন্ন রাষ্ট্রের চাঁদ দেখার ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশেও রোজা ও ঈদ করার দাবী মৌলিকভাবে মুসলমানদের মাঝে বিশৃংখলা সৃষ্টির পায়তারা, তাছাড়া নিষিদ্ধ দিনে (রজবের ২৯ তারিখ) রোজা রাখতে হবে, আবার যে দিন রোজা রাখা ফরজ (রমজানের ৩০ তারিখ) সেদিন রোজা ভাঙ্গার গোনাহে পতিত হবার জন্য মুসলমানদের বিরুদ্ধে এক সুদূর প্রসারী ষড়যন্ত্র ছাড়া কিছুই নয়। তাই আমাদের সতর্ক থাকতে হবে, যেন কোনো মুখরোচক স্লোগানে প্ররোচিত হয়ে সুস্পষ্ট ফায়সালাকৃত দ্বীনি বিষয়ে অযথা সন্দিহান হয়ে ফেৎনায় না জড়িয়ে পড়ি। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। আল্লাহুম্মা আমিন।

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়