Sunday, June 23

আওয়ামী লীগের ৭০ বছর আজ

কানাইঘাট নিউজ ডেস্ক:
দেশের প্রাচীনতম সংগঠন আওয়ামী লীগের ৭০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন প্রতিষ্ঠার সময় সংগঠনটির নাম ছিল ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’। ৫৫ সালে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে ‘আওয়ামী লীগ’ নামকরণ করা হয়। আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম সভাপতি ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শামসুল হক। আর শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। ১৯৫৩ সালে দলটির সাধারণ সম্পাদক হন তিনি। ১৯৫৫ সালে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে সাম্প্রদায়িক খোলসমুক্ত হয় দলটি। ৭১-এ পা রাখা দলটির একাল-সেকাল নিয়ে দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা হয় দেশের কয়েকজন ইতিহাসবিদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীসহ বিশিষ্টজনের। তারা বলছেন, ২০১৪ সালে এসে আওয়ামী লীগ আদর্শের সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করে রাজনীতি করা শুরু করে; যার গোড়াপত্তন হয় ২০০৬ সালের ২৩ ডিসেম্বর। সেদিন আওয়ামী লীগের সঙ্গে পাঁচ দফা নির্বাচনী চুক্তি করেছিল বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস। চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন আওয়ামী লীগের পক্ষে তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল এবং খেলাফত মজলিসের পক্ষে মহাসচিব মাওলানা আব্দুর রব ইউসুফী।
দেশ রূপান্তরকে তারা বলেন, দীর্ঘ এই পথচলায় দলটির ঝুড়িতে ভূরি ভূরি অর্জন জমা হয়েছে; যার বেশিরভাগই এসেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে। যেমন ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, আইয়ুব খানের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন ও ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান। এভাবে ধীরে ধীরে বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে ’৭১-র মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতার লাল সূর্যও ছিনিয়ে আনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগই।
৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ শেষে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেন স্বাধীনতার মহানায়ক শেখ মুজিব। তবে মাত্র ১৩১৪ দিনের মাথায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে নিহত হন তিনি। এরপর ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত একরকম পঙ্গু অবস্থায় ছিল আওয়ামী লীগ। ১৯৮১ সালের ১৭ মে আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দেশে ফিরে আসেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। এ সময় তিনি সংগঠনকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেন। দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত ঘুরে বেড়ান। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নেতাকর্মীরাও আবারও নবউদ্যমে সংগঠিত হয়। শুরু হয় রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রাম। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে দলটি। ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনে সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে সেই পঙ্গুত্ব কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, আইয়ুবের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ও ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব দেয়। তারপর সাড়ে তিন বছর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ পরিচালিত হয়েছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভয়াবহ হত্যাকা- সংঘটিত হয়। আর আওয়ামী লীগ বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। এর ৬ বছর পর বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা নেতৃত্ব নেন। ফের এগিয়ে যেতে থাকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের আওয়ামী লীগ। ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পায় আওয়ামী লীগ। এরপর ২০০৯ থেকে টানা তৃতীয় মেয়াদ চলছে দলটির। এখনকার আওয়ামী লীগ উন্নয়নটাকে বড় করে দেখছে। আদর্শের সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করে চলছে। আওয়ামী লীগের হাত ধরে রাষ্ট্রের ৪ মূল নীতি ফিরে এলেও সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ঠিকই রেখে দেওয়া হয়, যা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের আওয়ামী লীগের সঙ্গে কোনোভাবেই মেলে না। তিনি বলেন, তবে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকারের উন্নয়ন প্রশংসীয়।
ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, আওয়ামী লীগের যাত্রা শুরু হয়েছিল পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল হিসেবে। ১৯৫৫ সালের ২২ অক্টোবর দলটি পরিপূর্ণ অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়। ১৯৬৬তে ছয় দফা আন্দোলনের পর বাঙালির কাছে গ্রহণযোগ্য ও জনপ্রিয় দলে পরিণত হয়। যার প্রমাণ ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন। এ দলের অন্যতম নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু নেতাই ছিলেন না, তিনি দ্বিতীয় ও তৃতীয় সারির অনেক নেতা তৈরি করেছেন। তাদের মধ্যে তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামারুজ্জামান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তারাই বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে মহান মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। তিনি বলেন, বাঙালি জাতির সব অর্জনেই আওয়ামী লীগ মুখ্য ভূমিকা পালন করে। দেশ গড়ার সূচনা হয় বঙ্গবন্ধুর হাতেই। এ ইতিহাসবিদ আরও বলেন, রাষ্ট্রক্ষমতার দায়িত্ব নেওয়ার ১৩১৪ দিনের মাথায় নিহত হন বঙ্গবন্ধু। এরপর ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বলা যায় আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে একরকম পঙ্গু ছিল। ১৯৯৬ সালে প্রদীপের আলোয় আসে দলটি। সর্বোপরি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ যেভাবে যাত্রা শুরু করেছিল এখন তাতে ঘাটতি রয়েছে। যেমন পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ আবার রাষ্ট্রের মূলভিত্তি চার মূলনীতি ফিরিয়ে নিয়ে আসে। কিন্তু রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানে রেখে সংবিধানকে স্ববিরোধী দলিলে পরিণত করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠনের যে প্রয়াস বঙ্গবন্ধুর ছিল পরবর্তী নেতৃত্ব হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে সখ্য করে তাতে আঘাত হেনেছে। শুধু তাই নয়, হেফাজতের সঙ্গে আঁতাত করে পাঠ্যপুস্তকে অনাকাক্সিক্ষত পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। এ ছাড়া গণমানুষের দল আওয়ামী লীগ ও সরকার একাকার হয়ে চলছে। তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক ভিত্তির মূল কথা দল ও সরকার থাকবে আলাদা।
অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমি আওয়ামী লীগকে বলব ১৯৪৯ সালে যে লক্ষ্য-আদর্শ নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় দলটি সেদিনটি খেয়ালে রাখতে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এই অধ্যাপক বলেন, এ দলটি ১৯৫৫ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পুরোপুরি নন কমিউনাল দলে পরিণত হয়। কিন্তু আজকের আওয়ামী লীগ আবার কমিউনাল। তিনি বলেন, তাদের লক্ষ্য ছিল গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া। অর্থনীতির মজবুত ভিত্তি, সুষম বণ্টন ও সুশাসন। ২০১৪ সালের পর এগুলো জলাঞ্জলি দিয়ে একদলীয় শাসনব্যবস্থার দিকে ধাবিত হয় আওয়ামী লীগ। এমাজউদ্দীন বলেন, উন্নয়ন হলেও সুষম বণ্টন ও সুশাসন নিশ্চিত করতে পারেনি শেখ হাসিনার নেতৃত্বের আওয়ামী লীগ। এর ফলে গণতন্ত্রও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি।
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে কর্মসূচি : আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ঢাকায় কেন্দ্রীয় কার্যালয় এবং দেশব্যাপী দলীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে। সকাল সাড়ে ৮টায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে কর্মসূচি উদ্বোধন করবেন দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা। একই দিন টুঙ্গিপাড়ায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের একটি প্রতিনিধিদল বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করবে। আগামীকাল ২৪ জুন বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আলোচনা সভা হবে। এতে সভাপতিত্ব করবেন দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা। ২৫ জুন বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সাংস্কৃতিক উপকমিটির উদ্যোগে সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার আয়োজন রয়েছে।

সূত্র: দেশ রূপান্তর

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়