Wednesday, May 22

জকিগঞ্জে কালের সাক্ষী সাজিদ রাজার বাড়ি অযত্ন অবহেলায়

 

নাজিম উদ্দিন:

সীমান্তবর্তী উপজেলা জকিগঞ্জের কাজলসার ইউনিয়নের সুরমা নদীর তীরবর্তী চারিগ্রামের প্রখ্যাত মিরাসদার সাজিদ রাজার স্মৃতিবাহী বাড়িটি এখন অযন্ত অবহেলায় পড়ে আছে।



বাড়িটি সংস্কার করে গড়ে তোলা যেতে পারে একটি আকর্ষনীয় পর্যটন কেন্দ্র।

সাজিদ রাজার দানকৃত জায়গায় গড়ে উঠেছে আটগ্রাম বাজার, আটগ্রাম ইউনিয়ন হাসপাতাল, ডাক বাংলো, মাদ্রাসা, স্কুলসহ রাস্তা ঘাট।

শতশত বছরের অযত্ন অবহেলায় চিহ্ন গায়ে মেখে এখনো দাড়িয়ে আছে সজিদ রাজার প্রিয় বাসভবনটি। বনজঙ্গলের ভিতর থেকে উকিঝুকি মারা ধংসপ্রায় ভবনটি এখনো অব্যাগতদের দৃষ্টি এড়ায়না । প্রায় শত ফুট দৈর্ঘ্য ও পনের ফুট প্রস্থের সাজিদ রাজার সখের প্রাসাদটির ভিতরে এখন সাপ, ব্যাঙ ও পোকামাকড়ের নিরাপদ আবাস আর বাইরে য়ে যাওয়া ভবনে গজে উঠেছে নানা প্রজাতির পরগাছা উদ্ভিদ। বাড়ির আঙ্গিনায় চরানো হয় গরু ছাগল। ১৩ চালা টিনের ঘর সজিদ রাজার বাড়িতে রয়েছে ১৩ চালা একটি দৃষ্টিনন্দন টিনের ঘর।

ঘরের বর্তমান স্বত্তাধিকারী সারওয়ার আহমদ চৌধুরী জানান, জমিদার সাজিদ রাজার বোনের উত্তরাধীকারী তার বাবা মৌলভী দেওয়ান দিগার উদ্দিন আহমদ চৌধুরী ও তার দুই চাচা দেওয়ান আজিজ উদ্দিন আহমদ চৌধুরী, মইন উদ্দিন আহমদ চৌধুরী ব্রিটিশ আমলে সখের বশে এই ঘর তৈরী করেন। কলকাতার মিস্ত্রিরা তৎকালীন ১৩ হাজার টাকায় মজুরীতে তেরটি চাল তৈরী করেন। ঘরটি পরিকল্পনা নির্মাণ শৈলী ও নান্দনিকতায় ভিন্নতর। আধুনিক চোখ ধাঁধানো নাগরিক স্থাপত্যকেও যেন হার মানায় গ্রামীণ এই স্থাপনাটি। এর সতন্ত্র গঠন বৈচিত্র দেখে সহজেই বুঝা যায় প্রশিক্ষিত ও পেশাদার নির্মাণ শিল্পীদের মেধা, পরিশ্রম ও অভিজ্ঞতার ফসল এটি। এটি যেন গ্রামীণ আদি মৌলিক স্থাপত্য রীতির প্রতিনিধিত্ব করছে। স্থানীয়ভাবে সহজলভ্য নির্মাণ উপকরণের ব্যবহার হয়েছে এতে। চালাগুলো টিন এবং কাঠের কারুকার্য মন্ডিত। কাঠ বাঁশের খানার বেড়ার উপর চুনসুরকির ব্যবহার প্রাচীন ঐতিহ্য ধারন করছে। কাঠের দরজা জানালায় রয়েছে শৈল্পিক কারুকার্য। ঘরের পুরো ছাদই কাঠের তৈরী। খূটিগুলো কাঠের এবং মেঝে পাকা। এক করে বিশাল এই ঘরটি বৈঠকখানা হিসাবেই ব্যবহার হতো। এক সময় হাসন রাজাসহ জমিদারদের আড্ডা বসতো এখানে।

সিলেট সিটি কর্পোরেশনের কিনার ইনচার্জ আলবাব আহমদ চৌধুরী জানান, তার বাবা হেকিম আব্দুল মতিন প্রায় একযুগ পরিত্যাক্ত এই ঘরটিতে বসবাস করেছেন। শতবর্ষী এই ঘরটির কাঠামো এখনো বেশ মজবুত। 

সাহিত্যিক ও কবি মাজেদ আহমদ বলেন, প্রবাসী কবি আব্দুল আউয়াল হেলালের উদ্যোগে এই ঘরটিতে কবিতা পাঠের আসর বসেছিল কিছূ দিন। ১৯৭৮ সালের দিকে কোরআন শিক্ষার আসরও বসতো এখানে।

কাজলসার ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুর রশিদ বাহাদুর বলেন, ঘরটির নির্মাণকাল সঠিকভাবে কেউ বলতে পারেনা। ধারনা করা হচ্ছে ১৯ শতকের প্রথম দশকে এই ঘরটি নির্মাণ করা হয়েছিল। সুযোগ পেলে এই ১৩ চালা ঘর ও বাড়িকে কেন্দ্র করে পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলার আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

ঐতিহাসিক মসজিদ: সাজিদ রাজার বাড়ির সামনেই একটি মনোমুগ্ধকর কারুকার্য সম্মিলিত ঐতিহাসিক মসজিদ। জকিগঞ্জের ইতিহাস ও ঐতিহ্য নামক বইয়ের বর্নণামতে ১৭৪০ খ্রিষ্টাব্দে মকদম মিয়া চৌধুরী প্রতিষ্ঠা করেন এ মসজিদটি। অপরূপ সুন্দর ছোট এই মসজিদটি দেখলে মনে হবে না এটি নির্মাণ হয়েছে ২৭১ বছর পূর্বে। সমজিদের সামনেও রয়েছে নামাজের স্থান। ডান পাশে রয়েছে মিনারা আর বাম পাশে রয়েছে ছোট্ট হুজরাখানা। মসজিদের বাহির ও ভিতর মিলিয়ে একত্রে ১৫০জন লোক নামাজ আদায় করতে পারেন। 

মসজিদের ইমাম কালিগঞ্জের মাতার গ্রামের মাও. আব্দুল মালিক জানান, এক যুগেরও বেশীদিন ধরে তিনি এই মসজিদে আছেন। সাজিদ রাজা ছিলেন নিঃসন্তান। তার বোনের বিয়ে হয়েছিল গোলাপগঞ্জের ফুলবাড়ীর রনিখাইল গ্রামে। সাজিদ রাজার ভাগিনার নাতি-পতিরা বর্তমানে বাড়িটির মালিক। মসজিদ কমিটির সভাপতি আওতাদ আহমদ চৌধুরীসহ অধিকাংশ আত্মীয় স্বজনই প্রবাসে রয়েছেন। সাধারণ সম্পাদক বয়োবৃদ্ধ সারওয়ার আহমদ চৌধুরী সিলেট শহরে বসবাস করেন। মাঝে মধ্যে আসেন দেখাশুনা করতে। বর্তমানে বাড়ির পশ্চিম ও দনি পার্শে পৃথক দুটি ঘর নির্মিত হয়েছে। বছরে দুই একবার বাড়ির মালিকরা বেড়াতে আসেন। বাড়িতে প্রায় ১৩ একর জমি রয়েছে। বাড়ির চার পাশেই রয়েছে তার প্রচুর জমি। শুধু দেশে নয় ভারতে ছিলো সাজিদ রাজার বিশাল সম্পত্তি। এক সময় ঘন্টায় বাজালে থালা বাটি নিয়ে আশপাশগ্রামের প্রজারা আসতো সাজিদ রাজার বাড়িতে খাবার জন্য। বাড়ির দুই পাশে রয়েছে বড় বড় দুইটি দীঘি। বাড়ীর চার পাশে ছিল বৃহত গড়খাই (খাল)। সাজিদ রাজার বাড়ি, দীঘি ও গড়খাই নিয়ে লোকমূখে রয়েছে নানা কল্পকাহিনী। এখনো এ বাড়িতে জিনভূত আছে বলে অনেকের ধারণা। অবাস্তব এসব কাহিনী এখনো স্থানীয় লোকজনের মূখে মূখে। সাজিদ রাজার আত্মীয় সাহিত্যিক ও ভাষাসৈনিক মতিন উদ্দিন আহমদের নামে সিলেটে একটি জাদুঘর রয়েছে। বাংলা একাডেমি থেকে তার জীবন ও কর্মের উপর বই প্রকাশ করেছে।

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়