Sunday, May 26

সদকাতুল ফিতরের বিধান

আবদুল কাইয়ুম শেখ::
আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে যেসব দান প্রদান করা বান্দার ওপর অবধারিত করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে সদকাতুল ফিতর অন্যতম। আর্থিক ইবাদত হিসেবে জাকাতের কাছাকাছি পর্যায়ে এর অবস্থান। অধিকাংশ ফিকহি গ্রন্থে জাকাত অধ্যায়েই সদকাতুল ফিতরের আলোচনা করা হয়েছে। দ্বিতীয় হিজরিতে রমজানুল মোবারকের রোজা ফরজ করা হয়। ওই বছরেরই শাবান মাসে সদকাতুল ফিতর অপরিহার্য করা হয়। তাই সামর্থ্যবান প্রতিটি ব্যক্তিকে রমজানুল মোবারকের সিয়াম সাধনায় আত্মনিয়োগ করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে ওই মাসের শেষে সদকাতুল ফিতর আদায়েও যতœশীল হতে হবে।
সদকাতুল ফিতরের পরিচয় : সদকাতুল ফিতর মূলত দুটি আরবি শব্দের সমষ্টি। একটি হলো সদকা এবং অন্যটি হলো ফিতর। সদকা শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো দান, অনুদান এবং ফিতর শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো উন্মুক্তকরণ বা রোজা ভঙ্গকরণ। আর ইসলাম ধর্মের বিধান অনুযায়ী রমজান মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার পর জাকাত গ্রহণের উপযুক্ত দরিদ্র ব্যক্তিদের নির্দিষ্ট পরিমাণ নির্ধারিত খাদ্যদ্রব্য বা এর সমমূল্য প্রদান করার নিয়মকে শরিয়তের পরিভাষায় সদকাতুল ফিতর বলা হয়। দীর্ঘ এক মাস রোজা পালন করার পর যেহেতু তা ভঙ্গ করা হয় এবং এ উপলক্ষে শরিয়ত কর্তৃক আরোপিত এ দান দরিদ্রদের মাঝে বিতরণ করা হয়; তাই একে সদকাতুল ফিতর বলে অভিহিত করা হয়।
ফেতরা আবশ্যক হওয়ার প্রমাণ : মহানবি হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর বহু বাণীর আলোকে সদকাতুল ফিতর আদায় করা আবশ্যক হওয়ার বিষয়টি প্রমাণিত। সিহা সিত্তাহর প্রায় সবকটি গ্রন্থে সদকাতুল ফিতর অবধারিত হওয়া প্রসঙ্গে হাদিস বর্ণিত হয়েছে। একটি হাদিসে এসেছে : ‘হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেছেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) লোকদের ওপর রমজান মাসের সদকায়ে ফিতর অবধারিত করেছেন।’ (সুনানে নাসাঈ : ২৫০৩)। অন্য আরেকটি হাদিসে এসেছে : ‘হজরত কায়স ইবনে সাদ (রা.) বর্ণনা করেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) আমাদের জাকাতের বিধান অবতীর্ণ হওয়ার আগে সদকাতুল ফিতর আদায় করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এরপর জাকাতের বিধান অবতীর্ণ হওয়ার পর আমাদের তা পালন করার নির্দেশও দিতেন না এবং বারণও করতেন না। তবু আমরা তা পালন করতাম।’ (সুনানে নাসাঈ : ২৫০৭)। মহানবী (সা.) এর নির্দেশ পালনার্থে সাহাবায়ে কেরামও যথাযথভাবে সদকাতুল ফিতর আদায় করতেন। ‘হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন, আমরা মহানবী (সা.) এর যুগে এক সা’ খাদ্যদ্রব্য বা এক সা’ খেজুর কিংবা এক সা’ যব অথবা এক সা’ কিসমিস দিয়ে সদকাতুল ফিতর আদায় করতাম।’ (বোখারি : ১৫০৮)। মুসনাদে আহমদ ও অন্যান্য হাদিসগ্রন্থে সদকাতুল ফিতর অপরিহার্য হওয়ার বিষয়টি এভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, ‘মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদুল ফিতরের দুই দিন আগে লোকদের সামনে ভাষণ প্রদান করেছেন। তখন তিনি বলেছেন, তোমরা দুজন ব্যক্তির মাঝে এক সা’ গম কিংবা এক সা’ খেজুর অথবা এক সা’ যব আদায় করে দাও। এ বিধানটি প্রত্যেকটি গোলাম, স্বাধীন, ছোট ও বড় ব্যক্তির ওপর ফরজ।’ (মুসনাদে আহমদ : ২৩৬৬৩)।
যাদের ওপর ফেতরা দেওয়া আবশ্যক : সামর্থ্যবান নারী-পুরুষ, স্বাধীন-পরাধীন, শিশু-বৃদ্ধ ও ছোট-বড় সব মুসলিমের ওপর সদকাতুল ফিতর আদায় করা ওয়াজিব। সামর্থ্যবান হওয়া দ্বারা উদ্দেশ্য হলো সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ (৭.৫০) বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপা (৫২.৫০) কিংবা এর সমমূল্যের মালিক হওয়া। সঙ্গে সঙ্গে এ সম্পত্তিটুকু তার মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত হওয়া। যদি কোনো ব্যক্তি ঈদুল ফিতরের চাঁদ উদয় হওয়ার পর থেকে নিয়ে সেদিনের সূর্যাস্ত পর্যন্ত সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপা কিংবা এর সমমূল্যের মালিক হয়, তা হলে তার ওপর সদকাতুল ফিতর আদায় করা আবশ্যক। (তানভিরুল আবসার)। যেসব লোকের ওপর সদকাতুল ফিতর আদায় করা ওয়াজিব তাদের বিবরণ হাদিসে উল্লিখিত হয়েছে। ‘হজরত ইবনে ওমর (রা.) বলেন, প্রত্যেক গোলাম, আযাদ, পুরুষ, নারী, প্রাপ্তবয়স্ক, অপ্রাপ্তবয়স্ক মুসলিমের ওপর আল্লাহর রাসুল (সা.) সদকাতুল ফিতর হিসেবে খেজুর হোক অথবা যব হোক এক সা’ পরিমাণ আদায় করা অবধারিত করেছেন। ঈদের নামাজের জন্য বের হওয়ার আগেই লোকজনকে তা আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন।’ (বোখারি : ১৫০৩)।
যা দিয়ে ফেতরা দেওয়া যায় : পাঁচ ধরনের খাদ্যদ্রব্য তথা গম, যব, খেজুর, পনির ও কিসমিসের মাধ্যমে সদকাতুল ফিতর আদায় করা যায়। গমের মাধ্যমে সদকাতুল ফিতর আদায় করা হলে অর্ধ সা’ (এক কেজি ৬৩৫ গ্রাম) এর মাধ্যমে আদায় করতে হবে। আর যব, খেজুর, পনির বা কিসমিসের মাধ্যমে ফেতরা আদায় করলে সেগুলোর এক সা’ (তিন কেজি ২৭০ গ্রাম) পরিমাণ দান করতে হবে। এ ব্যাপারে হাদিসে এসেছে : হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন, মহানবী (সা.) আমাদের মাঝে বর্তমান থাকা অবস্থায় আমরা সদকাতুল ফিতর বাবদ এক সা’ খাদ্য (গম) বা এক সা’ খেজুর অথবা এক সা’ যব কিংবা এক সা’ পনির অথবা এক সা’ কিসমিস দান করতাম।’ (বোখারি : ১৮২৯)। সেই সময় আরব দেশে গম ছিল আমদানি পণ্য; তাই এর দাম ছিল সবচেয়ে বেশি। আমাদের দেশে গমের দাম কম। তাই গম ছাড়া অন্য পণ্যের তুল্য মূল্য করে ফেতরা আদায় করা বাঞ্ছনীয়। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশে শুধু গমের মাধ্যমে সদকাতুল ফিতর আদায় করার রীতি প্রচলিত হয়ে গেছে। অন্য চারটি দ্রব্যের মাধ্যমে সদকাতুল ফিতর খুব কমই আদায় করা হয়। অথচ নিয়ম হলো প্রতিটি ব্যক্তির তার সামর্থ্য অনুযায়ী সদকাতুল ফিতর আদায় করা। হাদিসে বর্ণিত ওই পাঁচ ধরনের বস্তুর দেশীয় মূল্যের তারতম্যের প্রতি লক্ষ করেই ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ এ বছরের সদকাতুল ফিতরের সর্বোচ্চ পরিমাণ নির্ধারণ করেছে ১ হাজার ৯৮০ টাকা এবং সর্বনিম্ন পরিমাণ নির্ধারণ করেছে ৭০ টাকা। তাই প্রতিটি ব্যক্তিকে নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী ফেতরা দানের দ্রব্য নির্বাচন করে সে অনুযায়ী সদকাতুল আদায় করা বাঞ্ছনীয়।
ফেতরা আদায় করার সময় : ঈদুল ফিতরের দিন সুবেহ সাদেক উদয় হওয়ার পর সামর্থ্যবান প্রতিটি মুসলিম ব্যক্তির ওপর সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব হয়। তাই ঈদুল ফিতরের নামাজ আদায়ের জন্য ঈদগাহে যাওয়ার আগে সদকায়ে ফিতর আদায় করা উত্তম। হাদিসে নববিতে নামাজ আদায়ের আগেই সদকাতুল ফিতর আদায় করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মহানবী (সা.) ঈদগাহে যাওয়ার আগেই সদকাতুল ফিতর আদায় করার নির্দেশ প্রদান করে বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈদের নামাজের আগে সদকা আদায় করল; তাই গ্রহণযোগ্য সদকায়ে ফিতর। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি নামাজের পর তা আদায় করল, তা সাধারণ দান-অনুদানের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হলো।’ (সুনানে আবু দাউদ : ১৬০৯)। অন্য আরেকটি হাদিসে এসেছে : ‘হজরত ইবনে ওমর (রা.) বলেন, প্রত্যেক গোলাম, আযাদ, পুরুষ, নারী, প্রাপ্তবয়স্ক, অপ্রাপ্তবয়স্ক মুসলিমের ওপর আল্লাহর রাসুল (সা.) সদকাতুল ফিতর হিসেবে খেজুর হোক অথবা যব হোক এক সা’ পরিমাণ আদায় করা অবধারিত করেছেন। ঈদের নামাজের জন্য বের হওয়ার আগেই লোকজনকে তা আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন।’ (বোখারি : ১৫০৩)। অবশ্য কেউ যদি ঈদুল ফিতর আসার আগেই সদকায়ে ফিতর আদায় করে দেয়, তা হলে এরও অবকাশ রয়েছে। হাদিসে নববিতে এসেছে ‘হজরত আবদুল্লাহ ইবনে সালাবা (রা.) বলেন, ঈদুল ফিতরের দুই দিন আগে মহানবী (সা.) লোকদের সম্বোধন করে বলেন, তোমরা দুজনের মাঝে এক সা. গম কিংবা এক সা. খেজুর অথবা যব আদায় করো। প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক সবার পক্ষ থেকেই তা আদায় করতে হবে।’ (মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক সানআনি : ৫৭৮৫)।
সদকাতুল ফিতর ব্যয় করার খাত : ইসলাম কর্তৃক যেভাবে জাকাত ব্যয়ের খাত নির্ধারিত রয়েছে, ঠিক তেমনি সদকাতুল ব্যয় করার খাতও নির্ধারিত রয়েছে। জাকাত ব্যয়ের খাত যা সদকাতুল ফিতর ব্যয়ের খাতও তাই। মহাগ্রন্থ আল কোরআনে জাকাত ব্যয়ের খাত নির্ধারণ করে বলা হয়েছে : ‘জাকাত হলো শুধু ফকির, মিসকিন, জাকাত উসুলকারী ও যাদের চিত্ত আকর্ষণ প্রয়োজন তাদের হক এবং তা দাস-মুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে জিহাদকারীদের জন্য এবং মুসাফিরদের জন্য, এই হলো আল্লাহর নির্ধারিত বিধান।’ (সূরা তওবা : ৬০)। আলোচ্য আয়াতে ‘জাকাত উসুলকারী’ দ্বারা ইসলামি রাষ্ট্রে লোকদের কাছে গিয়ে যারা জাকাত উসুলের কাজ করে তারা উদ্দেশ্য। আর ‘যাদের চিত্তাকর্ষণ প্রয়োজন’ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো এমন নওমুসলিমরা, যারা নিকট অতীতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য তাদের শরিয়ত জাকাত ও সদকাতুল ফিতরের ব্যয়ের খাত বলে ঘোষণা দিয়েছে। তাই আমাদের কোরআনে বর্ণিত উল্লিখিত খাতেই সদকাতুল ফিতর আদায় করতে হবে। নির্ধারিত খাতের বাইরে গিয়ে অন্য কোনো কল্যাণমূলক কাজে সদকাতুল ফিতর ব্যয় করা হলে তা শরিয়তের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য হবে না।
সৃষ্টিকুল আল্লাহ তায়ালার পরিবার। তার পরিবারের শ্রেষ্ঠতম সদস্য হলো মানুষ। তাদের সেবা করার অর্থ হলো প্রকারান্তরে আল্লাহ তায়ালারই সেবা করা। মুসনাদে আহমদ, মুসনাদে বাযযার ও শুআবুল ঈমানের একটি বর্ণনায় এসেছে ‘হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, সৃষ্টিকুল আল্লাহর পরিবার। আর আল্লাহর কাছে প্রিয়তম সৃষ্টি হলো সেই ব্যক্তি যে তার পরিবাবের প্রতি অনুগ্রহ করে।’ (শুআবুল ঈমান : ৭০৪৮)। তাই আসুন! সদকাতুল ফিতরসহ সর্বপ্রকার দান-অনুদানে অংশগ্রহণ করে সৃষ্টির সেবায় এগিয়ে আসি। সঙ্গে সঙ্গে দরিদ্র, অসহায় ও আর্তমানবতার পাশে দাঁড়িয়ে স্রষ্টার কৃপাদৃষ্টি লাভ করে তার সন্তুষ্টি অর্জন করি।

লেখক : মুহাদ্দিস, জামিআ দারুল উলুম নুরিয়া মধ্যবাড্ডা, গুলশান, ঢাকা-১২১২

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়