Wednesday, May 29

রোজা রেখে রক্তদান


মোস্তাক আহমেদ::
পৃথিবীতে নানা রকম মহৎ কাজের মধ্যে অন্যতম হলো স্বেচ্ছায় রক্তদান। কারণ রক্তের কোনো বিকল্প নেই। রক্ত কোনো ফ্যাক্টরিতে উৎপাদন হয় না। রক্ত শুধু একজন মানুষের প্রয়োজনে আরেকজন মানুষই দিতে পারে। রক্তদান পরোপকারের একটি মাধ্যমও বটে। তবে রমজানে রোজা রেখে রক্তদান করা যায় কি না, এ নিয়ে কারও প্রশ্ন থাকতে পারে। এক. এতে রোজার ক্ষতি হয় কি না। দুই. রক্ত দিলে শারীরিকভাবে কোনো ক্ষতি হয় কি না।
সমকালীন ইসলামি চিন্তাবিদদের মতে, রোজা রাখা অবস্থায় রক্তদান করলে রোজা নষ্ট হয় না। কেননা রোজাদারের শরীর থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়া আর একজন মুমূর্ষু রোগীকে বাঁচাতে রক্তদান করাÑ এ দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে তাই রোজা রেখে রক্তদানে কোনো বাধা নেই। তাছাড়া রক্তদান যেখানে একজন মানুষের জীবন বাঁচানোর সঙ্গে সম্পর্কিত, সেখানে ধর্মীয় কোনো বাধা থাকার কথাও নয়। তবে কেউ যদি শারীরিকভাবে এমন দুর্বল হয় যে, রক্ত দিলে সে রোজা রাখার শক্তি হারিয়ে ফেলবে, তাহলে তার জন্য রক্ত দেওয়া মাকরুহ। (আহসানুল ফাতাওয়া: ৪/৪৩৫)। হজরত আকরামা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করিম (সা.) হজের জন্য ইহরাম বাঁধা অবস্থায় শরীর থেকে শিঙ্গার মাধ্যমে রক্ত বের করেছেন এবং রোজা অবস্থায়ও শরীর থেকে শিঙ্গার মাধ্যমে রক্ত বের করেছেন।
তাই রোজা রাখা অবস্থায় কোনো মুমূর্ষু রোগীর জন্য রক্তের প্রয়োজন হলে রক্তদান করুন। খুব জরুরি না হলে ইফতারের পরে হলেও রক্তদান করুন। অন্তত রোজা ও ইসলামের দোহাই দিয়ে রক্তদান এড়িয়ে যাবেন না। তাছাড়া রক্তদান একজন রোগীর সেবার অন্তর্ভুক্ত। পবিত্র কোরআনের সূরা মায়েদার ৩২ নম্বর আয়াতে উল্লেখ আছে, ‘যখন কেউ কোনো নিরপরাধ ব্যক্তিকে হত্যা করল, সে যেন সমগ্র মানবজাতিকে হত্যা করল। আর যখন কেউ কোনো মানুষের জীবন রক্ষা করল, সে যেন সমগ্র মানবজাতির জীবন রক্ষা করল।’
রোজা রেখে রক্তদানে শারীরিক প্রভাব সম্পর্কে কোয়ান্টাম স্বেচ্ছা রক্তদান কার্যক্রমের সমন্বয়ক ডা. মনিরুজ্জামান বলেন, শারীরিকভাবে সক্ষম ব্যক্তির রোজা রেখে রক্ত দিতে কোনো অসুবিধা নেই। আমি নিজেও প্রতি রমজানে রোজা রেখে রক্ত দান করি। রোজা রেখে রক্তদানে একজন সুস্থ ব্যক্তি না দুর্বলতা অনুভব করে; না তার শারীরিক ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে। সুস্থ-সবল যে কেউ এ সময়ে নির্ভয়ে রক্তদান করতে পারেন।
জরুরি এবং মুমূর্ষু রোগীর প্রয়োজনে রক্তদান মানবিক দায়বদ্ধতা ও সামাজিক অঙ্গীকারেরই প্রকাশ। কাজেই আমাদের কারও একজনের রক্তের বিনিময়ে যদি কোনো একজন ব্যক্তি অসুস্থতা থেকে সুস্থ হয় বা তার জীবন রক্ষা পায়, তাহলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সামর্থ্যবান সবারই স্বেচ্ছায় রক্তদান করা উচিত এবং অন্যকে রক্তদানে উৎসাহিত করাও আমাদের কর্তব্য।
আমাদের দেশে স্বেচ্ছা রক্তদান কার্যক্রমের বেশ কয়েকটি সংগঠন রয়েছে। সংগঠনগুলোর বেশিরভাগই স্বেচ্ছাসেবার ভিত্তিতে রক্তদান কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে কোয়ান্টাম স্বেচ্ছা রক্তদান কার্যক্রম বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করছে। দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকছে কোয়ান্টাম ল্যাব। নিরলস সেবা দিয়ে যাচ্ছেন ল্যাবের কর্মীরা। কোয়ান্টাম ল্যাবে রক্তদানের আরেকটি সুবিধা হলো, ল্যাবের আধুনিক যন্ত্রের মাধ্যমে এক ব্যাগ রক্ত ও রক্তের উপাদানকে চারটি ভাগে ভাগ করে চারজন রোগীকে দেওয়া সম্ভব হয়। ফলে এক ব্যাগ রক্তে বেঁচে যেতে পারে চারটি প্রাণ। আর এ রক্তদান যদি হয় রমজানে, এর বিনিময়ে স্রষ্টা ৭০ গুণ বা তার অধিক গুণ ফল বাড়িয়ে দিতে পারেন।
অতএব রোজা ভেঙে যাওয়ার দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত হয়ে মানবসেবার তরে রমজান মাসে রক্ত দিতে প্রস্তুত থাকা উচিত। এতে রোজার সওয়াবের পাশাপাশি মানবসেবার সওয়াবও পাওয়া যায়।
রক্তদানের উপকারিতা
রক্তদান স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, নিয়মিত স্বেচ্ছা রক্তদাতারা দুরারোগ্য রোগব্যাধি থেকে মুক্ত থাকেন। তাদের হৃদরোগ ও হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকিও অনেক কম। রক্তদান ধর্মীয় দিক থেকেও অত্যন্ত পুণ্যের কাজ। নিয়মিত রক্তদানের কয়েকটি উপকারিতা তুলে ধরা হলোÑ
রক্তদানের প্রথম এবং প্রধান কারণ, একজনের দানকৃত রক্তে আরেকজন মানুষের জীবন বঁাঁচাতে সহায়তা করে। ফলে মুমূর্ষু একজন মানুষকে রক্তদান করে আপনি পাবেন মানসিক তৃপ্তি।
রক্তদান স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। রক্তদান করার সঙ্গে সঙ্গে শরীরের মধ্যে অবস্থিত ‘বোন ম্যারো’ নতুন কণিকা তৈরির জন্য উদ্দীপ্ত হয় এবং রক্তদানের দুই সপ্তাহের মধ্যে নতুন রক্তকণিকার জন্ম হয়ে ঘাটতি পূরণ হয়ে যায়। বছরে তিনবার রক্তদান শরীরে লোহিত কণিকাগুলোর প্রাণবন্ততা বাড়িয়ে তোলার সঙ্গে সঙ্গে নতুন কণিকা তৈরির হার বাড়িয়ে দেয়। উল্লেখ্য, রক্তদান করার মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই দেহে রক্তের পরিমাণ স্বাভাবিক হয়ে যায়।
রক্তদানে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমে যায়, এতে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে। ফলে হৃদরোগ ও হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি অনেকটাই কমে যায়।
গবেষণায় দেখা যায়, যারা বছরে দুইবার রক্ত দেয়, অন্যদের তুলনায় তাদের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কম থাকে। বিশেষ করে ফুসফুস, লিভার, কোলন, পাকস্থলী ও গলার ক্যান্সারের ঝুঁকি নিয়মিত রক্তদাতাদের ক্ষেত্রে অনেক কম পরিলক্ষিত হয়।
নিয়মিত স্বেচ্ছা রক্তদানের মাধ্যমে নিজের শরীরে হেপাটাইটিস-বি, হেপাটাইটিস-সি, ম্যালেরিয়া, সিফিলিস, এইচআইভি-এইডসের মতো বড় কোনো রোগ আছে কি না, একজন রক্তদাতা সেটি বিনা খরচে জানতে পারেন।
নিয়মিত রক্তদানে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
রক্তদাতার যদি নিজের কখনও রক্তের প্রয়োজন হয় তাহলে ব্লাড ব্যাংকগুলো তাকে অগ্রাধিকার দিয়ে রক্তের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করে।

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়