Tuesday, April 2

মেরাজের তাৎপর্য ও আমাদের সমাজ

শহীদুল ইসলাম:

আল্লাহ তায়ালা রাসূল (সা.) এর দ্বারা মেরাজ সংগঠিত করেছিলেন। উদ্দেশ্য কখনোই এটা ছিলো না যে, এই রজনী উৎসবের হবে; মুসলমানরা আতশবাজি ও বিশেষ কিছু অনুষ্ঠানাদি পালনের মধ্য দিয়ে তা উদযাপন করবে। 

ইসলাম উৎসবের ধর্ম নয়; অন্যান্য ধর্মের ক্ষেত্রে যেমনটা দেখা যায়। অর্থাৎ এমন অনেক ধর্ম আছে, যেগুলোতে নির্দিষ্ট কিছু উৎসব না থাকলে ওই ধর্মই দুনিয়া থেকে মিটে যেতো। ওই উৎসবগুলোই মূলত ধর্মকে জিইয়ে রেখেছে। ওই ধর্মের অনুসারীরা উৎসবগুলোতে একত্রিত হয়ে ধর্মীয় বিভিন্ন রীতি-নীতির কথা স্মরণ করে এবং কিছুদিন ওগুলোকে পালন করে।
ইসলাম হচ্ছে এর বিপরীত। ইসলামের অস্তিত্ব নির্দিষ্ট কিছু উৎসবের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে এর বিধিবিধান রয়েছে। তাই মেরাজকে উৎসবের রজনি না ভাবি বরং এর শিক্ষাকে বাস্তবায়নে গুরুত্ব দেই।
মেরাজের প্রেক্ষাপট: মক্কার মুশরিক সম্প্রদায় নবী করীম (সা.) এর ওপর চাপ দিয়ে আসছিলো, যেন তিনি ওদের ধর্মের বিরুদ্ধে কিছু না বলেন। কিন্তু নবী করীম (সা.) সবকিছুকে উপেক্ষা করে সত্য দ্বীন ইসলামের প্রচার করে যেতে থাকেন। এক সময় মক্কাবাসী নবী করীম (সা.) ও তাঁর সহযোগীদেরকে বয়কট করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এ মর্মে ওরা একটি ঘোষণাপত্র তৈরি করে কাবা শরীফের দরজায় টানিয়ে দেয়। তাতে লেখা ছিলো-
(ক) মুসলমানদের সঙ্গে ক্রয়-বিক্রয়, সামাজিক আদান-প্রদান, চলাফেরা ও আলাপ-আলোচনা সব বন্ধ থাকবে।
(খ) কোনো ব্যক্তি তাদের কাছে মেয়ে বিবাহ দিতে পারবে না এবং তাদের মেয়ে বিবাহ করাতে পারবে না। তাদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক সম্পূর্ণরূপে রহিত করা হলো।
(গ) যেকোনো ব্যক্তি যেকোনো অবস্থায় তাদেরকে যেকোনো প্রকার সাহায্য করবে, সে অপরাধী হিসেবে কঠোর দণ্ডের যোগ্য বলে বিবেচিত হবে।


(ঘ) যে পর্যন্ত হত্যা করার জন্য স্বেচ্ছায় তারা মুহাম্মাদ (সা.)-কে আমাদের হাতে সমপর্ণ না করবে সে পর্যন্ত এই বয়কট বলবৎ থাকবে।


কুরাইশদের দৃঢ় মনোবল দেখে খাজা আবু তালিব হাশেম ও মুত্তালিব গোত্রের লোকদের সঙ্গে পরামর্শে বসলেন। সিদ্ধান্ত হয়, শহরের বাইরে কোথাও আশ্রয় নিয়ে এই সংকটের মোকাবেলা করা হবে। সে মোতাবেক শিআবে আবি তালিব নামক জায়গায় গিয়ে তারা আশ্রয় নেয়। চারদিক থেকে পাহাড় বেষ্টিত থাকায় জায়গাটি ছিলো অনেক নিরাপদ। হঠাৎ করে বয়কট করায় মুসলমানরা কোনো প্রস্তুতিও গ্রহণ করতে পারেনি। তাই খাদ্যাভাবে গাছের পাতা খেয়েও মুসলমানরা দিন পার করে। এই অবরোধ তিন বছর পর্যন্ত থাকে। এই ঘটনা ছিলো নবুয়াত লাভের সপ্তম থেকে দশম বছর পর্যন্ত।
নবুয়াতের দশম বছর, খাজা আবু তালিবের মৃত্যু: 
রাসূল (সা.) এর চাচা খাজা আবু তালিব যদিও মুসলমান হননি, কিন্তু তিনি ছিলেন রাসূল (সা.) এর ঘনিষ্ঠ সহযোগী। তিন বছর বয়কটকালে তিনি রাসূল (সা.) এর সঙ্গে পাহাড়েই ছিলেন। কুরাইশদের মাঝে আবু তালিবের গ্রহণযোগ্যতার কারণে মুশরিকরা সরাসরি রাসূল (সা.)-কে কিছু বলার সাহস পেতো না। কুরাইশদের বয়কট ওঠে গেলে মুসলমানরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। কিন্তু রাসূল (সা.) এর চাচা এর অল্প কিছুদিন পরেই ইন্তেকাল করেন।
হজরত খাদিজা (রা.) এর মৃত্যু: 
হজরত রাসূল (সা.) এর স্ত্রী খাদিজা (রা.) আবু তালিবের মৃত্যুর পরপরই মৃত্যুবরণ করেন। হজরত খাদিজা (রা.) এর সঙ্গে নবী করীম (সা.) এর দাম্পত্য জীবন ছিলো দীর্ঘ পঁচিশ বছরের। নবী করীম (সা.) এর সন্তানগণ তাঁর থেকেই জন্মগ্রহণ করেন। তাছাড়া তিনি ছিলেন অঢেল সম্পদের মালিক। ইসলামের জন্য তিনি সমস্ত সম্পদ ব্যয় করেন। কাফেরদের দুর্ব্যবহারে খারাপ মনে যখন নবী করীম (সা.) ঘরে ফিরতেন তখন তিনি তাকে সান্তনা দিতেন। এই পরিস্থিতিতে আল্লাহ তায়ালা তার প্রিয় হাবিব (সা.)-কে কাছে ডেকে নিলেন। জান্নাত,জাহান্নাম দেখালেন।
মেরাজের ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ:
 মেরাজের রজনীতে নবী করীম (সা.) হজরত উম্মে হানি (রা.) এর ঘরে ঘুমিয়েছিলেন। হজরত জিবরাঈল (আ.) এসে ঘুম থেকে জাগিয়ে বোরাকে ওঠালেন। বোরাক দ্রুতগতি সম্পন্ন একটি প্রাণী। সীরাতের কিতাবসমূহে এর গতি সম্পর্কে লেখা হয়েছে, প্রথম পা ফেলানোর পর তার দৃষ্টি যতটুকু যায় সেখানে দ্বিতীয় পা ফেলে। প্রথম ওঠার সময় বোরাক একটু নড়াচড়া করছিলো। তখন হজরত জিবরাঈল (আ.) তার ডান হাত বোরাকের ওপর রেখে বলেন, আজকে তোমার ওপর যে ব্যক্তি আরোহণ করছেন ইতোপূর্বে এত সম্মানি ব্যক্তি তোমার ওপর আরোহণ করেনি। তার এ কথা শুনে বোরাক শান্ত হয়। 
বোরাকের আকৃতি সম্পর্কে লেখা হয়েছে, গাধা ও খচ্চরের মাঝামাঝি দু’ডানা বিশিষ্ট একটি প্রাণী। হারাম শরীফ থেকে রওয়ানা হয়ে প্রথমে তিনি বাইতুল মুকাদ্দাসে যান। সেখানে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিলেন হজরত ইব্রাহিম, মূসা ও ঈসাসহ আরো বহু নবী (আ.)। পৌঁছানোর পর প্রথমে নবী করীম (সা.) এর ইমামতিতে নবীগণ নামাজ আদায় করেন। অতঃপর রাসূল (সা.) এর নিকট তিনটি পাত্র আনা হয়। একটিতে দুধ, আরেক পাত্রে মদ ও তৃতীয় পাত্রে ছিলো পানি। কোনো কোনো বর্ণনায় এসেছে, দুই পাত্রের কথা-দুধ ও মদ। রাসূল (সা.)-কে বলা হলো, আপনি যেকোনো একটি পাত্র নির্বাচন করুন। তখন রাসূল (সা.) দুধের পাত্র নির্বাচন করলেন। হাদীসে এসেছে, যদি মদের পাত্র নির্বাচন করতেন তাহলে উম্মতে মুহাম্মাদী পথভ্রষ্ট হয়ে যেতো। (সীরাতে ইবনে হিশাম, খন্ড-২, পৃষ্ঠা-২৮৬)।
কোন আসমানে কোন নবীর সঙ্গে সাক্ষাত: প্রথম আসমানে হজরত আদম (আ.) এর সঙ্গে হজরত নবী করীম (সা.) এর সাক্ষাত হয়। দ্বিতীয় আসমানে হজরত ঈসা ও ইয়াহইয়া (আ.) এর সঙ্গে। তৃতীয় আসমানে এক ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাত হয়, যার চেহারা পূর্ণিমার চাঁদের ন্যায় ঝলমল করছিলো। রাসূল (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, ইনি কে? হজরত জিবরাঈল (আ.) বললেন, তিনি হচ্ছেন তোমাদের ভাই ইউসুফ ইবনে ইয়াকুব (আ.)। চতুর্থ আসমানে হজরত ইদ্রিস (আ.) এর সঙ্গে। পঞ্চম আসমানে হারুন ইবনে ইমরান (আ.) এর সঙ্গে সাক্ষাত হয়। ষষ্ঠ আসমানে মূসা (আ.) এর সঙ্গে আর সপ্তম আসমানে সাক্ষাত ঘটে হজরত ইব্রাহিম (আ.) এর সঙ্গে। (সীরাতে ইবনে হিশাম, খন্ড-২, পৃষ্ঠা-২৯)।
নবী করীম (সা.) মেরাজের রজনিতে যে সকল দৃশ্য দেখেছিলেন: 
(এক) রাসূল (সা.) বলেন, জাহান্নামে আমি একদল লোককে দেখেছি, যাদের ঠোঁট উটের ঠোঁটের ন্যায়। ওদের হাতে এক টুকরো আগুন, যা তারা ভক্ষণ করছে আর পিছনের রাস্তা দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে বের হয়ে যাচ্ছে। আমি জিবরাঈল (আ.)-কে জিজ্ঞেস করি ওরা কারা? তিনি বলেন, ওরা ওই সকল লোক যারা ইয়াতিমের মাল আত্মসাৎ করতো।
(দুই) তারপর আমি পেটুক কিছু লোককে দেখি; ওদের ন্যায় পেটুক আর কখনো দেখিনি। ওদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপের সঙ্গে সঙ্গে তৃষ্ণার্ত উটের ন্যায় এক ধরণের প্রাণী পিষ্ট করছে। কিন্তু ওই লোকগুলো সেখান থেকে সরতে পারছে না। আমি জিজ্ঞেস করি ওরা কারা? জিবরাঈল (আ.) বলেন, ওরা ওই সকল লোক যারা দুনিয়াতে সুদ খেত।
(তিন) একদল লোককে পাওয়া গেলো, যাদের সামনে রয়েছে টাটকা গোশত আর এক পাশে আছে পঁচা দুর্গন্ধযুক্ত গোশত। ওরা ভালো গোশত বাদ দিয়ে পঁচাটা খাচ্ছে। জিজ্ঞেস করা হলে জিবরাঈল (আ.) বলেন, ওরা ওই সকল লোক যারা নিজের বৈধ স্ত্রী রেখে অন্যের স্ত্রীর কাছে যেতো। এ রকম আরো অনেক দৃশ্য নবী করীম (সা.) দেখেছিলেন। (সীরাতে ইবনে হিশাম, খন্ড-২, পৃষ্ঠা-২৯৩)।
নামাজ ফরজ হওয়া: 
রাসূল (সা.) বলেন, নামাজ ফরজ হওয়ার পর ফিরে আসার সময় মূসা ইবনে ইমরান (আ.) এর পাশ দিয়ে যখন আমি যাই তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কত ওয়াক্ত নামাজ আপনার উম্মতের ওপর ফরজ করা হয়েছে? আমি বলি, প্রতিদিন পঞ্চাশ ওয়াক্ত। শুনে তিনি বলেন, নামাজ একটি ভারী কাজ আর আপনার উম্মত দুর্বল। তাই আপনি আল্লাহর কাছে আবার যান এবং এর দরখাস্ত করেন যেন তিনি কিছু কমিয়ে দেন। আমি এসে দরখাস্ত করি, আল্লাহ তায়ালা দশ ওয়াক্ত নামাজ কমিয়ে দেন। এভাবে আমি আসি আর মূসা (আ.) পরামর্শ দিয়ে আল্লাহ তায়ালার কাছে পাঠান। সর্বশেষ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ বাকি থাকে। তিনি পরামর্শ দিলেন আরো কমানোর দরখাস্ত করতে, কিন্তু আমি বলি, এতবার যাওয়ার পর এখন যেতে লজ্জাবোধ হচ্ছে। আমি আর পারবো না। এরপর নবী করীম (সা.) সাহাবাদের উদ্দেশ্যে বলেন, তোমাদের মধ্যে যে এই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করবে আল্লাহ তায়ালা তার আমলনামায় পঞ্চাশ ওয়াক্তের সওয়াব দান করবেন।
মেরাজের শিক্ষা:
(এক) মেরাজের অন্যতম শিক্ষা হচ্ছে, নামাজের গুরুত্ব। কেউ কেউ বলেন, নামাজ মুমিনের মেরাজ। আজ মুসলমান মেরাজের রজনী পালন করে, কিন্তু এর শিক্ষার প্রতি কোন ভ্রুক্ষেপ করে না।
(দুই) জুলুম নির্যাতন সহ্য করে দ্বীনের ওপর অটল-অবিচল থাকতে পারলে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে সাহায্য অবশ্যই আসবে। যেমন নাকি নবী করীম (সা.) মক্কার মুশরিকদের বয়কট, হজরত খাজা আবু তালিব ও আম্মাজান খাদিজা (রা.) এর বিচ্ছেদের শোক সহ্য করার পর আল্লাহ তায়ালা মেরাজ দান করেছিলেন।
(তিন) ইসলাম ধর্মের সম্পর্ক মানুষের বুঝ-বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতার সঙ্গে নয় বরং এর সম্পর্ক হচ্ছে আসমানের সঙ্গে।
(চার) নিঃসন্দেহে মেরাজর ঘটনা রাসূল (সা.) এর সঙ্গেই নির্দিষ্ট। আল্লাহ তায়ালা বুঝাতে চেয়েছেন যে, মানুষই এত উর্ধ্বে পৌঁছতে পারে। মানুষ ভিন্ন অন্যকেউ এত উপরে ওঠতে পারে না। এর দ্বারা মূলত আল্লাহ তায়ালা মানব জাতির শ্রেষ্ঠত্য প্রকাশ করেছেন।
সূত্র: ডেইলি বাংলাদেশ

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়