Tuesday, January 10

পাকিস্তানের কারাগারে কেমন ছিল বন্দী মুজিবের দিনগুলো?

পাকিস্তানের কারাগারে কেমন ছিল বন্দী মুজিবের দিনগুলো?
কানাইঘাট নিউজ ডেস্ক: মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জেলখানায় সেলের পাশেই খোঁড়া হয় তার কবর। কিন্তু তিনি ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় হিমালয়ের মত অটল। প্রবল আন্তর্জাতিক চাপে শেষপর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তানের জান্তা সরকার।

মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানের কারাগারে কেমন ছিল বাংলাদেশের জাতির জনকের দিনগুলো? পাকিস্তানের ২৪ বছরের ইতিহাসে ১৪ বছরই কারাগারে কাটিয়েছিলেন শেখ মুজিব। কিন্ত ২৫শে মার্চের কাল রাতে ঢাকায় পাকিস্তানী বাহিনীর গণহত্যা শুরুর পাশাপাশি তাকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়াটা ছিল চূড়ান্ত শঙ্কার।

পাকিস্তান থেকে লন্ডন এবং ভারত হয়ে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সাল ঢাকায় ফিরে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে লাখ লাখ মানুষের জমায়েতে তিনি তার গ্রেপ্তার, বন্দীদশা এবং মুক্তির কিছুটা বর্ণনা দেন। ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ রাতে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের হাতে বন্দী হওয়ার ঘটনার খানিকটা বর্ণনা তার ভাষণেও আছে। বঙ্গবন্ধু ইচ্ছে করলে আত্মগোপনে চলে যেতে পারতেন, কন্তু তিনি যাননি। কারণ তিনি জানতেন, তাকে না পেলে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বর্বরতার মাত্রা আরও বেড়ে যাবে।

স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ভাষণে বঙ্গবন্ধু তার গ্রেপ্তার বিষয়ে বলেছেন, “১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ রাত্রে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের হাতে বন্দী হওয়ার পূর্বে আমার সহকর্মীরা আমাকে চলে যেতে অনুরোধ করেন। আমি তখন বলেছিলাম, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে বিপদের মুখে রেখে আমি যাব না। মরতে হলে আমি এখানেই মরব। বাংলা আমার প্রাণের চেয়েও প্রিয়। তাজুদ্দিন এবং আমার অন্যান্য সহকর্মীরা তখন কাঁদতে শুরু করেন,”।

পাকিস্তানে আটকাবস্থায় বঙ্গবন্ধুর নামে একটি মামলা পরিচালনা করা হয়। সে মামলার রায়ে বঙ্গবন্ধুর ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়। শুধু তাই নয়, বঙ্গবন্ধুর সামনেই তার সেলের পাশে কবর খোঁড়া হয়েছিল! কিন্তু অবিচল জাতির জনক একবারের জন্যও ভয় পাননি। ১০ জানুয়ারির ভাষণে তিনি বলেছেন, “আমি মুসলমান। আমি জানি, মুসলমান মাত্র একবারই মরে। তাই আমি ঠিক করেছিলাম, আমি তাদের নিকট নতি স্বীকার করবনা। ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় আমি বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা। জয় বাংলা”।

তিনি ভাষণে আরও বলেন, “ ইয়াহিয়া খাঁর কারাগারে আমি প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করেছি। মৃত্যুর জন্য আমি প্রস্তুতও ছিলাম। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ যে মুক্ত হবে, সে বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিলনা, এই মুক্তির জন্য যে মূল্য দিতে হল, তা কল্পনারও অতীত। পাকিস্তানের কারাগারে বন্দীদশায় থেকে আমি জানতাম, তারা আমাকে হত্যা করবে। কিন্তু তাদের কাছে আমার অনুরোধ ছিল, আমার লাশটা যেন তারা যেন বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়, বাংলার পবিত্র মাটি যেন আমি পাই। আমি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলাম, তাদের কাছে প্রাণ ভিক্ষা চেয়ে বাংলার মানুষদের মাথা নিচু করব না।”

শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক চাপে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়ে পাকিস্তান সরকার। তবে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করেছে বঙ্গবন্ধুকে বিভ্রান্ত করতে। বঙ্গবন্ধু যেন কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠ থেকেও বাংলার মানুষের মনোভাব বুঝতে পারতেন। তিনি পাকিস্তানি শাসকদের উদ্দেশ্য করে বলেছেন, দেশে না ফেরা পর্যন্ত তিনি কিছু বলবেন না।

এ বিষয়ে তিনি ভাষণে বলেছিলেন “পাকিস্তানী কারাগার থেকে আমি যখন মুক্ত হই, তখন জনাব ভুট্টো আমাকে অনুরোধ করেছিলেন, সম্ভব হলে আমি যেন দুদেশের মধ্যে একটা শিথিল সম্পর্ক রাখার চেষ্টা করি। আমি তাকে বলেছিলেন, আমার জনগণের নিকট ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত আমি আপনাকে এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারিনা। এখন আমি বলতে চাই, ভুট্টোসাহেব আপনারা শান্তিতে থাকুন। বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। এখন যদি কেউ বাংলাদেশের স্বাধীনতা হরণ করতে চায় তাহলে সে স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য মুজিব সর্বপ্রথম তার প্রাণ দেবে”।

বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের আজকের দিনে, অর্থাৎ ১০ জানুয়ারি নিজ দেশে এসে পৌঁছান। তবে এর আগের ভ্রমণও কম উত্তেজনাকর ছিলনা। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারির ভোরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে লন্ডনের উদ্দেশে একটি চার্টার্ড বিমানে উঠিয়ে দিয়েছিলেন তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো।

বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিমানটি উড্ডয়নের পর ভুট্টো এক অদ্ভুত মন্তব্য করেছিলেন- “পাখি উড়ে গেছে”। ১০ জানুয়ারির ভাষণে বঙ্গবন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন, ফ্রান্স, ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনসাধারণের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

সেদিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লাখো জনতার উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘রক্ত দিয়ে হলেও আমি বাঙালি জাতির এই ভালোবাসার ঋণ শোধ করে যাবো।

কথা রেখেছিলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যা পাওয়া বঙ্গবন্ধুকে খোদ পাকিস্তান সরকার একটি ফুলের আঁচড়ও দিতে সাহস পায়নি। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে জীবন দিতে হয়েছে তার প্রিয় বাঙালির হাতেই।

স্বদেশের মাটি ছুঁয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসের নির্মাতা শিশুর মতো আবেগে আকুল হলেন সেদিন। আনন্দ-বেদনার অশ্রুধারা নামলো তার দু’চোখ বেয়ে। প্রিয় নেতাকে ফিরে পেয়ে সেদিন সাড়ে সাত কোটি বাঙালি আনন্দাশ্রুতে সিক্ত হয়ে জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু ধ্বনিতে প্রকম্পিত করে তোলে বাংলার আকাশ বাতাস।

জনগণনন্দিত শেখ মুজিব সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দাঁড়িয়ে তার ঐতিহাসিক ধ্রুপদি বক্তৃতায় বলেন, ‘যে মাটিকে আমি এতো ভালোবাসি, যে মানুষকে আমি এতো ভালোবাসি, যে জাতিকে আমি এতো ভালোবাসি, আমি জানতাম না সে বাংলায় আমি যেতে পারবো কি-না। আজ আমি বাংলায় ফিরে এসেছি বাংলার ভাইয়েদের কাছে, মায়েদের কাছে, বোনদের কাছে। বাংলা আমার স্বাধীন, বাংলাদেশ আজ স্বাধীন।’

যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তন সদ্য স্বাধীন বাঙালি জাতির কাছে ছিল একটি বড় প্রেরণা। দীর্ঘ সংগ্রাম, ত্যাগ-তিতিক্ষা, আন্দোলন ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে বির্জয় অর্জনের পর বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে সামনে এগিয়ে নেয়ার প্রশ্নে বাঙালি জাতি যখন কঠিন এক বাস্তবতার মুখোমুখি, তখন পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে আরও জানান, ইন্দিরা গান্ধী ব্যক্তিগতভাবে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য বিশ্বের সকল দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন, তারা যেন তাকে মুক্তি দেয়ার জন্য ইয়াহিয়া খানকে অনুরোধ জানান। বঙ্গবন্ধু বলেন, “ আমি তার নিকট চিরদিন কৃতজ্ঞ থাকব”।
সূত্র: বিডি লাইভ।

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়