Thursday, August 27

সন্ত্রাসবাদের হুমকিতে কাঁপছে তিউনিসিয়ার তরুণ গণতন্ত্র!


ঢাকা: সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে সম্প্রতি তিউনিসিয়ার একটি জেলখানায় এক সপ্তাহ আটক ছিলেন সাত ব্যাক্তি। সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে চলতি আগস্টের প্রথম দিকেই তাদের ছেড়ে দেওয়ার আদেশ দেন বিচারক। কিন্তু জেলে আটক থাকা অবস্থায় তাদের উপর নির্যাতন চালানো হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন ওই সাত ব্যক্তি। মুক্তির পর আদালত প্রাঙ্গন থেকে বের হওয়া মাত্রই সাদা পোশাকে কয়েকজন পুলিশ সদস্য এসে পূণরায় তাদের আটক করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। এভাবে কোনো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই ওই সাত ব্যাক্তিকে পূণরায় গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে তাদের আইনজীবি আদালতে প্রতিবাদ জানান। এর জবাবে দেশটির বিচার মন্ত্রী সালাহ বেনাইসা স্থানীয় একটি রেডিওকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে নতুন করে যুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রেক্ষিতে এখন যে কোনো সন্দেহভাজন আসামিকে কোনো পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেপ্তার করা অনুমোদনযোগ্য। এ ব্যাপারে বিচার মন্ত্রণালয় ও পুলিশ বাহিনীর মাঝে একটি সমঝোতা চুক্তি হয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি। ওই সমঝোতার মাধ্যমে পুলিশ সদস্যদেরকে বিচার মন্ত্রণালয় বা আদালতের পূর্ব অনুমতি ছাড়াই স্বাধীনভাবে সন্ত্রাসবাদবিরোধী কর্মকাণ্ড ও অভিযান চালানোর অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। তিউনিসিয়া ছিল ২০১১ সালে শুরু হওয়া কথিত আরব বসন্তের সুতিকাগার। আরব বসন্ত কবলিত দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র এই দেশটিতেই গণতান্ত্রিক উত্তরণ ঘটেছিল। উত্তোরত্তর বেড়ে চলা নাগরিক স্বাধীনতা ও নিয়মতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদলে দেশটির গণতন্ত্রের জয়যাত্রা অব্যাহত ছিল। কিন্তু সম্প্রতি দু’টি সন্ত্রাসী হামলায় ৬০ জন বিদেশি পর্যটক নিহত হওয়ার ঘটনায় দেশটিতে এখন প্রায় একপ্রকার জরুরি অবস্থা চলছে। নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যরা নির্বিচারে কয়েকশত সন্দেহভাজন আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে। এর ফলে দেশটির মানবাধিকার কর্মীরা আশঙ্কা করছেন সাবেক স্বৈরশাসক জয়নুল আবেদিন বেন আলীর শাসনমালের নির্যাতন-নিপীড়ন পূণরায় ফিরে আসবে। আরব বসন্তের গণতান্ত্রিক প্রতিশ্রুতিসমূহ বাস্তবায়নে তিউনিসিয়াই একমাত্র আশার আলো জ্বেলেছিল। বাকী দেশগুলোতে আরব বসন্ত থেকে উদ্ভুত গণজাগরণ চরম নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলায় নিপতিত হয়েছে- যেমন লিবিয়ায়। কোনো কোনো দেশে আবার আগের চেয়েও বেশি নিপীড়নমূলক শাসক শ্রেনী ক্ষমতার মসনদ দখল করে নিয়েছে- যেমন মিশরে। কিন্তু নতুন করে সন্ত্রাসবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠায় দেশটির পর্যটন অর্থনীতি হুমকির মুখে পড়ে গেছে। যার ফলে দেশটির সরকার সন্ত্রাসবাদ দমণে কঠোর সব পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। এতে দেশটির নাগিরকদের স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রও বিলুপ্ত হওয়ার পথে রয়েছে। দেশটিতে এখন আর প্রকাশ্যে কোনো বিক্ষোভ প্রদর্শন করা যায় না। এমনকি পার্লামেন্টে যে কোনো ধরনের স্বৈরতান্ত্রিক আইন প্রণয়নের অনুকুল পরিবেশও বিরাজ করছে। এমনকি আরব বসন্তের গণতান্ত্রিক বিপ্লবের চার বছর পার হয়ে যাওয়ার পরও পুরোনো পুলিশ বাহিনীতে কোনো সংস্কার আনা হয়নি। বেন আলীর শাসনামলে তিউনিসিয়া ছিল পুরোপুরি একটি পুলিশি রাষ্ট্র। সেসময় ক্ষমতা হারানোর আতঙ্কতাড়িত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিরোধীদের উপর হরদম নির্মম দমণ-পীড়ন চালিয়ে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করত। স্বৈরশাসক বেন আলীর বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয় স্বজনরাই ছিল তখন দেশটির অর্থনীতির প্রধান নিয়ন্ত্রক। আরব বসন্তের বিপ্লবের পর গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত উদারবাদি ইসলামপন্থী দল এন্নাহাদর নেতৃত্বাধীন নতুন সরকার দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের বিচারের জন্য একের পর এক আইন পাশ করতে থাকে। এন্নাহাদার নেতৃত্বাধীন সরকার স্বৈরশাসনামলের অপরাধগুলোর বিচারের জন্য একটি ট্রুথ অ্যান্ড ডিগনিটি (সত্য ও মর্যাদা) কমিশনও গঠন করে। কিন্তু আরব বসন্তের বিপ্লব পরবর্তী সময়কালে দেশটির অর্থনীতিতে বিপর্যয় নেমে আসে। একের পর এক শ্রমিক ধর্মঘট ও বিক্ষোভ সহিংসতার ঘটনা ঘটতে থাকে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে দেশটিতে ইসলামি চরমপন্থীরা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ইসলামি চরমপন্থীরা একের পর এক সেক্যুলার নেতাদের হত্যা ও পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে হামলা চালায়। এর ফলে সেক্যুলার গণতন্ত্রপন্থী ও উদারবাদি ইসলামপন্থীদের মাঝে যে গণতান্ত্রিক ঐক্য ও সমঝোতা হয়েছিল তাতে ফাটল ধরে। এতে অতিষ্ঠ হয়ে জনগন রাষ্ট্রকে আরো কঠোর হওয়ার আহবান জানায়। পরিণতিতে সরকার এমনকি কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়াই অসংখ্য মানুষকে গ্রেপ্তার করতে থাকে। উদারবাদি ইসলামপন্থীদের ব্যর্থতায় গত বছরের শেষদিকে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সেক্যুলার নিদা তিউনিস পার্টি বিজয় লাভ করে। নিদা তিউনিস পার্টি দেশটির স্বাধীনতা পরবর্তী নেতা হাবিব বারগুইবার সময়কার গৌরব ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দেয়। হাবিব বারগুইবার পিতৃতান্ত্রিক ও কর্তৃত্ববাদি ধরনের শাসনামলেই তিউনিসিয়ার আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার গোড়া পত্তন হয়। ক্ষমতায় আসার পর থেকেই নিদা তিউনিস পার্টি নতুন নতুন সন্ত্রাসবাদবিরোধী আইন প্রণয়ন করে দেশটির পুলিশ বাহিনীকে আরো শক্তিশালি করতে থাকে। এছাড়া তারা দেশে এক ধরনের জরুরি অবস্থা জারি করে রেখেছে। এমনকি উদারবাদি ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল এন্নাহাদার নেতৃত্বাধীন সরকার দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের বিচারের আওতায় আনার জন্য যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল সেসবও বন্ধ করে দেয় নিদা তিউনিস পার্টির নেতৃত্বাধীন সরকার। এক্ষেত্রে তারা সবচেয়ে বিতর্কিত যে আইনটি প্রণয়ন করে সেটি হল দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদেরকে তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগসমূহ থেকে দায়মুক্তি দেওয়ার জন্য অর্থনৈতিক পূনঃআত্মীকর‌ণ আইন। এই আইনে ব্যবসায়ীদেরকে তাদের কালো টাকার একটা অংশ রাষ্ট্রের কাছে সমর্পণের বিনিময়ে দায়মুক্তির ব্যবস্থা করা হয়। তার চেয়েও বড় কথা হল গত বছর স্থাপিত ট্রুথ অ্যান্ড ডিগনিটি কমিশনের হাত থেকেও তাদের রেহাই দানের ব্যবস্থা করা হয়। এর ফলে দেশটিতে পূণরায় দুর্নীতি ও অর্থনৈতিক নৈরাজ্য ফিরে আসা এবং বিদেশি বিনিয়োগ বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এছাড়া যেসব বাধা-বিপত্তির কারণে দেশটির চলমান অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে সেগুলো আরো স্থায়ী হবে এবং বেন আলীর সময়কার দুর্নীতিগ্রস্ত সিস্টেমও পূণর্বহাল হবে। তবে অর্থনৈতিক দুর্যোগ ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলার অজুহাতে এসব অভিযোগের কোনো তোয়াক্কাই করছেন না নিদা তিউনিস পার্টির নেতৃবৃন্দ। তাদের মতে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে হলে ব্যবসায়ীদের উপর খড়গহস্ত হওয়া যাবে না। বিখ্যাত ভূমধ্যসাগরীয় পর্যটন স্পট সুসের সমুদ্র সৈকতে সন্ত্রাসী হামলার পর দেশটির পার্লামেন্টে উত্থাপিত সন্ত্রাসবাদবিরোধী আইনের বিরোধীতা করেননি একজন সংসদ সদস্যও। কিন্তু ওই বিলটি উপস্থাপনের সময় অনুপস্থিত দশ গণপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে একযোগে আক্রমণ চালায় সরকারপ্রভাবিত গণমাধ্যমগুলো। দেশটির সাংবাদিক ইউনিয়নের প্রধান নেজি বিঘৌরি বলেন, গণমাধ্যমগুলোর এ ধরনের আচরণ শুধুমাত্র সাবেক স্বৈরশাসক বেন আলির শাসনামলেই দেখা যেত। নেজি বিঘৌরি বলেন, ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অজুহাতে পুরোনো স্বৈরশাসনামলের সব খারাপ চর্চাই ফিরে আসছে। অথচ আমরা এখনো গণতন্ত্রে উত্তরণের অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে রয়েছি। আমাদের এক পা গণতন্ত্রে তো আরেক পা এখনো স্বৈরতন্ত্রে।’

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়