Wednesday, July 15

রোজার পুরস্কার আল্লাহ দেবেন


আলম শামস রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের সওগাত নিয়ে প্রতি বছর মুসলিম জাহানের ঘরে ঘরে হাজির হয় মাহে রমজান। হাদিসে কুদসিতে রোজার ফজিলত সম্পর্কে রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, "রোজা আমার জন্য, আমি নিজে রোজার প্রতিদান দেব।" আমরা সব ইবাদতই আল্লাহর জন্য করি। তাহলে আল্লাহ কেন বললেন, 'রোজা আমার জন্য।' আসলে অন্য সব ইবাদত করার পাশাপাশি তা প্রদর্শনের সুযোগ ও মনোভাব থাকে, যেমন- নামাজ, হজ, জাকাত ইত্যাদি। কিন্তু রোজা আল্লাহ এবং বান্দা ছাড়া প্রদর্শনের বা জাহির করার কোনো সুযোগই থাকে না। রোজা ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ। আত্মসংযম, আত্মনিয়ন্ত্রণ, আত্মশুদ্ধিতা, সাম্য, ধৈর্য, ত্যাগ ও তাকওয়া অর্জনের অন্যতম প্রধান উপায় রোজা। এ ইবাদতের মাধ্যমে মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা সম্ভব হয়। আল্লাহভীতি বা তাকওয়া অর্জন এবং আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধনেও সাওম বা রোজা অপরিহার্য ও অনিবার্য ইবাদত। মানুষের নৈতিক উন্নয়ন ও দৈহিক শৃঙ্খলা বিধান, পারস্পরিক সমপ্রীতি-সহানুভূতি এবং সামাজিক সাম্য ও উন্নয়নের ক্ষেত্রেও রোজার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। মহানবী (সা.) রমজান মাসের রোজাকে ফরজ আখ্যায়িত করে বলেছেন, 'তোমাদের কাছে তাকওয়ার মাস রমজানের আগমন হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা তোমাদের ওপর এ মাসের রোজাকে ফরজ করে দিয়েছেন।' (নাসাঈ)। অর্থাৎ প্রত্যেক স্বাধীন সুস্থ বুদ্ধিসম্পন্ন মুসলিম নর-নারীর ওপর রোজা আবশ্যিক ইবাদত। কোনো মুসলিম রমজান মাসের রোজাকে অস্বীকার করলে কাফের হিসেবে গণ্য হবে। আর বিনা কারণে ইচ্ছাপূর্বক রোজা না রাখলে তার জন্য কাফ্ফারা আদায় অপরিহার্য করা হয়েছে আল কোরআনে। আত্মসংযম ও আধ্যাত্মিক উন্নতিতে রোজার গুরুত্ব এত ব্যাপক যে, প্রত্যেক নবী-রাসুলের অনুসারীদের ওপর তা অপরিহার্য ছিল। আল কোরআনের ভাষায়, 'তোমাদের ওপর রমজানের রোজা ফরজ করা হয়েছে যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। যাতে তোমরা মুত্তাকি বা আল্লাহভীরু হতে পারো।' (বাকারা-১৮৪)। কালের বিবর্তনে ও সময়ের পরিবর্তনে প্রত্যেক জাতির রোজার পদ্ধতি ভিন্ন হলেও উদ্দেশ্য অভিন্ন। আর তা হলো আধ্যাত্মিক উন্নতি-আল্লাহভীতি অর্জন। আধ্যাত্মিক উন্নতি অর্জনের জন্য আহলে কিতাব বা ঐশী ধর্মগুলো ছাড়াও অন্যান্য ধর্মে বিভিন্নভাবে আত্মসংযমের শিক্ষা দেয়া হয়। আর ইসলামী বিধান অনুযায়ী আধ্যাত্মিকতা অর্জনের প্রধান মাধ্যম রমজান মাসের সিয়াম সাধনা। রোজা শুধু আবশ্যকীয় ইবাদতই নয়; বরং আত্মিক উন্নতি ও নৈতিক উৎকর্ষ সাধনেও এর ভূমিকা ব্যাপক। কাম-ক্রোধ, লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ ইত্যাদি মানবিক কু-প্রবৃত্তি থেকে দূরে রাখে রোজা। শয়তানের প্ররোচনা ও নফসের কুমন্ত্রণা থেকে আত্মাকে হেফাজত রাখতেও রোজার ভূমিকা অগ্রগণ্য। এ জন্যই রাসূল (সা.) রোজাকে 'ঢাল' হিসেবে উল্লেখ করেছেন। রোজার মাধ্যমেই একজন মুসলিম কৃচ্ছ্র সাধন করে নিজেকে আত্মসংযমী করে গড়ে তুলতে পারে। সিয়ামের কঠোর শৃঙ্খলা ও নিয়ন্ত্রণ রোজাদারকে প্রকৃত মুসলিম হওয়ার সুযোগ করে দেয়। মুসলমানরা রোজার মাধ্যমেই মহান আল্লাহর সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে। রোজার মাধ্যমেই মানব হৃদয়ে তাকওয়া বা আল্লাহভীতি সৃষ্টি হয়। রোজাদার ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর হয়েও শুধু মহান আল্লাহর ভয়ে পানাহার ও অন্যান্য বর্জনীয় বিষয় থেকে বিরত থাকে। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি ও ভালোবাসা লাভের আশায় ইন্দ্রিয় স্বাদ-তৃপ্তি থেকে বিরত থাকেন রোজাদার। তাকওয়া অর্জন ও তাকওয়াভিত্তিক জীবন গঠনই সিয়াম সাধনার প্রধান উদ্দেশ্য। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, মহান আল্লাহ তায়ালা তাকওয়া অর্জনের উদ্দেশ্যেই রমজানের রোজাকে ফরজ বা আবশ্যকীয় করেছেন। অন্যান্য ইবাদতের চেয়ে রোজার পদ্ধতি ও মর্যাদা ভিন্ন। স্বাভাবিক কারণেই নামাজসহ অন্যান্য ইবাদত প্রদর্শিত হয়। কিন্তু রোজা কোনোরূপ প্রদর্শন ছাড়াই নীরবে-নিভৃতে পালন করা যায়। রোজার গোপনীয়তা সম্পূর্ণ ব্যক্তির ইচ্ছাধীন। এ জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামিন রোজার জন্য বিশেষ প্রতিদানের ঘোষণা দিয়েছেন। হাদিসে কুদসিতে উল্লেখ আছে, 'মহান আল্লাহ বলেন, আদম সন্তানের প্রত্যেক আমল তার জন্য কিন্তু সিয়াম ব্যতিক্রম। কেননা সিয়াম বা রোজা আমার জন্য আর আমিই এর প্রতিদান দেব।' (বুখারি ও মুসলিম)। সততা ও ন্যায়পরায়ণতাসহ বিভিন্ন মানবীয় গুণাবলির বিকাশ এবং মানবজীবনের সার্বিক সফলতার জন্য আত্মসংযম-আত্মনিয়ন্ত্রণ একান্ত প্রয়োজন। সংযম সাধনা ছাড়া মানবিকতার বিকাশ হয় না। এছাড়া বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব অর্জনের জন্যও নিজের প্রবৃত্তি ও আবেগ নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। আর সিয়াম সাধনার মাধ্যমেই তা অর্জন সম্ভব হয়। ইমাম গাজালি (রহ.) বলেছেন, 'দৈহিক কৃচ্ছ্র ও সংযমের সঙ্গে যখন অন্তরের সাধনা যুক্ত হয় তখনই আদর্শ সংযম চেতনার শ্রেষ্ঠতায় প্রতিফলিত হয় রমজানের সিয়াম সাধনায়।' শাহ ওয়ালিউল্লাহ মোহাদ্দেসে দেহলভি (রহ.) বলেছেন, 'পাশবিক বাসনার প্রাবল্য ফেরেশতাসুলভ চরিত্র অর্জনের পথে আন্তরায়, তাই এ উপকরণগুলোকে পরাভূত করে পাশবিক শক্তিকে আয়ত্তাধীন করাই এর আসল তাৎপর্য।' সবর বা ধৈর্যশীলতা মানবজীবনের অপরিহার্য গুণ। ধৈর্যের মাধ্যমে জীবনের যেকোনো বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব। সত্য-ন্যায়ের পথে চলতে হলে ধৈর্য ও ত্যাগের প্রয়োজন। জীবন সংগ্রামে টিকে থাকতে হলে সবর অপরিহার্য। মহান আল্লাহর আদেশ-নিষেধগুলো যথাযথভাবে পালন করতেও সবর বা ধৈর্যের প্রয়োজন হয়। মূলত ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্রসহ মানবজীবনের সামগ্রিক ক্ষেত্রে ধৈর্য বা সবরের বিশেষ প্রয়োজন। আর রমজান মাসের সিয়াম সাধনার মাধ্যমে সারা দিন প্রচ- ক্ষুধা-তৃষ্ণা সত্ত্বেও পানাহার বর্জন করে রাতে দীর্ঘ সময় তারাবির নামাজ আদায় এবং ভোর রাতে সাহরি গ্রহণ ইত্যাদির মাধ্যমে রোজাদারের ধৈর্যের প্রশিক্ষণ হয়। যারা এ প্রশিক্ষণে কামিয়াব হন তাদের জন্য রয়েছে পরম কাঙ্ক্ষিত জান্নাত।

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়