Tuesday, April 21

মজুরি পরিশোধে টালবাহানা নয়

মুফতি আহমদ মফিজ: অধিকাংশ ক্ষেত্রে শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার আদায়ের ব্যাপারে আমাদের অনেকের মনে স্বতঃস্ফূর্ততা থাকে না। তাই অনেকেই মজুর ও শ্রমিক দিয়ে কাজ করিয়ে তাদের পারিশ্রমিক সঠিকভাবে পরিশোধ করেন না বরং তাদের পারিশ্রমিক দেয়ার ব্যাপারে টালবাহানা করেন। কখনও তাদের প্রাপ্য পারিশ্রমিকের চেয়ে কম দেন। অনেকেই কাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের পারিশ্রমিক পরিশোধ করেন না। ইসলামের দৃষ্টিতে এসব আচরণ খুবই অন্যায়। ইসলাম শ্রমিকের শরীরের রক্ত পানি করা শ্রমের খুবই মর্যাদা দিয়ে থাকে। তাই কুলি-মজুরের পারিশ্রমিক তাদের শরীরের ঘাম শুকানোর আগেই দিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে। 'তুমি মজুরকে তার শরীরের ঘাম শুকানোর আগেই পারিশ্রমিক দিয়ে দাও।' (ইবনে মাজা : ২৪৪৩, সুনানে বায়হাকি : ১১৯৯৪)। যারা শ্রমিক ও মজুরদের পারিশ্রমিক সঠিকভাবে পরিশোধ করে না, তাদের ব্যাপারে হাদিসে কঠিন হুশিয়ারি এসেছে। এ সম্পর্কে হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, 'আল্লাহ তায়ালা হাদিসে কুদসিতে এরশাদ করেন, হাশরের মাঠে আমি তিন ব্যক্তির প্রতিপক্ষ হবো- ১. যে ব্যক্তি আমার নামে ওয়াদা করে তা পূর্ণ করে না। ২. যে ব্যক্তি কোনো স্বাধীন ব্যক্তিকে বিক্রয় করে তার মূল্য ভোগ করে। ৩. যে ব্যক্তি কোনো শ্রমিককে কাজে নিযুক্ত করে তার কাছ থেকে কাজ আদায় করে নেয়; কিন্তু তার পারিশ্রমিক পরিশোধ করে না।' (বোখারি : ২২৭০)। হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, 'তোমরা মাজলুমদের বদদোয়া থেকে নিজেদের রক্ষা করো। যদিও সে কাফের হয়। কেননা তার ও আসমানের মধ্যে কোনো অন্তরায় থাকে না।' (আবু দাউদ : ৩৫২৯)। ইসলাম মানুষকে মানবিক মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে। তাই ধন-সম্পদকে ইসলাম মানসম্মানের মানদন্ড হিসেবে নির্ণয় করেনি বরং মানবীয় মহৎ গুণাবলিকেই ইসলাম মানসম্মানের মানদন্ড হিসেবে নির্ণয় করেছে। ইসলামের দৃষ্টিতে যে কোনো ব্যক্তি মহৎ গুণাবলি অর্জন করার মাধ্যমে মর্যাদার সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করতে পারে। জন্মগত দিক থেকে সে যতই সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করুক না কেন, পেশাগত দিক থেকে সে যতই সাধারণ পেশাজীবী হোক না কেন, এভাবেই ইসলাম সব অভিজাততন্ত্রের মূলে কুঠারাঘাত হেনেছে। যার ফলে আমরা দেখতে পাই, ইসলামের দৃষ্টিতে একজন সৎকর্মপরায়ণ, পরহেজগার শ্রমজীবী কোটি কোটি, বিলিয়ন বিলিয়ন অর্থবিত্তের মালিকের চেয়ে বেশি মর্যাদার অধিকারী হতে পারে। দুনিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ সম্মান ও মর্যাদা হচ্ছে নবুয়তির মর্যাদা। এর ওপর সম্মান ও মর্যাদার আর কোনো দায়িত্ব নেই। অথচ নবী-রাসুলরা শ্রমজীবী হয়েও সম্মান ও মর্যাদার এ উচ্চাসনে আরোহণ করতে পেরেছিলেন। এ সম্পর্কে হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) এরশাদ করেন, 'আল্লাহ তায়ালা দুনিয়াতে এমন কোনো নবী প্রেরণ করেননি, যিনি বকরি চরাননি। তখন সাহাবায়ে কেরাম বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহর রাসুল! আপনিও কি বকরি চরিয়েছেন? জবাবে নবী করিম (সা.) বললেন, হ্যাঁ, আমিও এক কিরাত, দুই কিরাত পারিশ্রমিকের বিনিময়ে মক্কাবাসীর বকরি চরিয়েছি।' (বোখারি : ২২৬২)। নবী করিম (সা.) শ্রমিকের মর্যাদা প্রদানের ব্যাপারে শুধু নসিহত করেই ক্ষান্ত হননি। বরং তিনি মদিনায় যে সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেখানে একজন সত্যনিষ্ঠ শ্রমিক সর্বোচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়েছিল। আমরা জানি, নবী (সা.) তাঁর প্রাণপ্রিয় মেয়ে হজরত ফাতেমা (রা.) কে হজরত আলীর মতো একজন শ্রমজীবী মজুরের হাতে তুলে দিতে দ্বিধাবোধ করেননি। যিনি ইহুদিদের ক্ষেতে মজুরি খাটতেন। হজরত আলী (রা.) একজন মেহনতি-মজুর হয়েও কতটা মর্যাদার অধিকারী হয়েছিলেন, তা সবারই জানা। তার মতো একজন শ্রমজীবীকে মুসলমানরা তাদের খলিফা নিযুক্ত করতে দ্বিধা করেননি। এমনকি খলিফা হয়েও তিনি মজুরি খেটেছেন। ইসলাম একজন কর্মজীবী শ্রমিকের জন্যও অফুরন্ত সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মুক্ত করে দেয়। তার জীবনে সুখ-শান্তি ও সফলতা লাভের অপূর্ব সুযোগ এনে দেয়।

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়