Saturday, March 28

সৃষ্টির প্রতি দয়া করুন


শায়খ ড. আবদুল মুহসিন বিন মুহাম্মদ কাসেম: আল্লাহ তায়ালার মহান একটি গুণ দয়া করা। তাঁর অসংখ্য গুণের মাঝে সবচেয়ে প্রিয় গুণ এটি। রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন, 'আল্লাহ তায়ালা ১০০ দয়ামায়া সৃষ্টি করে মাত্র এক অংশ দয়া সব সৃষ্টির মধ্যে বণ্টন করেছেন। আর ৯৯ অংশ তাঁর কাছে রেখেছেন।' (মুসলিম)। তাঁর নাম 'রাহমান, রহিম' অতি দয়ালু, পরম করুণাময়। তিনি চান মানুষও তাঁর সৃষ্টির প্রতি দয়া করুক। রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, 'যারা অন্যের প্রতি দয়া করে, আল্লাহও তাদের প্রতি দয়া করেন। তোমরা জমিনের অধিবাসীদের প্রতি দয়া করো, তাহলে যিনি আসমানে আছেন, তিনি তোমাদের প্রতি দয়া করবেন।' (আবু দাউদ)। ইসলাম প্রাণীদের প্রতিও দয়া প্রদর্শনের নির্দেশ দিয়েছে। রাসূল (সা.) বলেন, 'তুমি যদি ছাগলের প্রতি দয়াপরবশ হও, তাহলে আল্লাহও তোমার প্রতি দয়াশীল হবেন।' (মুসনাদ আহমদ)। পবিত্র কোরআন বলছে, 'অনুগ্রহের বিনিময় অনুগ্রহ ছাড়া কী হতে পারে?' (সূরা আর রাহমান : ৬০)। মানব জীবনের লক্ষ্য হওয়া উচিত, সৃষ্টির প্রতি দয়া ও অনুগ্রহ করা। এতেই মানুষের সৌভাগ্য ও সফলতা নিহিত। আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'যারা ঈমান আনে এবং অপরকে দয়া ও সবরের উপদেশ দেয়, তারাই সৌভাগ্যশালী।' (সূরা বালাদ : ১৭)। যাদের হৃদয় পাষাণ পবিত্র কোরআনে তাদের নিন্দাজ্ঞাপন করা হয়েছে। এরশাদ হয়েছে, 'দুর্ভোগ তাদের জন্য, যাদের অন্তর কঠিন। তারা সুস্পষ্ট গোমরাহিতে রয়েছে।' (সূরা জুমার : ২২)। অন্তর কঠিন হওয়ার অর্থ কারও প্রতি দয়ার্দ্র না হওয়া। পাষাণ হৃদয় হতভাগ্যের লক্ষণ। রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, 'হতভাগার দিল থেকে দয়ামায়া তুলে নেয়া হয়।' (সুনানে আবু দাউদ)। বোখারির বর্ণনায় রয়েছে, 'যে মানুষের প্রতি দয়া করে না, আল্লাহও তার প্রতি দয়া করেন না।' রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, 'মোমিনরা পারস্পরিক দয়া, মহব্বত এবং সহযোগিতার ক্ষেত্র এক দেহের মতো। দেহের কোনো অঙ্গ ব্যথাপ্রাপ্ত হলে পুরো দেহ সমব্যথী হয়।' (বোখারি ও মুসলিম)। রাসূল (সা.) এরশাদ করেছেন, 'যে ব্যক্তি অপরের প্রয়োজন পূরণে সচেষ্ট থাকবে, আল্লাহও তার প্রয়োজন পূরণে সচেষ্ট থাকবেন।' মূলত কারও প্রয়োজন মেটানো কিংবা কারও বিপদাপদে পাশে দাঁড়ানো তখনই সম্ভব হয়, যদি আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি দয়া ও অনুগ্রহ অন্তরে জাগরুক থাকে। সৃষ্টিকুলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দয়া, অনুগ্রহের প্রাপ্য আপন পিতামাতা। কেননা পিতামাতা সন্তানকে অত্যন্ত দয়ামায়া ও আদর-সোহাগে লালনপালন করেন। বলা যায়, ইহজগতে পিতামাতাই সন্তানের প্রতি সবচেয়ে বেশি দয়ার্দ্র ও স্নেহশীল। তাই আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে আদেশ করেছেন, 'তোমার পালনকর্তা ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করো না এবং পিতামাতার প্রতি সদয় হও। তাদের মধ্যে একজন অথবা উভয়ই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়; তবে তাদের 'উফ' শব্দটিও বল না এবং ধমক দিও না, বরং তাদের সঙ্গে বিনম্রভাবে কথা বল। তাদের সঙ্গে অনুগ্রহের ডানা বিছিয়ে দাও আর বল_ হে প্রভু! তাদের প্রতি রহম করো, যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালনপালন করেছে।' (সূরা বনি ইসরাইল : ২৩-২৪)। তেমনি সন্তানের প্রতি দয়া প্রদর্শন করা পিতামাতার কর্তব্য। ইবনে বাত্তাল (রহ.) বলেন, 'ছোট বাচ্চাদের প্রতি দয়া করা, আদর-সোহাগ ও স্নেহ-মমতায় জড়িয়ে চুমু খাওয়া আল্লাহর কাছে প্রিয় আমল। তিনি এর উত্তম বিনিময় দান করবেন। প্রিয় নবী (সা.) হাসানের গালে মমতার চুমু এঁকে দিলেন। তা দেখে পাশে বসা আকরা ইবনে হাবেস (রা.) বলেন, আমার ১০টি সন্তান। কারও গালে কোনো দিন চুমু খাইনি। নবীজি (সা.) তার দিকে তাকিয়ে বললেন, 'যে দয়া করে না তার প্রতিও দয়া করা হয় না।' (বোখারি ও মুসলিম)। অতএব আল্লাহর দয়া লাভের বড় উপায় হচ্ছে পিতামাতার প্রতি সদয় হওয়া, ছোটদের স্নেহ করা, আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা, অভাবী ও মিসকিনদের সহায়তা করা, বিপদগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ানো ইত্যাদি। এ পৃথিবীতে সৃষ্টির প্রতি সর্বাধিক দয়াশীল ও করুণাকারী আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)। আল্লাহ তাকে বিশ্ববাসীর জন্য করুণার অাঁধার বানিয়ে পাঠিয়েছেন। তিনি নবিউর রহমাহ। রহমতের নবী। মুক্তির রবি। করুণার ছবি। আল্লাহ বলেন, 'হে নবী! আপনাকে আমি জগদ্বাসীর জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছি।' (সূরা আম্বিয়া : ১০৭)। তায়েফবাসীর নিষ্ঠুর নির্যাতন দেখে পাহাড়ের রক্ষক ফেরেশতা এসে তাঁর কাছে আবেদন জানালেন, আপনার অনুমতি হলে আমি দুই পাহাড়ের ঘর্ষণে ওদের পিষ্ট করে দিতে চাই। তিনি জবাব দিলেন, 'আমি আশা করি, ওদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম থেকে এমন লোকের জন্ম হবে যারা আল্লাহর ইবাদতের প্রতি ব্রতী হবে এবং তার সঙ্গে কাউকে শরিক সাব্যস্ত করবে না।' (বোখারি ও মুসলিম)। বর্ণিত আছে, একদিন তিনি কান্নাবিজড়িত কণ্ঠে দুই হাত তুলে বারবার বলছিলেন, 'হে আল্লাহ, আমার উম্মত, আমার উম্মত! আল্লাহ তায়ালা জিবরাঈলকে কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করতে পাঠালেন। প্রিয় নবী (সা.) জিবরাঈলকে বললেন, 'আমার উম্মতের মাগফেরাতের জন্য কাঁদছি। জিবরাঈল (আ.) আল্লাহর কাছে ফিরে গেলেন। আর এসে বললেন, 'আল্লাহ তায়ালা উম্মতের ব্যাপারে আপনাকে অসন্তুষ্ট এবং আপনাকে দুঃখিত করবেন না।' (মুসলিম)। ইমাম নববি এ হাদিসকে উম্মতের জন্য সবচেয়ে আশাব্যঞ্জক বলে আখ্যায়িত করেছেন। মূলত রাসূলুল্লাহ (সা.) এর দয়া ও অনুকম্পা ইহ-পরকাল পরিব্যাপ্ত। ইহজগতে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো, অভাবীকে সাহায্য করা, বিপদগ্রস্তকে উদ্ধার করা, ছোটদের স্নেহ করা, স্ত্রীকে ভালোবাসা, নারীদের প্রতি সদয় হওয়া, যুবকদের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা, সাথীদের ব্যথায় সমব্যথী হওয়া ইত্যাদি ছিল তাঁর আদর্শ ও সুমহান চরিত্র। তিনি এরশাদ করেছেন, 'যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানের পার্থিব সঙ্কট বা বিপদ দূর করবে আল্লাহ তায়ালা তার কেয়ামতের কঠিন বিপদ দূর করে দেবেন।' (মুসলিম)। ২৯ জমাদিউল আউয়াল মদিনার মসজিদে নববিতে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষিপ্ত ভাষান্তর করেছেন মুফতি মাহবুবুর রহমান নোমানি

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়