Thursday, November 6

মহানবীর তিন তনয়


আলী হাসান তৈয়ব নবুয়ত প্রাপ্তির ১৫ বছর আগে ২৫ বছর বয়সে মহানবী (সা.) খাদিজা (রা.) কে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ করেন। তাঁর নবুয়ত লাভকালে স্ত্রীদের মধ্যে কেবল হজরত খাদিজাই নবী (সা.) এর সঙ্গে ছিলেন। তিনি তাঁর প্রতি ঈমান আনেন। তাঁকে সর্বাত্মক সাহায্য করেন। হিজরতের তিন বছর আগে তিনি মারা যান। উম্মুল মোমিনিন খাদিজা (রা.) যেসব অনন্য বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল তার অন্যতম হলো, তিনি কেবল ইবরাহিম (রা.) ছাড়া রাসূল (সা.) এর সব সন্তানের জননী ছিলেন। তাঁর গর্ভে মহানবী (সা.) এর ছয় সন্তান জন্মলাভ করেন। রাসূল (সা.) এর ছেলেরা আল্লাহর ইশারায় একের পর এক মৃত্যুবরণ করেন। তাদের কেউ দীর্ঘায়ু লাভ করেননি। তবে তাঁর চার মেয়ের সবাই মোটামুটি দীর্ঘ জীবন পেয়েছেন। প্রত্যেকের বিয়ে হয়েছে শ্রেষ্ঠ সাহাবিদের সঙ্গে। এদের তিনজন মহানবী (সা.) এর জীবদ্দশায় মারা যান। চতুর্থ জন তাঁর মৃত্যুর ছয় মাস পর ইন্তেকাল করেন। প্রখ্যাত হাদিস ব্যাখ্যাতা ইমাম নববি (রহ.) বলেন, মহানবী (সা.) এর তিন ছেলে ছিলেন। এরা হলেন_ কাসেম, আবদুল্লাহ ও ইবরাহিম (রা.)। মেয়েরা হলেন উম্মে কুলসুম, রোকাইয়া, জয়নাব ও ফাতেমা (রা.)। কাসেম বিন মুহাম্মদ (সা.) : এ ছেলের নামের সঙ্গে মিলিয়ে নবী (সা.) কে আবুল কাসেম (কাসেমের বাবা) উপনামে ডাকা হতো। তিনি নবুয়তের আগে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র দুই বছর বয়সে মারা যান। আবদুল্লাহ বিন মুহাম্মদ (সা.) : তাকে তৈয়ব এবং তাহেরও বলা হতো। তাহের ও তৈয়ব অর্থ ভালো ও পবিত্র। নবুয়তপ্রাপ্তির পর তিনি জন্মগ্রহণ করেন বলে তাকে এ নামে ডাকা হতো। ইবরাহিম বিন মুহাম্মদ (সা.) : তিনি মদিনায় হিজরতের অষ্টম বছর জন্মলাভ করেন। ইবরাহিম ছিলেন রাসূল (সা.) এর শেষ ছেলে। মিসরের বাদশা মুকাওকিস ষষ্ঠ হিজরিতে মহানবী (সা.) কে মারিয়া কিবতিয়া (রা.) নামক এক দাসী উপহার দেন। তিনি ইসলাম গ্রহণ করলে রাসূল (সা.) তাঁকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেন। তাঁর গর্ভেই ইবরাহিমের জন্ম। ইবরাহিমও বেশি দিন বাঁচেননি। ১০ম হিজরিতে মাত্র ১৭ বা ১৮ মাস বয়সে তিনি মদিনায় ইন্তেকাল করেন। ছেলে ইবরাহিমের মৃত্যু হলে রাসূল (সা.) এর চোখ থেকে অঝোর ধারায় অশ্রু নামে। সাহাবিরা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহর নবী আপনিও পুত্র শোকে কাঁদেন? রাসূল (সা.) বলেন, 'নয়ন অশ্রুসিক্ত, হৃদয় ব্যথিত, তবে আমরা কেবল তাই বলব যাতে আল্লাহ খুশি হন। তোমার বিচ্ছেদে আমরা বড় কাতর হে ইবরাহিম।' (সহিহ বোখারি)। রাসূলুল্লাহ (সা.) এর জীবন ও জীবনচরিতে নজর বুলালে আমরা দেখি, মহান আল্লাহ তাঁকে ছেলে-মেয়ে উভয়ই দিয়েছেন একাধিক। এতে করে তাঁর মানবিক চাহিদা ও মানব প্রকৃতি পূর্ণতা পেয়েছে। তবে সব ছেলেকে আল্লাহ বাল্যকালেই নিয়ে গেছেন। রাসূল (সা.) তখন ছেলে হারানোর শোক সহ্য করেছেন। এর আগে তিনি বাবা-মা হারানোর শোকও সহ্য করেছেন। মহান আল্লাহ নিজের বিস্ময়কর প্রজ্ঞা হেতু চেয়েছেন বলেই তাঁর কোনো ছেলেই দীর্ঘজীবন লাভ করেননি। যাতে করে তাঁর ছেলেকে কেন্দ্র করে কোনো গোষ্ঠী সাধারণ মানুষকে ফেতনায় ফেলতে না পারে। কেউ যেন তাদের নবী হওয়ার দাবি নিয়ে না দাঁড়ায়। এটি তেমনি ওই ব্যক্তিদের জন্য সান্ত্বনার কারণ যারা মোটেও কোনো ছেলে সন্তান লাভ করেননি অথবা করলেও তারা বাঁচেনি। পাশাপাশি এটি নবীদের ওপর নেমে আসা আল্লাহর বিচিত্র পরীক্ষার এক রূপ। কেননা মানবজাতির মধ্যে বিপদ-পরীক্ষার মুখোমুখি সবচেয়ে বেশি হতে হয় নবীদের। যেমন সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, আমি রাসূল (সা.) কে জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল (সা.) কোন শ্রেণীর মানুষের ওপর সবচেয়ে বেশি বিপদাপদ আসে? তিনি বললেন, 'নবীদের ওপর। তারপর পর্যায়ক্রমে নৈকট্যশীলদের ওপর। মানুষের ধার্মিকতা অনুযায়ী তাকে পরীক্ষা করা হয়। যে দ্বীনদারিতে দৃঢ়তর, তার বিপদ হয় কঠিনতর। পক্ষান্তরে যার দ্বীনদারিতে খাদ থাকে, তাকে তার ধার্মিকতা অনুপাতেই পরীক্ষা করা হয়। ধর্মপ্রাণদের ওপর পরীক্ষা এমনভাবে আসতে থাকে যে, একদিন তাকে এর বিনিময়ে পাপহীন বানিয়ে দেয়। সে তখন পৃথিবীতে বিচরণ করে নিষ্পাপ অবস্থায়।' (তিরমিজি)। মহানবী (সা.) এর পুত্র শোকের আগুনে ঘি ঢেলেছিল তখনকার পৌত্তলিকরা। যার পুত্র সন্তান মারা যায়, আরবে তাকে নির্বংশ বলা হয়। রাসূল (সা.) এর ছেলে কাসেম অথবা ইবরাহিম যখন শৈশবেই মারা যায়, কাফেররা তাঁকে নির্বংশ বলে উপহাস করতে লাগল। এদের মধ্যে আস ইবনে ওয়ায়েলের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তার সামনে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর কোনো আলোচনা হলে সে বলত, 'তার কথা বাদ দাও, সে তো কোনো চিন্তারই বিষয় নয়। কারণ, সে নির্বংশ। তার মৃত্যু হয়ে গেলে তার নাম উচ্চারণ করারও কেউ থাকবে না।' এ প্রেক্ষাপটে সূরা আল কাউসার অবতীর্ণ হয়। এতে ওই দুর্মুখদের জবাবে বলা হয়েছে, শুধু পুত্র-সন্তান না থাকার কারণে যারা রাসূল (সা.) কে নির্বংশ বলে, তারা তাঁর প্রকৃত মর্যাদা সম্পর্কে বেখবর। রাসূল (সা.) এর বংশগত সন্তান-সন্ততিও কেয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে, যদিও তা কন্যা-সন্তানের তরফ থেকে হয়। নবী (সা.) এর আধ্যাত্মিক সন্তান তথা উম্মত এত অধিকসংখ্যক হবে, পূর্ববর্তী সব নবী (আ.) এর উম্মতের সমষ্টি অপেক্ষাও বেশি হবে। এছাড়া এ সূরায় রাসূল (সা.) যে আল্লাহর কাছে অতি প্রিয় ও সম্মানিত, তাও তৃতীয় আয়াতে বিবৃত হয়েছে। আল্লাহ বলেছেন, 'নিশ্চয় আমি আপনাকে হাউজে কাউসার দান করেছি। অতএব আপনার পালনকর্তার উদ্দেশে নামাজ পড়ুন এবং কোরবানি করুন। নিশ্চয় আপনার বিদ্রূপকারীরা লেজকাটা, নির্বংশ।' (সূরা কাউসার : ১-৩)।

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়