Thursday, November 27

সৃষ্টির সেবার মধ্যেই স্রষ্টার ইবাদত


ইসলাম ডেস্ক,কানাইঘাট নিউজ: আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামিন। অর্থ: সমস্ত প্রশংসা বিশ্ব জাহানের প্রতিপালক আল্লাহর। পবিত্র কোরআনের প্রথম সূরার প্রথম আয়াত। আল্লাহ্ হচ্ছে মহান প্রভুর জাতি নাম বা ইসমে জাত, যার কোনো অর্থ বা প্রতিশব্দ নেই। আয়াতে আল্লাহ তায়ালা তার জাতি নামের সঙ্গে একটি গুণগত নাম বা ইসমে সিফাত ‘রব’ যুক্ত করেছেন যার অর্থ প্রতিপালক। আল্লাহতায়ালার বহু গুণবাচক নাম রয়েছে। রব নামটি অত্যন্ত অর্থবোধক, তাৎপর্যপূর্ণ এবং আল কোরআনে সর্বাধিক ব্যবহৃত গুণবাচক নাম। পবিত্র কোরআনের শুরুতে এ নামের ব্যবহার তার গুরুত্ব এবং মর্যাদার দিকেই ইঙ্গিত করে। রাব্বুল আলামিন সব সময় নিরপেক্ষ ও সর্বজনীন।তিনি তার প্রতিটি সৃষ্টিকে তার প্রয়োজন আনুপাতিক যাবতীয় অভাব পূরণ করে থাকেন। একমাত্র জিন এবং ইনসান ছাড়া সব সৃষ্টি আল্লাহর দীনের মধ্যে বসবাস করে। তারা কেউ কুফরি করে না। কিন্তু মানুষ এবং জিন আল্লাহর নির্ধারিত দীন থেকে বের হয়ে আপন প্রবৃত্তির মাধ্যমে নিজস্ব একটি দীন রচনা করে নিজের আত্মার ওপর জুলুম করে জাহান্নামের পথিক হয়। তাই মহান আল্লাহ তাদের শয়তানের পথ ছেড়ে আল্লাহর নির্দেশিত পথে পরিচালিত করার জন্য যুগে যুগে নবী-রাসূল প্রেরণ করে সুনির্দিষ্ট বিধান প্রদান করেন। পৃথিবীতে আল্লাহ মানুষকে তার খলিফা বা প্রতিনিধি হিসেবে পাঠিয়েছেন। এ প্রতিনিধিত্ব আল্লাহর জাতের প্রতিনিধিত্ব নয় বরং তার সিফাতের প্রতিনিধিত্ব। আল্লাহর যতগুলো গুণ আছে তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গুণ হচ্ছে তার ‘রব’ নামের রবুবিয়াত বা পালনবাদী নীতি বা গুণাবলী। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, ‘আর যখন তোমার প্রতিপালক (রব) ফেরেস্তাদের বললেন, আমি পৃথিবীতে আমার প্রতিনিধি সৃষ্টি করতে চাই।’(সূরা বাকারা: ৩০)। আল্লাহ তায়ালা এই আয়াতে তাঁর ইসমে জাত ‘আল্লাহ’ শব্দটি ব্যবহার না করে ‘ইসমে সিফাত’ তথা গুণবাচক নাম ‘রব’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। এখানে ‘রব’ গুণবাচক নামের ব্যবহারের মাধ্যমে অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় বুঝিয়ে দিচ্ছেন যে, আল্লাহ পৃথিবীতে তার পালনবাদী নীতির বা বিধানের প্রতিনিধিত্ব করার জন্যই মানুষ সৃষ্টি করেছেন। পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে আল্লাহর জাতের কোনো প্রতিনিধিত্ব হয় না, এটি অসম্ভব। কারণ আল্লাহর জাত অসীম আর মানুষ সসীম। সুতরাং সসীম কীভাবে অসীমের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে? আল্লাহর সিফাত বা গুণাবলীও অসীম কিন্তু মানুষ তা তার ধারণক্ষমতা অনুযায়ী ধারণ করতে সক্ষম। ‘রব’ বহুল অর্থবোধক সারগর্ভ একটি আরবি শব্দ। সাধারণত ‘রব’ শব্দটির তিনটি অর্থ করা যায় (যদিও তার অনেক অর্থ আমাদের জ্ঞানবহির্ভূত)। প্রথম অর্থ স্রষ্টা, দ্বিতীয় অর্থ পালনকর্তা এবং তৃতীয় অর্থ বিতরণকারী। আল্লাহ তায়ালার অসীম গুণাবলীর মধ্যে অতি সামান্যই আমরা এ মহাবিশ্বের সৃষ্টি, স্থিতি, গতি, পরিবর্তন ও বিবর্তনের মধ্যে ‘রব’ গুণের পরিচায়ক হিসেবে জানতে পাই। যিনি অণু-পরমাণু কিংবা আমাদের অজ্ঞাত আরও সূক্ষ্মতর কোনো আদি সৃষ্টি থেকে চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র শোভিত বিস্ময়কর এ বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের প্রতিটি বস্তুর নির্জীব ও সজীবের পালনকর্তা এবং তাদের প্রাথমিক অবস্থা থেকে চরম বিকাশের নিয়ন্তা। তার এসব গুণের গুণবাচক নামই হচ্ছে ‘রব’। একথা বলা যায়, ‘রব’ প্রভু হচ্ছেন তার যাবতীয় সৃষ্টির স্রষ্টা, পালনকর্তা এবং তাদের জীবনধারণের সার্বিক প্রয়োজনীয় সামগ্রীর বিতরণকারী। যাদের চিন্তা-চেতনা, দর্শন ও কর্মপন্থা রাব্বুল আলামিনের এ পালনবাদী নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য তাদের পবিত্র কোরআনের ভাষায় ‘রব্বানি’ বলা যায়। এজন্য রব প্রভু তার মনোনীত বান্দাদের রব্বানি হয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন- কুনু রব্বানিয়ীনা, অর্থ: তোমরা রব্বানি হয়ে যাও। (সূরা আল ইমরান:৭৯)। ইসলামের শিক্ষা ও ইসলামী জীবনব্যবস্থা শাসন ও শোষণভিত্তিক নয়, বরং তা রবের পালনবাদী নীতির ভিত্তিতে হতে হবে। যারা নিজের ও আল্লাহর অপরাপর সৃষ্টির প্রতি আল্লাহর পালনবাদী নীতি অনুযায়ী আচার-আচরণ করতে পারে তারাই রব্বানি। সহজ কথায় ইসলামের মূলমন্ত্র হচ্ছে সৃষ্টির সেবা এবং এটিই স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ ইবাদত। রব্বানি দৃষ্টিভঙ্গি এ কথাই শিক্ষা দেয় যে, যে কোনো কথা, কর্ম, আচরণ নিজের জন্য অথবা অপরের জন্য অকল্যাণকর তাই পাপ এবং যা কল্যাণকর তাই পুণ্য। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে রব্বানিদের এ বলে নির্দেশ দিচ্ছেন- ‘তোমরা উত্তম জাতি, তোমাদের আগমন মানব কল্যাণের উদ্দেশে। তোমরা সৎ কর্মের নির্দেশ দেবে, বিরত রাখবে (নিজেকে এবং অপরকে) অসৎ কর্ম থেকে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখবে।’ (সূরা আল ইমরান: ১১০)। সুতরাং সৃষ্টির কল্যাণার্থে মানুষের প্রতি আল্লাহ কর্তৃক অর্পিত সব দায়িত্ব যথাযথভাবে সম্পন্ন করার নামই হচ্ছে রব্বানিয়্যাত। হক্কুল ইবাদ তথা মানবতার প্রতি অর্পিত দায়িত্ব সম্পন্ন করা ব্যতীত ‘হক্কুল্লাহ’ বা আল্লাহর ইবাদত যথাযথভাবে সম্পন্ন হয় না। সূরা ফাতেহার দ্বিতীয় আয়াতে আল্লাহ তায়ালা আরও দুটি গুণবাচক নাম ‘রহমান’ ও ‘রহিম’ ব্যবহার করেছেন। এ গুণবাচক শব্দদ্বয়কে অনুবাদ করা হয় দয়াময় বা করুণাময় বলে। এ দুটি শব্দই আরবি ‘রহম’ ধাতু থেকে যার অর্থ দয়া বা করুণা। পূর্বেও উল্লেখ করা হয়েছে আল্লাহর গুণাবলী ও মানুষের গুণাবলীর মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। রহমান ও রহিম এ দুটি শব্দের অর্থ দয়াময়-করুণাময় হলেও তার কার্যক্ষেত্র ভিন্ন। আর রহমানুদ দুনিয়া, ওয়ার রহিমুল আখেরা অর্থ: রহমান প্রভু দুনিয়ার জন্য এবং রহিম প্রভু আখেরাতের জন্য (হাদিস)। অর্থাৎ রহমান প্রভু পার্থিব জগতে প্রতিটি সৃষ্টির প্রতি দয়াবান আর রহিম প্রভু মানুষের কর্মফলের প্রতিদানকারী দয়াবান। মূলত রহমান ও রহিম গুণবাচক শব্দ দুটি উল্লিখিত রব গুণবাচক শব্দেরই পরিপূরক। রহমান প্রভুর দয়া সার্বিক, সর্বজনীন ও আয়াস নিরপেক্ষ। এ দান রহমান প্রভু তার সৃষ্টিকে কোনো কর্মের বিনিময়ে দান করেন না। প্রতিটি সৃষ্টিই রহমান প্রভু থেকে প্রয়োজনীয় যাবতীয় সামগ্রী স্বাভাবিকভাবেই পেয়ে থাকে। এ দান পাওয়ার জন্য বিশেষ কোনো কর্মের প্রয়োজন হয় না। মুমিন-কাফের, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ভালো-খারাপ নির্বিশেষে সবাই এ দান প্রয়োজন অনুসারে পেয়ে থাকে। এ দানগুলোর প্রতিদানে আল্লাহতায়ালা তার সৃষ্টির কাছে কিছুই প্রত্যাশা করেন না। জীব মাত্রই জৈবিক প্রয়োজন আছে। তা ছাড়া মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক ও আধ্যাত্মিক জীবনের বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে, যা ‘রহিম’ প্রভু প্রদান করেন। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেছেন, ‘পৃথিবীতে অবস্থিত প্রত্যেকের রিজিকের জামিনদার আল্লাহ, তিনি অবগত প্রত্যেকের প্রয়োজন ও অবস্থানস্থল সম্পর্কে।’ (সূরা হুদ: ৬)। ‘ওরা কি তোমার রবের করুণা বণ্টন করে? আমিই প্রত্যেকের জীবিকা বণ্টন করি।’ (সূরা জুখরুখ: ৩২)। ‘আমরাই তোমাদের জীবিকা দিয়ে থাকি।’ (সূরা ত্বহা:১৩২)। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে- এ পৃথিবীতে মানুষ ক্ষুধার্ত থাকে কেন? মঙ্গা হয় কেন? খেতে না পেয়ে মানুষ মারা যায় কেন? বন-জঙ্গলের পশুপাখিকে কেউ কোনোদিন অভুক্ত থাকতে দেখেছেন কি? তারা আগামী দিনের জন্য কোনো খাদ্য সামগ্রী সঞ্চয় করে কি? প্রসঙ্গক্রমে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করছি। আমার বাসার সামনে কিছু গাছ আছে। প্রতিদিন সকাল হলেই গাছে একটি পাখি কুক্ কুক্ করে অবিরামভাবে ডাকতে থাকে। ক্ষিদে পেলে সে কিছুক্ষণের জন্য স্থান ত্যাগ করে আহারের খোঁজে যায়। আহার শেষে সে পুনরায় বৃক্ষডালে এসে অনবরত কুক্ কুক্ করে ডাকতে থাকে।আমি আমার স্ত্রীকে ডেকে পাখিটিকে দেখিয়ে বললাম, দেখ পাখিটি অবিরামভাবে আল্লাহর জিকির করছে। অথচ আমরা মানুষ হয়ে আল্লাহকে এবং তার প্রদত্ত সব নেয়ামতকে ভুলে গেছি। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘দেখ না আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে, উড্ডীনরত পাখিগুলো আল্লাহর সালাত ও তসবিহ পাঠ করে।’ (সূরা নূর: ৪১)। আল্লাহ তায়ালা আদমকে সৃষ্টি করে প্রতিশ্রæতি দিচ্ছেন- ‘এখানে তুমি (হে আদম) ক্ষুধার্ত থাকবে না, উলঙ্গ হবে না, পিপাসিত থাকবে না, রোদে কষ্ট পাবে না।’ (সূরা ত্বহা: ১১৮, ১১৯)। অর্থাৎ আদমকে সৃষ্টি করে আল্লাহতায়ালা তার মৌলিক চাহিদাগুলোর নিশ্চয়তা প্রদান করেছেন। প্রত্যেক সৃষ্টির বেঁচে থাকার জন্য যেসব মৌলিক চাহিদা দরকার আল্লাহ তার সবকিছুই মজুদ রেখেছেন। কিন্তু মানুষ তার ষড়রিপুর বশবর্তী হয়ে মজুদদারি ও অত্যধিক ভোগ-বিলাসে মত্ত হয়ে অন্যের ন্যায্য মৌলিক অধিকারগুলো থেকে তাদের বঞ্চিত করছে। এ হচ্ছে আল্লাহর পালনবাদী নীতি তথা আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা যা কুফরিরই নামান্তর।

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়