Sunday, November 23

ব্যবসায়ে নৈতিকতার সীমারেখা


ড. আ ই ম নেছার উদ্দিন ৩২তম অটোমান সম্রাট আব্দুল আজিজ এর আমলে প্রচলিত মুদ্রা সম্পদ আহরণের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্য। এক্ষেত্রে বৈধ ও অবৈধ বিষয়গুলো ইসলামে সুনির্দিষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। সম্পদ আহরণের পদ্ধতি এমনভাবে বিন্যস্ত রয়েছে, যাতে অন্যের ওপর কোনো প্রকার জুলুম হওয়ার বা কেউ কারোর ওপর কোনো প্রকার অন্যায় করার সুযোগ রাখা হয়নি। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এসব নির্দেশনা মেনে চললে মানবসৃষ্ট যাবতীয় অন্যায়, অত্যাচার ও অরাজকতা থেকে মানুষ মুক্ত থাকতে পারে, অন্যদিকে হালাল বা বৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জন করে নিজের তথা পারিবারিক, সামাজিক ও জাতীয় দায়িত্ব পালন এবং সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। ইসলামে নীতিগতভাবে বৈধতা দান করা হয়েছে এমন কিছু ব্যবসার বিষয়ে আমরা এখানে আলোচনা পেশ করব। * ব্যবসায়ের প্রসারতার জন্য বা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পুঁজি একত্র করে অংশ অনুযায়ী লাভ ও লোকসান উভয়টার অংশীদার হওয়ার চুক্তির মাধ্যমে ব্যবসা পরিচালনাকে ইসলাম বৈধতা দিয়েছে। এ ধরনের ব্যবসায় বিশ্বস্ততা ও ন্যায়পরায়ণতা বাস্তবায়নের সুযোগ সৃষ্টি হয়। সে কারণে এ ধরনের ব্যবসাকে ইসলাম উৎসাহিত করেছে। এ ধরনের ব্যবসাকে মুশারাকা বলা হয়। * আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টি-রহস্যের মধ্যে এটাও অন্যতম যে, অনেকের কাছে মেধা ও অর্থ একসঙ্গে থাকে না। কারও কাছে মেধা ও উদ্যোগ গ্রহণের সুযোগ রয়েছে, আবার কারও কাছে অর্থ আছে; কিন্তু উদ্যোগ ও মেধার অভাবে অর্থকে কাজে লাগাতে পারছেন না। সেক্ষেত্রে ইসলাম উভয় দিককে কাজে লাগিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করার সুন্দরতম ব্যবস্থা রেখেছে। এ ব্যবস্থায় একপক্ষ- যার অর্থ আছে তিনি হবেন সাহিবুল মাল বা রাব্বুল মাল, অন্যপক্ষ- যিনি মেধা, শ্রম ও সময় দিয়ে উদ্যোগ গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করবেন তিনি হবেন মুদারিব বা উদ্যোক্তা। উভয়ের মধ্যে লাভ-লোকসানের একটি চুক্তি হবে। লাভের কত অংশ কে নেবেন তা চুক্তিতে উল্লেখ থাকবে। এ ব্যবস্থায় লোকসানের পুরোটাই সাহিবুল মাল বা রাব্বুল মালকে বহন করতে হয়। এ ব্যবসার জন্য বিশ্বস্ততা, সততা ও ন্যায়পরায়ণতা একান্ত প্রয়োজন। এ ব্যবসা প্রবক্তা হচ্ছেন, প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.)। হজরত খাদিজা (রা.) ছিলেন সাহিবুল মাল বা রাব্বুল মাল। রাসূল (সা.) ছিলেন মুদারিব বা উদ্যোক্তা বা পরিচালনাকারী। হজরত খাদিজা (রা.) রাসূল (সা.)-এর বিশ্বস্ততা ও ন্যায়পরায়ণতায় অভিভূত ছিলেন। অপরদিকে লাভের পরিমাণ আগের সব অবস্থা থেকে বেশি হওয়ায় তিনি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়েছিলেন। এক পর্যায়ে হজরত খাদিজা তার সব ব্যবসার দায়দায়িত্ব রাসূল (সা.)-এর ওপর অর্পণ করেছিলেন। এ ব্যবস্থায় লোকসানের একটি বিধান থাকলেও বিশ্বস্ততার মাপকাঠিতে এ ব্যবস্থায় পরিচালনা করা গেলে লাভের পরিমাণ বেশি হবে আর লোকসানের পরিমাণ কম হবে- এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ ব্যবসাকেই মুদারাবা ব্যবসা বলা হয়। * ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারের জন্য ক্ষেত্রবিশেষে ছাড় দিয়ে পণ্য বিক্রয় করার নির্দেশনাও ইসলাম দিয়েছে। এতে উৎপাদন ও বিনিয়োগ বাড়ার সম্ভাবনা থাকে। ক্রয়মূল্যে পণ্য ধরে না রেখে ওই মূল্যেই বিক্রয় করে দেয়াকে ইসলাম উৎসাহিত করেছে। কেনা-বেচায় স্থবিরতাকে দূর করার জন্য এ ব্যবস্থা ইসলামে রয়েছে। এ ধরনের ক্রয়-বিক্রয়কে 'তাওয়ালি্লয়াহ' বলা হয়। * ব্যবসায় লাভ-লোকসান উভয়টির সম্ভাবনা থাকে। তাই লোকসানের ঘোষণা দিয়ে মাল বিক্রয় করা বৈধ। সেখানে বিক্রেতার কাছে ক্রয়মূল্য উল্লেখ করে এর লোকসানের শতকরা হার উল্লেখ করে বিক্রয় করা হালাল। এতে ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে সৌহার্দপূর্ণ মনোভাব তৈরি হয়। ক্রেতা মনে ধারণা করবে, তিনি শুধু আমাকে লাভেই পণ্য বিক্রি করেন না, লোকসানেও বিক্রি করেন। এতে ব্যবসার অসম প্রতিযোগিতা দূর হওয়ার সুযোগ হয় এবং ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবসার প্রসার ঘটে। এ ধরনের ব্যবসাকে 'মুওয়াজাআহ' বলা হয়। * দর কষাকষিতে ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এজন্য সঠিক পণ্য ও সঠিক দামে বিক্রির নির্দেশনাও ইসলামে রয়েছে। এক দামে পণ্য বিক্রির অনেক উপকারিতা রয়েছে। এতে ক্রেতা প্রতারিত না হওয়া, আবার বিক্রেতার বেশি পণ্য বিক্রয় হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। পণ্য ও তার ন্যায্যমূল্য উল্লেখপূর্বক বিক্রি করার এ ব্যবসাকে 'মুসাওমাহ' বলা হয়। * পণ্য বা মালের বিনিময়ে ব্যবসা করার বিধান ইসলামে রয়েছে। একটি পণ্যের বিনিময়ে অন্য এক বা একাধিক পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করা বৈধ। এতে সময় ও সম্পদের অপচয় রোধ করা যায়। অন্যদিকে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে সম্পদ কাজে লাগানোর ব্যবস্থা এ ধরনের ব্যবসায় রয়েছে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে কৃষিপণ্য বিনিময়ে এ ধরনের ব্যবসা অত্যন্ত সুবিধাজনক। এ ব্যবসায়ের মাধ্যমে সঠিক পণ্য, সঠিক মাপ ও সঠিক মূল্য নির্ধারণের সুন্দর ব্যবস্থা করা যায়। এ ধরনের ব্যবসায়কে মুবাদালা বা বিনিময় বলা হয়। * কোনো পণ্য পরিমাণে বেশি হলে বা অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়লে বা পণ্যের অবস্থা অনুযায়ী উচিত মূল্যে বিক্রয় করার লক্ষ্যে নিলামে বিক্রি করা ইসলামের দৃষ্টিতে বৈধ। এ ধরনের ব্যবসার জন্য পণ্য ও ক্রেতা উভয়ের প্রকাশ্য থাকা শর্ত। প্রয়োজনীয়তার আলোকে পণ্যটির উচিত মূল্যপ্রাপ্তির জন্য এ ব্যবস্থা ইসলাম অনুমোদন দিয়েছে। এ ব্যবসায় কিছু শর্ত পরিপালন করতে হয়। ব্যবসাটি হালাল হলেও শর্ত ভঙ্গ করার কারণে তা হারামে পর্যবসিত হতে পারে। সেদিকে খেয়াল রেখে এ ধরনের নিলামের ব্যবস্থা করা জরুরি। কিন্তু আমাদের দেশে প্রায়শই এসব শর্ত লঙ্ঘনের ঘটনা পরিলক্ষিত হয়। ইসলাম ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সুবিধাজনক নীতি ও পদ্ধতির প্রবর্তন করেছে। উপরের এসব আলোচনা ছাড়াও আরও কিছুু ব্যবসায়ের ধরন রয়েছে। সমাজকে সুদের অভিশাপ থেকে বাঁচানোর জন্য সেগুলো ইসলামী শরিয়ার নির্দেশনা অনুযায়ী কাজে লাগালে এবং পরিচালনা করা সম্ভব হলে সমৃদ্ধি ও অগ্রগতির পথে দেশ, জাতি ও সমাজ এগিয়ে যেতে পারে। সম্পদ কেন্দ্রীভূত না করে সম্পদের সুষম বণ্টনের দ্বারাই নিশ্চিত হতে পারে সব বৈষম্য। আল্লাহ তায়ালা এজন্যই সুদকে হারাম করেছেন। লেখক : বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়